ছোটগল্প নিয়ে এতো অল্প কথায় এমন পরিপূর্ণ সংজ্ঞা শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথের পক্ষেই দেওয়া সম্ভব, আর একথা এখনও নির্দ্বিধায় মেনে নেওয়া হয় যে, বাংলা সাহিত্যে স্বার্থক ছোটগল্পের জনক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শুধু তাই নয় বাংলা ছোট গল্পের বিকাশ ও উন্নতি সাধন হয়েছে তারই হাত ধরে।
মার্কিন গল্পকার অ্যাডগার অ্যালেন পো ছোটগল্পের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, যে গল্প অর্ধ থেকে এক বা দুই ঘণ্টার মধ্যে এক নিঃশ্বাসে পড়ে শেষ করা যায়, তাকে ছোটগল্প বলে। অন্যদিকে, প্রমথ চৌধুরীর মতে ছোটগল্প ‘ছোট ও গল্প’ হতে হবে। অবশ্য এই লেখা কোনোভাবেই বাংলা ছোটগল্পের আদি-অন্ত নিয়ে বিশদ আলোচনার উদ্দেশ্যে নয়, বরং এই সময়ে বাংলা ছোটগল্প যাদের ভাবনার ছোঁয়ায় আন্দোলিত হচ্ছে লেখাটা মূলত সেইসব গল্পকারদের গল্প নিয়েই।
অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলানিউজ২৪.কম সম্প্রতি বর্তমান সময়ের কুড়িজন গল্পকারের গল্প নিয়ে একটি বিশেষ আয়োজন করে। এই কুড়িজন গল্পকারের কুড়িটি গল্প পড়ে গল্পগুলো নিয়ে লেখার অনুরোধ এলে সাগ্রহে অনুরোধটি নিই। বিশেষ এই আয়োজনে তাদের প্রায় সবাই বয়সে নবীন, ব্যক্তিগতভাবে অনেকের সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই, অনেকের লেখা প্রথমবারের মতো পড়ছি, আবার অনেকেই রয়েছেন যাদের প্রায় সব লেখা পড়া, যাহোক যারা এই আয়োজনকে সমৃদ্ধ করেছেন তারা হলেন- আকাশ মামুন, আবদুল্লাহ আল ইমরান, আবু উবায়দাহ তামিম, এনামুল রেজা, কিঙ্কর আহ্সান, জব্বার আল নাঈম, নাদিরা মুসতারী, নাহিদা নাহিদ, নুসরাত নীলা, ফারাহ্ সাঈদ, মাসউদ আহমাদ, মাহমুদ নোমান, মাহবুব ময়ূখ রিশাদ, মুহাম্মদ ফরিদ হাসান, রাসেল রায়হান, শামীম আরেফীন, শাফিনূর শাফিন, সাব্বির জাদিদ, সালাহ উদ্দিন মাহমুদ ও হুমায়ূন শফিক। নামের আদ্যক্ষর অনুযায়ী গল্পগুলোকে সাজানো হয়েছে। চলতি মাসের এক তারিখ থেকে প্রকাশিত হয়ে আসছে গল্পগুলো। প্রত্যেকটি গল্প কয়েকবার করে পড়া হলেও একসঙ্গে কুড়িটি গল্পের আলোচনা লেখা সত্যি দুরূহসাধ্য ব্যাপার। পড়ার সময় নামের তালিকানুযায়ী পড়িনি। তাই আলোচনায় উপরোল্লিখিত ক্রম বজায় রাখা সম্ভব হয়নি।
গল্পের এই আয়োজনের প্রথম গল্পটির নাম ‘টান’, লেখক আকাশ মামুন। আকাশ মামুনের গল্পটির বিষয়বস্তুতে নতুনত্ব নেই, চিরাচরিত প্রেম বিরহ এবং পরিণতি নিয়ে লেখা গল্পটি। গল্পটি আরম্ভ হয়েছে বিবাহে অনিচ্ছুক জেবিন নামক চরিত্রের মাধ্যমে। জেবিনের দীর্ঘদিনের প্রেমিক অরিত্র বিয়ের আগের রাত্রে ফোন করে জানায় সে বিয়ে করতে ইচ্ছুক নয়, কী কারণ তা জানায় না। জেবিনের বাবা-মায়ের পছন্দের পাত্র ফয়সালের সঙ্গে বিয়ে করতে রাজী হয়ে যায় জেবিন, অরিত্রর প্রতি ঘৃণাবোধ জেবিনকে বিয়ের এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে। কিন্তু খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে অরিত্র পুনরায় ফিরে আসে জেবিনের কাছে, কোনো সঙ্গত কারণ উপস্থাপন ছাড়াই সে জেবিনকে আবার কাছে পেতে চায়। জেবিন পুরনো প্রেমিক অরিত্রকে ফিরিয়ে দিতে পারে না। এই ব্যাপারটা খুব ক্লিশে মনে হয়েছে। একজন প্রেমিক স্বার্থপরের মতো কোনো কারণ ব্যতিরেকে বিয়ের আগের রাতে বিয়ে করবে না বলে জানিয়ে দেয়, আবার কিছুদিন পর এসে বলে তার কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য এবং এই অন্যায় চাওয়াকে মেনে নেওয়া- না, প্রাপ্তবয়স্ক দুইজন মানুষের সম্পর্ককে এভাবে সরলীকরণ করার সুযোগ বোধহয় নেই। পরবর্তীতে দেখা যায়, জেবিনের স্বামী ফয়সাল নিজের অধিকার ত্যাগ করে জেবিনকে মুক্ত করে দিয়ে অস্ট্রেলিয়া পাড়ি দেয়, অরিত্র জেবিনকে বিয়ে করে এবং আমেরিকা চলে যায়। যাওয়ার পূর্বে ফয়সালের প্রতি জন্ম নেয় ভালোবাসা, কিন্তু সেই ভালোবাসা মনের গোপনে জমিয়ে রেখেই সে আমেরিকা চলে যায়। পরবর্তীতে দেখা যায়, অপরাধবোধ থেকে হোক আর ভালোবাসা থেকেই হোক ফয়সাল ঘুরে ঘুরে জেবিনের জীবনে ফিরে আসে, একপর্যায়ে বাইপোলার ডিজঅর্ডারের রোগী হয়ে যায়। গল্পে ভালো লাগার জায়গা গল্পের গতিময়তা, মাত্র তিনটি চরিত্রে গল্পটি দারুণভাবে এগিয়েছে, ভাষা, বাক্যগঠনেও আছে মুন্সিয়ানার ছাপ। আকাশ মামুনের পরবর্তী গল্প আরও বৈচিত্র্যময় হবে এই আশাবাদ রইল।
হুমায়ূন শফিকের গল্প ‘বাঁশি’। বিষয় নির্বাচনে নতুনত্ব। একজন বিচ্ছিন্ন মানুষ নিজেকে খুঁজে বেড়াতে থাকে, নিজের অস্তিত্ব নিয়ে কিছুটা সন্দিহান, তার আফসোস দাদা মারা যাওয়ার পর কেউ তাকে তার পুরো নাম ‘আব্দুল হামিদ’ বলে ডাকে না। গল্পের এমন এই অবস্থা থেকে হঠাৎ আব্দুল হামিদের ইচ্ছা হয় বাঁশি বাজানো শেখার। এই উদ্দেশ্যে সে খুঁজে বের করে সুনজিৎ সরকার নামের এক ব্যক্তিকে। তিনি আব্দুল হামিদকে বাঁশি বাজানোর প্রথম পাঠ হিসেবে প্রকৃতির যে নিজস্ব সুর রয়েছে সেটা খুঁজে দেখতে বলে। আব্দুল হামিদ ব্যস্ত হয়ে পড়ে সেই সুর খোঁজার কাজে, সব কিছুতেই সে সুর খুঁজে পায়, এক অজানা আবিষ্কারের নেশার মতো সুর খুঁজতে থাকে সে, পরের দিন পুনরায় সুনজিৎ এর কাছে যায় সে, সুনজিৎ তাকে নিয়ে বের হয় ফরিদপুরের উদ্দেশ্যে, লঞ্চ যাত্রা আরম্ভ হয় তাদের। মাঝ পথে কোনো এক আজানা চরের মধ্যে আব্দুল হামিদ শুনতে পায় এক অদ্ভুত মনভোলা সুর, ঝাঁপ দেয় ভরা নদীতে, তার পর হারিয়ে যায় অতলে। মোটামুটি এই হচ্ছে গল্প। কয়েকটা জায়গায় বেখাপ্পা লেগেছে, গল্পের এক জায়গায় সকাল বেলায় মায়ের ডাকে উঠে খাবার খেতে গিয়ে রোস্ট, মাংস, পোলাও কেন এসে গেলো, বা গল্পের প্রয়োজনে এই বর্ণনার অবতারণা কতোটুকু যুক্তিযুক্ত, তা বোধগম্য হয়নি আমার নিকট। বলার ভঙ্গিমায় নতুনত্বের ছোঁয়া নেই, গতানুগতিক ধারায় এগিয়ে গেছে, আরও যত্ন দাবি করে এই গল্প।
শামীম আরেফীন আমার প্রিয়, কবিতায়, ব্যক্তিত্বে। ইদানীং তার আরেক গুণ উঁকি দিচ্ছে, সে খুব ভালো আঁকিয়ে। তার গল্পের সঙ্গে পরিচয় ছিলো না। বোধ করি এটাই আমার পড়া তার প্রথম গল্প। সে ছবি আঁকে ইজেল, রঙ, তুলি আর কল্পনার মিশেলে। কিন্তু সে শব্দ দিয়েও ছবি আঁকতে পারে! তার গল্প ‘চেরাইকল এবং দুই খণ্ড পৃথিবী’ পড়ে আমি বিস্মিত হয়েছি। একবার নয় কয়েকবার পড়েছি। সম্ভবত এই কুড়িটি গল্পের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বার পড়া এই গল্প। পড়তে পড়তে মনে হয়েছে, আহা, কেন এতো দ্রুত ফুরিয়ে গেলো? মোহ কেটে গেলে যেমন একটা ঝাঁকুনি আসে, তার গল্প পড়া শেষ হলে তেমনই হয়। গল্পের শেষের অংশটুকু হুবহু তুলে দিচ্ছি।
“এমনই এক ছুটির সকালে, বিমলাকে চিন্তিত এবং বিচলিত দেখতে পেলাম। কারণ প্রতিদিনের সেই চড়ুই দুটো সেদিন আর জানালায় আসেনি। এবং প্রায় একই সাথে দেখতে পেলাম, রাস্তার ওপাশে কাঠ চেরাইয়ের ঘরটাতে অনেক মানুষের ভিড়। সবার মধ্যেই যে এক ধরনের চাপা উৎকণ্ঠা, তা দূর থেকেও বুঝতে কষ্ট হলো না। ফলে সেদিন প্রথমবারের মতো রাতের পোশাক পরা অবস্থাতেই বাসা থেকে বেরিয়ে নেমে গেলাম নিচে। এবং রাস্তার পাশে দাঁড়াতেই যে পচা বিদঘুটে দুর্গন্ধ নাকে এসে আছড়ে পড়লো তার সঠিক উৎসমূল নির্ণয়ে খুব বেশি খোঁজাখুঁজির প্রয়োজন হলো না। কেননা, মৃত কুকুরটা রাস্তা থেকে সামান্য দূরেই ছিলো। আর তার ক্ষতবিক্ষত শরীরের উপর নীল অথবা ধূসর রঙের মাছিরা ভনভন করে উড়ছিলো। মৃত কুকুরটার দিকে কয়েকবার থু-থু ফেলে রাস্তা পার হয়ে ওপাশে চলে গেলাম। তারপর মানুষের ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখতে পেলাম দৈত্যাকৃতির সেই লোকটাকে। শুয়ে আছে, অপারেশন থিয়েটারে রাখা লম্বা টেবিলের মতো, চেরাইকলের উপর। তাকে ঘিরে থাকা মানুষেরা দেখছে, তার দেহটা দুই খণ্ড হয়ে চেরাইকলের দুইপাশে ছড়িয়ে আছে। তার কপাল-নাক-চিবুক-গলা এবং বুকের মাঝখান দিয়ে, চিকন হয়ে নেমে যাওয়া নাভি পর্যন্ত ঘন জংলি পশমের দাগ বরাবর, একটা নিষ্ঠুর সরলরেখা এঁকে দিয়ে চেরাইকলের ধারালো দাঁত তাকে সমান ভাবে দুইভাগ করে রেখেছে। একটু গলা বাড়ালেই দেখা যাচ্ছে, মাখনের মতো নরম মগজ, পানের দাগওয়ালা অর্ধের দাঁতের পাটি, ফুসফুস, পেটের মধ্যকার পেচানো নাড়িভুড়ি ইত্যাদি নির্লজ্জের মতো হা করে তাকিয়ে আছে। এমনকি মগজ এবং মাংসের ছিঁড়ে যাওয়া সুক্ষ্ণ কয়েকটা টুকরো ছিটকে ছড়িয়ে আছে চারপাশে। অথচ কোথাও এক ফোঁটা রক্তের চিহ্ন নেই!”
‘চেরাইকল এবং দুই খণ্ড পৃথিবী’ গল্পে খুব কম কথাতে অনেক গূঢ় কথা বলতে সক্ষম হয়েছেন লেখক। কথা সাহিত্যে আরও মনোযোগী হওয়ার অনুরোধ রইল শামীম আরেফীনের প্রতি।
আদিম গল্পটি যেনো এই এখনকার সমাজের এক জ্যান্ত ছবি। আমাদের চারপাশে এমন ঘটনা ঘটে চলেছে অহরহ, বলতে গেলে যেগুলোর কোনটারই বিচার হচ্ছে না। বিচার হচ্ছে না দেখে ভুক্তভোগী মানুষ প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে উঠেছে। তেমনি এক কাহিনী নিয়েই এগিয়ে চলে ‘আদিম’ নামের গল্পটি। সামসুদ্দিনের চোখের সামনেই মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়, এই লজ্জা ঢাকতে ঘটনার কয়েকদিন পরেই গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে সামসুদ্দিনের মেয়ে। মেয়ে হারানোর শোকের চেয়ে নিজের চোখের সামনে মেয়ের ধর্ষিত হওয়ার বেদনা তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় সামসুদ্দিনকে। পিতা হিসেবে এর চেয়ে বেদনাদায়ক দৃশ্য আর একটিও নেই, তাই সামসুদ্দিন সিদ্ধান্ত নেয় চরম প্রতিশোধ নেওয়ার। তারই প্রস্তুতি হিসেবে সে জোগাড় করে একটি ছুরি, যাকে শান দিয়ে চকচকে করে তোলে, নির্ধারিত দিনে ছুরিটি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। ছাব্বিররের দেহ থেকে মাথা আলাদা করার মতো ভয়াবহ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ সামসুদ্দিন। কিন্তু শেষাবধি প্রতিশোধ নেওয়া হয়ে ওঠে না। গতিময় এক গল্প। গল্পকার আবদুল্লাহ আল ইমরানকে ধন্যবাদ, সময়ের দুর্দশাকে নিপুণভাবে আমাদের সামনে উপস্থাপন করার জন্য।
এই সময়ের যেসব লেখকদের লেখা পড়া হয় তাদের মধ্যে সাব্বির জাদিদ অন্যতম, তার লেখা পড়লে একটা ঘোর তৈরি হয়। এই তরুণের সঙ্গে প্রথম পরিচয় বাংলা একাডেমি আয়োজিত পুস্তকমেলা ২০১৭-তে। তার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘একটি শোক সংবাদ’ প্রকাশ উপলক্ষে কুষ্টিয়া থেকে বইমেলায় এসেছেন তিনি, তার ভক্ত-পাঠকদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন, অটোগ্রাফ দিচ্ছেন, বোঝা যায় ভেতরে ভেতরে কিছুটা উত্তেজিত। সেটাই স্বাভাবিক। সেদিন তার সঙ্গে দেখা হয় সেদিন তার বইটা কিনিনি আমি, লেখককে সামনে রেখে বই কেনাতে আপত্তি আছে আমার। লেখক হয়তো ভাবেন চক্ষুলজ্জার কারণে তার বইটা কেনা হচ্ছে। যাহোক কয়েকদিন পরে গিয়ে বইটা কিনি, পড়েও ফেলি— তার গল্প নিয়ে একটা রিভিউ লেখা মাঝপথে আটকে রয়েছে। যাহোক এই আয়োজনের আরকটি ভালো গল্প ‘যে দুঃসংবাদ স্বস্তি বয়ে আনে’ এই গল্পের প্রধান চরিত্র ফরহাদ, বিয়ের তিন চার বছর পরেও বাচ্চা নিতে ভায় পান, অনেকে তার সক্ষমতা নিয়ে তার আড়ালে প্রশ্ন তোলে। আবার স্ত্রী রুবিনার মা হবার প্রবল ইচ্ছাকেও অস্বীকার করতে পারে না ফরহাদ কিন্তু সমসাময়িক সমাজে সন্তান ঠিকমতো পালন করতে না পারা বা সন্তান জন্ম দেওয়ার পর অপঘাতে সন্তানের মৃত্যু কোনোটাই সহজভাবে মেনে নিতে পারে না ফরহাদ আর মেয়ে সন্তান হলে তো কথা নেই, শেষ পর্যন্ত স্ত্রীর পীড়াপীড়িতে হোক আর নিজেকে সক্ষম প্রমাণের জন্যই হোক ফরহাদ এবং রুবিনা সন্তান নেওয়ার মনঃস্থির করে। ফরহাদ কিছুতেই স্বস্তিতে থাকতে পারে না। শেষ পর্যন্ত স্ত্রী যখন মৃত সন্তান প্রসব করে তখন সে একধরনের শান্তির ভেতর দিয়ে নিজের দুর্ভাবনাগুলোকে ধুয়ে ফেলার চেষ্টা করে। গল্পের বক্তব্যের সঙ্গে আমি একমত নই, লেখকের এই গল্প আমাদের কী বার্তা দেবে? একজন লেখকের সমাজের প্রতি দায়ভারের কথা বাদ দিলেও একজন ভাবি পিতা হিসেবে লেখক কী নিজেকে এমন একটা জায়গায় দেখতে চান? মনে হয় না!
‘ঘৃণার গল্প’-তে মুহাম্মদ ফরিদ হাসান এক অস্বস্তিকর সুন্দর অনুভূতির সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন পাঠককে। অল্প বয়সে বাবা মারা যাওয়ার পর পরিবারের অন্য সদস্যরা মিলে রতনুর মায়ের বিয়ে দেন তারই চাচার সঙ্গে, এমন ঘটনা আমাদের সমাজে অহরহ ঘটছে। রতনুর কথা চিন্তা করে রতনুর সৎ পিতা অর্থাৎ তারই চাচা আর কোনো সন্তান নেওয়ার কথা ভাবেননি। রতনুকে নিয়েই তাদের সব চিন্তাভাবনা আবর্তিত। রতনুর চাচার চাওয়া, রতনু অন্তত একবার তাকে পিতা বলে ডাকুক। সন্তানের বাবা ডাক সব পিতার জন্যই অন্যরকমের অনুভূতি বয়ে আনে, অথচ রতনু কিছুতেই বাবা ডাকে তার চাচা মানে সৎ পিতাকে। গল্পটির দুইটি দিক উল্লেখ না করলে নয়, একজন পিতার হাহাকার এবং গল্পের শেষে এসে পিতার জন্য একজন সন্তানের হাহাকার। এই গল্পে মূলত সম্পর্কই মূর্ত হয়ে উঠেছে।
কবি ফারাহ্ সাঈদ এক আলাপচারিতায় বলেছেন, গল্পের খাতিরে তিনি কবিতা ছেড়ে দিতে প্রস্তুত। তার গল্প পড়লে এর প্রাসঙ্গিকতা খুব সহজেই অনুমেয়। ‘গিলরয়’ গল্প পাঠের শুরুতেই পাঠক এমন এক ভাষাবন্ধনীতে আটকে যাবেন যে, তা থেকে বের হওয়া প্রায় অসম্ভব। ছোট ছোট বাক্যে গল্প এগিয়ে গেছে, অমসৃণ অথচ অসম্ভব দৃষ্টিনন্দন আঁকাবাঁকা গ্রাম্য পথ যেনো! ‘গিলরয়’ প্রেমের গল্প, বিরহেরও, আসলে প্রেমে বিরহ না আসলে বোঝা যায় না সেটা প্রেম ছিলো না অন্য কিছু। অনেক অনেক অপেক্ষার পেরিয়ে সুমনা আসে, সুমনা হারিয়েও যায়।
‘প্রেম অপ্রেমের কাব্য’ নাহিদা নাহিদের গল্প। মূলত তিনটে চরিত্রের হাত ধরে এগিয়ে গেছে গল্পটি, যার কেন্দ্রে খুকী। মূলত একজন পোস্টমেনোপোজাল নারী তার যৌন জীবনের অতীত-বর্তমানের হিসাব, অন্য নারীর প্রতি স্বামীর আসক্তি— যেনো চিরপরিচিত ঘটনার পুনঃমঞ্চায়ন। স্থূল বর্ণনার কারণে শেষাবধি গল্পে মনোযোগ ধরে রাখা মুশকিল।
“অফিসের নিচে দাঁড়িয়ে আছি—গ্যারেজে, শেষ দু’ঘন্টা ধরে অবিরাম ঝরছে বিদায়ী ফাগুনের বৃষ্টি; সঙ্গে ছাতা নেই। আবাসিক এলাকার অক্ষত কালচে সড়কে গোড়ালিডুবো স্রোতধারা, মেঘের ডাকে খুব মাপা বিরতি। পিঠে ঝুলন্ত সপ্তাখানেক আগে কেনা নকল চামড়ার ব্যাগ—জলে ভিজে ওটা নষ্ট হবে ভাবতেই বিরক্ত লাগছে। যদিও নিজের কাছে বিষয়টা আড়াল করতে চাইলাম বৃষ্টিতে ঠাণ্ডা লাগতে পারে, কোনো গাড়ি সাই করে পাশ কাটালে ময়লা জলে অনাকাঙ্ক্ষিত গোসল হয়ে যেতে পারে এইসব অকেজো ভাবনায়। সহকর্মী এহসান ততোক্ষণে রাস্তায় নেমেছে, ওর বাসায় ফিরবার এতো তাড়া কেন তাও কিছুক্ষণ চিন্তা করলাম—খিদে পেল কি? পেতেই পারে, আনুমানিক রাত সাড়ে দশটার মতো বাজবে এখন। এই আসছে গোটা বর্ষাকালে এমন হবে, যে যার মতো ঘরে ফিরবে—কেউ রিকশা ডাকবে, কেউ কোনো ছাতাধারী পথচারীকে ডেকে মুহূর্তের সঙ্গ নেবে নইলে বৃষ্টিতে দুদ্দাড় নেমে যাবে স্বর্দি-কাশির তোয়াক্কা পিছে ফেলে। ”
‘যেভাবে এহসানের ট্রেন বিষয়ক গল্পে ঢুকে পড়ি’, এনামুল রেজার গল্প- নামকরণের চমৎকারিত্ব, সঙ্গে গল্প বলার ঢং। আধুনিক গল্পের প্রায় সবগুলো উপাদানে ভরপুর একটি গল্প।
মাহমুদ নোমানের গল্প ‘সেকেন্ডহ্যান্ড’। পরকীয়ার কাহিনী। মানছুরার অপছন্দের মানুষের সঙ্গে বিয়ে হয়, স্বামী প্রবাসী। স্বামীর অনুপস্থিতিতে সে জড়িয়ে যায় অবৈধ সম্পর্কে, স্বেচ্ছায়। মানছুরার সন্তান মাশুককে ফেলে চলে যায় মানছুরা। গতানুগতিক। আরও ভালো গল্পের প্রত্যাশা থাকলো নোমানের কাছে।
‘হাতঘড়ি’ সালাহ উদ্দিন মাহমুদের গল্প। গতানুগতিক গল্প। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি নিয়ে গল্প এগিয়ে গেছে। গল্প নিয়ে আরও কাজ করার আহ্বান রইল সালাহ উদ্দিন মাহমুদের প্রতি।
‘পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন’ সময়ের প্রতিশ্রুতিশীল কথা সাহিত্যিক মাসউদ আহমাদের এই গল্পটি এ নিয়ে তিনবার পড়া হলো। প্রতিবারই জীবনানন্দকে নতুন করে আবিষ্কার করার মধ্যে দিয়ে গল্প এগিয়ে গেছে। এমন গল্প আরও লেখা হোক, ইতিহাস থেকে উঠে আসুক গল্প, গল্পের মাধ্যমে মানুষ জানুক ইতিহাস।
কিঙ্কর আহ্সানের গল্প ‘খুচরো আলাপ’ পড়তে পড়তে মনে হয়েছে আধুনিক গল্প মনে হয় এমনই হওয়া উচিৎ। প্রায় প্রতিটি পঙক্তিতেই গল্প। বাংলা সাহিত্যের গল্পে যে আলাদা একটা যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে কিঙ্করের গল্প পড়ে তেমনটাই মনে হয়েছে।
গল্পও তো এক ধরনের উপলব্ধি! গল্প বা উপলব্ধি যা বলি না কেন, শাফিনূর শাফিনের লেখা গল্প আমাদের চমকে দেয়, গল্প মানে তার গল্পের বিষয় নির্বাচন। বর্তমান সময়ের আলোচিত কবি ইমতিয়াজ মাহমুদের একটি কবিতার একটি চরিত্রকে তিনি বেছে নিয়েছেন গল্পের বিষয়বস্তু হিসেবে যা পাঠক হিসেবে আমাদের চমৎকৃত করে। শাফিনূরের গল্প পড়ছি না ইমতিয়াজের কবিতা পড়ছি তা ঠাহর করে উঠতে উঠতেই গল্প শেষ। শাফিনূরের আরেকটি বড় গুণ পরিমিতিবোধ। কোনো বাক্য গঠনে শব্দ চয়নে তার জুড়ি মেলা ভার। এটি যেমন তার কবিতার ক্ষেত্রে তেমনি গল্পের ক্ষেত্রেও। তার লেখা আরও দুই একটা গল্প পড়ার সুযোগ হয়েছে আমার। আশা করি তিনি কবিতার সমান্তরালে কথাসাহিত্যেও সমান মনোযোগী হবেন।
জব্বার আল নাঈম, রাসেল রায়হান, মাহবুব ময়ূখ রিশাদ, নাদিরা মুসতারী, আবু উবায়দাহ তামিম— তাদের গল্প বরাবর আমাকে মুগ্ধ করে। তাদের গল্প নিয়ে আসলে খুব বেশি কিছু বলার নেই। সর্বোপরি বাংলানিউজ২৪.কম এবং এর সাহিত্য সম্পাদক শুভ্রনীল সাগরকে অসংখ্য ধন্যবাদ এমন একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ নেওয়ার জন্য।
আরও পড়ুন
বাঁশি | হুমায়ূন শফিক
হাতঘড়ি | সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
যে দুঃসংবাদ স্বস্তি বয়ে আনে | সাব্বির জাদিদ
চেরাইকল এবং দুই খণ্ড পৃথিবী | শামীম আরেফীন
অমরাবতী | রাসেল রায়হান
হারুন | শাফিনূর শাফিন
ঘৃণার গল্প | মুহাম্মদ ফরিদ হাসান
লাইক শেয়ার কমেন্ট | মাহবুব ময়ূখ রিশাদ
সেকেন্ডহ্যান্ড | মাহমুদ নোমান
পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন | মাসউদ আহমাদ
গিলরয় | ফারাহ্ সাঈদ
ঘর | নুসরাত নীলা
প্রেম-অপ্রেমের কাব্য | নাহিদা নাহিদ
জীবনের ছুটি নেই । জব্বার আল নাঈম
বোবা সুখ | নাদিরা মুসতারী
খুচরো আলাপ | কিঙ্কর আহ্সান
যেভাবে এহসানের ট্রেন বিষয়ক গল্পে ঢুকে পড়ি | এনামুল রেজা
যেভাবে অনিকেতের মৃত্যু হয়েছিল | আবু উবায়দাহ তামিম
আদিম | আবদুল্লাহ আল ইমরান
টান । আকাশ মামুন
এই সময়ের এক কুড়ি গল্প পড়ুন বাংলানিউজে
বাংলাদেশ সময়: ১৭১৮ ঘণ্টা, আগস্ট ২৩, ২০১৭
এসএনএস