বিংশ শতাব্দীর একজন খ্যাতনামা সাহিত্যিক হিসেবে তিনি পেয়েছেন পদ্মভূষণ, রবীন্দ্র পুরস্কার, সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার, জ্ঞানপীঠ পুরস্কারসহ একাধিক স্বীকৃতি। ১৯৭১ সালে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করা এই প্রথিতযশা সাহিত্যিকের ৪৬তম মৃত্যুবার্ষিকী ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭।
“সাহিত্যসেবার পথেই দেশের সেবা। ”— এই ব্রত নিয়েই বাংলা সাহিত্যে আবির্ভূত হয়েছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ)। জমিদার বংশীয় হলেও সারাজীবন কাটিয়েছেন সাধারণ মানুষদের মাঝে। ঘুরে বেড়িয়েছেন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। খুঁজেছেন সাধারণ মানুষদের জীবনযাত্রার বৈশিষ্ট্য, তাদের আঁতের কথা। লেখকের ভাষায়, “মদ গাঁজাটা খাই না-কিন্তু তারও চেয়ে কোন একটা তীব্রতর নেশায় মেতে থাকি, ঘুরে বেড়াই”। তারাশঙ্করের এই ঘুরে বেড়ানো অহেতুক ছিলো না। এই পথে-প্রান্তরের অভিজ্ঞতালব্ধ চিত্রপটগুলোই তিনি তুলে ধরেছেন তার কথাসাহিত্যে। যার ফলে সেগুলো হয়ে উঠেছে অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষের এক-একটি কাব্যগাথা। আর সেই কাব্যগাথাগুলোর উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে তার রচিত ‘কবি’ উপন্যাস।
১৯৪৩ (মতান্তরে ১৯৪৪) সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত ‘কবি’ উপন্যাস ছিলো এর দু’বছর পূর্বে প্রবাসী মাসিকপত্রে প্রকাশিত তারাশঙ্করের একটি ছোটগল্পের বিস্তৃত রূপ। তাই সঙ্গত কারণেই ছোটগল্পের চরিত্র ও ঘটনাপ্রবাহগুলো উপন্যাসে এসে আরও প্রস্ফুটিত ও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
তারাশঙ্করের লেখায় বিশেষভাবে পাওয়া যায় বীরভূম-র্বধমান অঞ্চলের সাঁওতাল, বাগদি, বোষ্টম, বাউরি, ডোম, গ্রাম্য কবিয়াল সম্প্রদায়ের কথা। কবি উপন্যাসেও অন্ত্যজ শ্রেণির এমনই একজন কবিয়ালের কথা উপজীব্য হয়ে উঠেছে।
উপন্যাসটিতে নিম্নবর্গের দুধর্ষ ডাকাত বংশীয় একজন মানুষের কবি হয়ে ওঠার রোমাঞ্চকর ও চিত্তাকর্ষক কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। কেন্দ্রীয় চরিত্র নিতাইচরণের কবিপ্রতিভা এবং প্রণয়-আবেগ উপন্যাসটিকে পাঠকপ্রয়িতার শীর্ষে পৌঁছিয়েছে। বারবার বেদনাময় পরিণতি নিতাইয়ের জীবনে বয়ে এনেছে অতল-অনশ্চিয়তা। একইসঙ্গে নিতাইয়ের জীবনে সেই বাকগুলো বিচক্ষণ পাঠকের মনে নানান প্রশ্নেরও জন্ম দিয়েছে।
ডাকাত বংশে জন্ম নেওয়া নিতাইয়ের ছিলো কবিগান শোনার নেশা। বিভিন্ন আসরে ওই গান শুনেই তার সত্তার উর্বর জমিনে কবিত্ব প্রতিভার সৃষ্টি হয়। অনেকটা ‘গোবরে পদ্মফুল’র মতোই অবস্থা ছিলো নিতাইয়ের। কবি প্রতিভাকে নিতাই স্রষ্টাপ্রদত্ত অলৌকিক এক জ্ঞান মনে করেছিল। তাই সে সৎভাবে সেই প্রতিভার বিকাশে পিতৃভিটা ছেড়ে স্টেশনে চলে যায়। ওখানে তার বন্ধু রাজা (স্টেশনের পয়েন্টসম্যান) নিতাইকে ‘উস্তাদ’ সম্বোধন করে তার থাকার বন্দোবস্ত করে দেয়। ইতোমধ্যেই বিভিন্ন স্থানে গিয়ে নিতাই কবিগান করে এসেছে। ফলে ‘কবি’ হিসেবে তার নাম ঈষৎভাবে ছড়াতে থাকে।
এসময় রাজার শ্যালিকা ঠাকুরঝির সঙ্গে নিতাইয়ের পরিচয় ঘটে। সে ছিলো পাশের গ্রামের বধূ। এই গ্রামে সে দুধের যোগান দিত। কৃষ্ণবর্ণ, দ্রুতহাসিনী, ছিপছিপে গড়নের মিষ্টি-মেয়ে ঠাকুরঝির “দেহখানাই শুধু লতার মত নয়, মনও যেন তাহার দীঘল দেহের অনুরূপ”। নিতাইয়ের চোখে সে “কালো কেশে রাঙা কুসুম হেরেছ কি নয়নে?” নিতাইয়ের গানের নীরব ভক্ত সে। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা দু’জনের এই প্রেমের সম্পর্কে বাধা হয়ে দাঁড়ায় সমাজ। ঠাকুরঝি বিবাহিত এবং স্বামীর সংসারে সে আদরণীয়া। তাই নিতাই নিজ থেকেই ঠাকুরঝিকে ছেড়ে চলে যায়। নিতাইয়ের চলে যাওয়ার মুহূর্তে বন্ধুবর রাজন যখন তার শ্যালিকার বিয়ে নিতাইয়ের সঙ্গে দিতে উদ্যত হয় তখন নিতাই বলে, “মানুষের ঘর কি ভেঙ্গে দিতে আছে রাজন? ছি!” একবুক বেদনা ও সহজ সরল ঠাকুরঝিকে মনের গহীনকোণে সঙ্গী করে নিয়েই নিতাই বসন্তের ডাকে ঝুমুর দলে পাড়ি জমায়। ঠাকুরঝির প্রতি তার ভালোবাসা প্রকাশ পায় এভাবে-
“চাঁদ তুমি আকাশে থাকো আমি তোমায় দেখবো খালি।
ছুঁতে তোমায় চায়নাকো হে চাঁদ, তোমার সোনার অঙ্গে লাগবে কালি। ”
ঝুমুরদলের সঙ্গে নিতাই যুক্ত হয় মূলত বসন্তের জন্যই। বসন্তের সদা হাস্যোজ্জ্বল ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিতাইকে বিদ্ধ করে প্রেম-বাণে। বসন্তের মধ্যে নিতাই ঠাকুরঝির ছায়া দেখতে পায়। তাইতো বসন্তের পেশা কদাকার হলেও নিতাই সেই দলেই ঝুঁকে পড়ে। নিতাইয়ের কবিতায়-
“বঙ্কিমবিহারী হরি বাঁকা তোমার মন,
কুটিল কৌতুকে তুমি হয়কে কর নয়, অঘটন কর সংঘটন। ”
বসন্তের আহ্বানেই ভদ্র-বিনয়ী নিতাই ঝুমুর দলের সঙ্গে যোগ দেয়। অশ্লীল গান-বাজনা এবং গানের সঙ্গে নারীদের অশ্লীল নৃত্য ছিলো এই ঝুমুরদলের কাজ। এর আড়ালে রাতের অন্ধকারে তারা হয়ে যায় দেহাপজীবিনী। কদাচারী এই ঝুমুর দলে নিতাই ক্রমশ তার নিজের ভিতরকার কবিয়ালের সত্ত্বাকে চেপে রেখে দলের চাহিদা অনুযায়ী গান রচনা ও পরিবেশনা করে চলে। নিতাইয়ের উপস্থিত বিচক্ষণতা ও কবি প্রতিভার মাধ্যমে সে এখানেও জনপ্রিয়তা লাভ করে।
দেহ ব্যবসায় জড়িত থাকার ফলে মরণব্যধিতে আক্রান্ত হয় বসন্ত। ঝুমুরদল তথা দেহোপজীবিনীদের কাছে এটা সাধারণ বিষয়। এ রোগেই পরবর্তীতে মারা যায় বসন্ত। ফলে ঝুমুরদল ছেড়ে দেয় নিতাই। পরকীয়া বা দেহব্যবসাকে নিতাই ঘৃণা করলেও বসন্ত ছিলো তার কাছে পবিত্র। গিরিশৃঙ্গের ঝরনার মতো নিতাইয়ের কাছে তার পবিত্রতা। যেখানে কোনো ধরনের পাপ-পঙ্কিলতা আটকে থাকে না। বসন্তের সেই ফল্গুধারার মধ্যে নিতাই খুঁজে পেয়েছিল আবহমান বাংলার এক শাশ্বত নারী প্রতিকৃতি। তাইতো আত্মপরিচয় ভুলে সে বসন্তকে বাঁচিয়ে তুলতে চেয়েছিল। কিন্তু বিধি এদিক দিয়ে তার বামে অবস্থান নিয়েছিলেন। ফলে ঠাকুরঝির ন্যায় বসন্তকেও হারাতে হয় তার।
ছোটকাল থেকেই নিজ সমাজ সংসার থেকে আলাদা থাকতে চেয়েছে নিতাই। বাপ-দাদার পেশা ডাকাতিকে সে মনেপ্রাণে ঘৃণা করেছে। তার মনে ছিলো জীবনের প্রকৃত সাধ, তৃষ্ণা আহরণ। সেটি করতে গিয়েই সে খোঁজ পেয়েছে কবিগানের। হয়ে উঠতে চেয়েছে একজন কবিয়াল। ঠাকুরঝির মধ্যে তার কবি প্রতিভার প্রতি শ্রদ্ধা দেখতে পেয়ে তার প্রতি আকৃষ্ট হয় সে। পরবর্তীতে তার সেই আকৃষ্টতার পতন ঘটে সমাজ-সংসারের বিরুদ্ধাচরণ করতে না পেরে। নিতাই আশ্রয় চায় বসন্তের কাছে। সেখানে গিয়ে সে তার সমাজ-সংসার ত্যাগ করে। তারপরেও সে যখন বসন্তকে হারায় তখন তার পুরো জগৎ-সংসার ছোট হয়ে যায়। দুনিয়া তার কাছে তুচ্ছ হয়ে উঠে। তাইতো সে গেয়ে ওঠে-
“এই খেদ মোর মনে মনে,
ভালবেসে মিটল না আশ-কুলাল না এ জীবনে।
হায়! জীবন এত ছোট কেনে!
এ ভুবনে?''
মানব প্রেমের ব্যর্থতা নিতাইকে হতবিহ্বল করে দেয়। বিফল মনোরথে সে কাশী যাত্রা করে। কিন্তু সেখানকার পরিবেশ তার অনুকূলে ছিলো না। তার ইচ্ছা ছিলো কাশীতে গিয়ে গান-কবিতা গেয়ে সেখানেই নিজের ঠাঁই করে নেবে। বাকি জীবন পার করে দেবে এভাবেই। কিন্তু নিতাইয়ের কবিয়ালী গান কাশীর মানুষদের মনঃপুত হয়নি। তখন তার প্রথম জীবনের বন্ধু রাজন, বিপ্রপদ ঠাকুর, ঠাকুরঝির কথা মনে পড়ে গেলো। তার মনে হচ্ছিল এই গান শোনেই তো তারা আমার ভূয়সী প্রশংসায় মেতেছিল। কাশীর চেয়ে বরং আমার গ্রামই ভালো— এই মনে করে নিতাই শেকড়ের টান অনুভব করলো। তার কবিতায়-
“তোর সাড়া না পেলে পরে মা, কিছুতে যে মন ভরে না।
চোখের পাতায় ঘুম ধরে না, ব’য়ে যায় মা জলের ধারা। ”
নিতাই ফিরে এলো। ফিরে এলো তার ঠাকুরঝির জন্য। কিন্তু বিধি বাম! নিতাইয়ের বিরহে ঠাকুরঝি সেই যে রোগাক্রান্ত হয়েছিল তা থেকে মৃত্যুদূত আর রেহাই দেয়নি তাকে। নিতাইয়ের জন্য পাগল হয়ে ঠাকুরঝি মরে গেছে-ভাবতেই নিতাইয়ের আবারও জীবনকে ছোট জ্ঞান হলো। নিতাইয়ের সামনে তখন কৃষ্ণচূড়া গাছ, যে গাছে মিশে আছে একই সঙ্গে তার, ঠাকুরঝি এবং বসন্তের স্মৃতি। এক মুহূর্তের জন্য তার মনে হলো- না, তারা দু’জনেই বেঁচে আছে। মিশে একাকার হয়ে আছে এই কৃষ্ণচূড়া গাছে, নিতাইয়ের স্মৃতিতে।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, “অলৌকিক আনন্দের ভার বিধাতা যাহারে দেন, তাহার বক্ষে বেদনা অপার”। নিতাইয়ের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। আপন বংশবিরুদ্ধ চরিত্র নিতাই তার কবি খ্যাতি নিয়ে সবসময় উচ্চাশা করেছিল। কিন্তু নিতাইয়ের স্বভাবসুলভতা, বিবেক, আত্মপরিচয় ও পরিপার্শ্বিক সমাজ তার সেই স্বপ্ন পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ফলে তার কবিভাবনা আটকে থাকে পরিপার্শ্বিকতার জালেই।
বাংলা সাহিত্যে কবির জীবনকে মূল উপজীব্য করে লেখা উপন্যাস এ পর্যন্ত (সম্ভবত) তিনটি। তারাশঙ্করের কবি, হুমায়ুন আহমেদের কবি এবং হুমায়ুন আজাদের কবি অথবা দণ্ডিত অপুরুষ। তবে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত কবি যে পরিমাণ পাঠকপ্রিয়তা ও আলোচনার জন্ম দিয়েছে তার ধারে-কাছেও যেতে পারেনি অন্যগুলো। এর মূল কারণ, উপন্যাসের প্রথম থেকে শেষ অবধি লেখকের গল্প বলার অসাধারণ এক চুম্বকীয় শক্তি যা পাঠককে টেনে নিয়েছে গল্পের শেষ দৃশ্য পর্যন্ত। তাই আমার মনে হয়, বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলোর একটা তালিকা করলে তার মধ্যে প্রথমদিকেই তারাশঙ্করের কবিকে রাখতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১১১৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৭
এসএনএস