কোনো এক শাড়ির বিজ্ঞাপনে আমরা শুনতাম, ‘ছোট্ট টিপ, হালকা লিপস্টিক আর শাড়ি’— অতএব শাড়ি যে কী অদ্ভুত রহস্য ঘনীভূত করতে পারে তা বলে শেষ করা যাবে না। রহস্যের কথায় মনে এলো, আচ্ছা ভাবুন তো— ছোট থেকে যে ভৌতিক গল্প আমরা শুনেছি, তার ক্লাইম্যাক্স কী সাদা শাড়ি ছাড়া পূর্ণ হতে পারে! যতো আধুনিক হই না কেন, যতো বিদেশি জামা-কাপড় পরিনা কেন, অষ্টমীর অঞ্জলিতে সব মেয়েরা কিন্তু শাড়িকেই টেনে ধরি।
মেসোপটেমিয়ার সভ্যতা থেকে শাড়ি প্রথম ভারতীয়দের কাছে আসে। শাড়ি আসলে একটি ক্যানভাস যেখানে শিল্পীরা তাদের মননের ভাব বিভিন্ন কারুকাজ দিয়ে ফুটিয়ে তুলতেন। সিন্ধু সভ্যতার প্রারম্ভে নারী ও পুরুষ উভয়েই দীর্ঘ সুতি বস্ত্র পরতেন। নতুন গবেষণায় অবশ্য বলা হয়, মিশর, সুমেরিয়ানরা বহু আগেই সুতি বস্ত্র ব্যবহার করেছেন এবং যখন আর্যরা উত্তর ভারতীয় মহাসাগরের নিকটস্থ সমতলে চলে আসেন তারা ‘বস্ত্র (vastra)’ শব্দটিকে নিয়ে আসেন। এইসময়ে মেয়েরা বিশেষত কোমরে জড়িয়ে আটকানো এক বস্ত্র ব্যবহার করতে শুরু করে যা নিভি (neevi) নামে পরিচিত। এরপর ধীরে ধীরে চোলির ব্যবহার শুরু হয় এবং এই নিভি আর চোলি সাধারণত ভেষজ রং দিয়ে বানানো হতো। এরপর গ্রিস আর পারস্যের প্রভাব এখানে পড়তে শুরু করে। তারা বেল্ট জাতীয় জিনিসের ব্যবহার শুরু করে এবং একে সাদৃশ্য দিতেই রাজপুত ঘরানার মেয়েরা উপরের অংশে জ্যাকেট জাতীয় বস্ত্র ব্যবহার করতে শুরু করে, মথুরা ও অজন্তা গুহাচিত্র দেখলে এই প্রসঙ্গের কিছু হদিশ মেলে। এরপর যে ওড়নার আবির্ভাব শুরু হয় ক্রমশ এর থেকেই শাড়ি এগোতে থাকে। মুঘল আমলে এই বস্ত্রকে বিশেষ উপযোগী করে তোলার জন্য প্রকরণ আসতে থাকে। এরপর ডিজাইন, রং ইত্যাদির বিভিন্ন আগমন— ফলস্বরূপ একে ঘিরে বাণিজ্যের রমরমা শুরু হয়। ‘বিয়েতে একান্নটা শাড়ি পেয়েছিল মেয়েটা’ কবি সুবোধ সরকারের লেখা কবিতার লাইন। শাড়ি যে কীভাবে একটা জীবনে আনাচ-কানাচ বুঝিয়ে দিতে পারে একটি মেয়ের, কবিতাটি পড়লে বোঝা যায়! সিন্ধু সভ্যতার ২৮০০ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টপূর্বে প্রথম সুতির চাষ হয়। শাড়ির বিষয়টি তিন ভাগে বিভক্ত ছিলো— এক অন্তরীয় নিচের অংশের বস্ত্র- উত্তরীয়, ওপরের অংশের বস্ত্র এবং বক্ষবন্ধনী বা স্তনপাট্টা। প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে বাণভট্টের লেখায় এবং প্রাচীন তামিল কবিতায় মেয়েদের শাড়ি নিয়ে কথা আছে। ধীরে ধীরে এই নিচের অংশ ঘাগরা বা লেহেঙ্গা, উপরের অংশ দুপাট্টা বা ঘুংঘট আর বক্ষবন্ধনী চোলিতে রূপান্তরিত হয়।
নেপালের শাড়ির পরিধান রীতি ‘হাকু পাতাসি’ নামে পরিচিত। আর বাংলাদেশ তো শাড়ির বৈচিত্র্য ও ব্যবহারে বিশ্বকে মাতিয়ে রাখে মসলিন ও জামদানিতে। মায়ানমার, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইনস, এইসমস্ত জায়গায় ব্যবহারভেদে শাড়ি জনপ্রিয়! এই তো আমাদের চেনার আয়ত্তে শাড়ির ব্যবহার কিন্তু সত্যি বিস্ময়কর যখন শাড়ি কী জিনিস সেটা ঠিক জানেনও না, সেই বিদেশিঅভিনেত্রীরা শাড়ির সংস্পর্শে এসে ভক্ত হয়ে গেছেন। হলিউডের লেডি গাগা, পামেলা অ্যান্ডারসন, এলিজাবেথ হারলেদের শাড়িতে দেখে দেশীয় ঐতিহ্য সম্পর্কে গর্ব হয় বৈকি! বাংলাদেশের জনপ্রিয় শাড়িগুলি হলো- জামদানি, ঢাকাই বেনারসি, রাজশাহী রেশমী ও সিল্ক শাড়ি, টাঙ্গাইলের তাঁত, কাতান শাড়ি ইত্যাদি। ভারতে বাঁধনি, চিকন, বেনারসি, কাঁথা, শান্তিপুরী তাঁত, চান্দেরি, লুগাদে, ইক্কাত, বোমকাই, মাইসোর রেশম, মঙ্গলগিরি, বলরামপূরম ইত্যাদি জনপ্রিয়। পাকিস্তানের মোহাজিররা অবশ্য শাড়ির ব্যবহার বজায় রেখেছেন। ভারতের মধ্যপ্রদেশের চান্দেরি এলাকায় এই চান্দেরি শাড়ি তৈরি হয়।
বৈদিক ভাবনায় শিশুপালের দ্বারাই চান্দেরি প্রবর্তিত বলে মানা হয়। আরানি রেশম বলে তামিলনাড়ুর আরানি অঞ্চলে এক প্রকার শাড়ি পাওয়া যায়। অদ্ভুত এই শাড়ির দুই দিকে আঁচল থাকে ফলে শাড়ির অভিনবত্বই আলাদা! বাংলার আরও এক ঐতিহ্যপূর্ণ শাড়ি হলো শান্তিপুরী শাড়ি। অদ্বৈতমঙ্গলে এর কথা আছে। পঞ্চাদশ শতকের রাজা গণেশের সময় এর আগমন হয়। সেইসময় চৈতন্যদেবের দীক্ষায় প্রাণিত হয়ে অধুনা বাংলাদেশের ধামরাই থেকে একটি অংশ নবদ্বীপে আসে। শান্তিপুরে তারা তাঁত চালিয়ে জীবন নির্বাহ করতে শুরু করে। সেই থেকে শান্তিপুরী শাড়ি। এবার আসা যাক সেই বিশ্ববিখ্যাত মসলিন শাড়ির প্রসঙ্গে কিন্তু দুর্ভাগ্য তার উত্তরসূরী জামদানি ছাড়া আমাদের এগোনোর পথ নেই। আমার প্রিয় এক বিশিষ্ট কবি আমায় বলেছিলেন, যা কিছু মূল্যবান, সম্পদের মতো এবং বিরল, সমাজে তা প্রকাশ পেলেই তাকে রক্ষার চেয়ে লুণ্ঠন করার প্রবণতা বেড়ে যায়! মসলিনও তাই। যে মসলিন বয়নে কম করে ৩০০ কাউন্টের সুতো লাগে,সেখানে জামদানিতে লাগে ৮০ কাউন্টের। ঢাকা হলো জামদানির কেন্দ্রস্থান! মনে করা হয়, জামদানি শব্দটি ফারসি ভাষা থেকে এসেছে। জাম মানে উন্নত মদ, দানি মানে পেয়ালা। জাম পরিবেশনকারী ইরানী সাকীর পরনের মসলিন থেকে জামদানি নামের উৎপত্তি ঘটেছে। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে এর কথা আছে। ভূ-বিদ সোলায়মান ‘রুমি রাজ্যে’ সুতি বস্ত্রের কথা উল্লেখ করেছেন। এই রুমি রাজ্যই বাংলাদেশ বলে মনে করা হয়! ফলে ইংরেজদের নজর পড়ে এই দিকে। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব জামদানি ব্যবহার করতেন।
ঢাকা জেলার তিতাবাড়ি, ধামরাই, বাজিতপুর মসলিনের জন্য বিখ্যাত ছিলো, তবে ঢাকাই মসলিনের স্বর্ণযুগ ছিলো মুঘল আমল। দারোগা-ই-মলমল নামে রাজ-কর্মচারী এইসব তদারকি করতেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অবিভক্ত বাংলায় সুকৌশলে নির্যাতন শুরু করে। ১৭৮৭ সালে প্রায় ৮০ লাখ টাকার জামদানি ইংল্যান্ডে যায়। এইভাবে মূল্যবান জামদানিকে শোষণ করার চেষ্টা চলে, এরপর শিল্পবিপ্লব শুরু হলে মসলিনের হ্রাস পাওয়া ত্বরান্বিত হয়!
আসলে শাড়ি হলো নারীর কাছে মুক্ত বেষ্টনী বা বন্ধনের মুক্তি। একটা গঠন যা প্রকৃতিকে নিয়ে প্রকৃতির মধ্যে মোহময় করে তোলে। বিমান সেবিকারা শাড়িকে প্রাধান্য দিয়ে এই জায়গাটি আরও দৃঢ় করেছেন। শাড়ি নিজে আসলে একটা ছবির রাজ্য— একটা শিল্পজগতের মধ্যে দেহকে ধারণ করে হয়তো বা জীবনেরই কবিতা বোঝায়! শাড়ি- প্রেম, রান্নাঘরের মশলা, শিশুর কান্না, ঘোমটার লজ্জা, ফ্যাশনের বার্তা, অপমানের দাগ সব বহন করতে পারে! সে নিজেই আসলে যাপনের আক্ষরিক যুগ বহন করে পুরনো বাড়ির দেয়ালের মতো। এই আঁচল শিশুর মুখ মুছিয়ে দেয়, এই আঁচল চোখের জল মুছিয়ে আনে, এই আঁচলের গন্ধে মা তীব্র হয়ে আসে, এখানে এলেই ঘুম আসে পৃথিবীর প্রতিটি সন্তানের, প্রেমিকার প্রথম শাড়ি নিয়ে তরুণ যুবকের কবিতা লেখা হয়। তবু এই শাড়ির আঁচলে আগুন, আঁচলের অপমান, আঁচলের ফাঁসে গলায় দাগ— মেয়েরা তবু শাড়ি জড়িয়ে রাখে গায়ে, বোধহয় ক্ষমা করা আর মমতার অন্তহীন ক্যানভাস এখানেই বোনা যায়। কৃষ্ণের দানে দ্রৌপদীর সমাপ্তিহীন শাড়িরা বোধহয় জানে, শাড়ি আসলে জীবনেরই রূপকথা!
বাংলাদেশ সময়: ১২২৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৭
এসএনএস