প্রফুল্ল রায় হলেন সেই ঔপন্যাসিক, স্বয়ং সত্যজিৎ রায় যার ওই ‘রামচরিত্র’ উপন্যাসটি নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করার কথা ভেবেছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন এজাজ ইউসুফী। যদিও সত্যজিৎ লোকান্তরিত হওয়ার এতো বছর পর ভারতে বা পশ্চিমবঙ্গে এমন ভাবনা আর কেউ ভেবেছেন বলে শোনা যায়নি।
অবশ্য এতে উপন্যাসটির গুরুত্বের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে না। কারণ, ঢাকার বিক্রমপুরে জন্মগ্রহণকারী ঔপন্যাসিক প্রফুল্ল রায় (১১ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪) ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভক্তির সময় কলকাতা চলে যান। তিনি সারা ভারত পরিভ্রমণ করে নিম্নবর্গীয় বা দলিত/অচ্ছুৎ মানুষ এবং আদিবাসীদের জীবন-যাত্রা প্রত্যক্ষ করেন। তিরাশি বছরের জীবনে পরিণত হন বিশিষ্ট কথাকার ও পর্যবেক্ষকে। মানুষের আত্মিক সংকট, ধর্মীয় মূল্যবোধ, আচার-আচরণ, রিচ্যুয়াল, সাম্প্রদায়িকতার নগ্নরূপ, জাত-পাত, ভেদাভেদ, রাজনীতির খলতা ও নৃশংসতা সরাসরি অবলোকনে রচিত উপন্যাস ‘রামচরিত্র’-এ তিনি ব্যক্তি নয়, সমকালীন সমাজের অন্ধকারাচ্ছন্নতার অদেখা ছবিটিকেই সাধারণ পাঠকের জন্য এঁকেছেন।
পৌরাণিক চরিত্র রামচন্দ্র নয়, উপন্যাসের নায়ক ভারতের এক ক্ষত-বিদীর্ণ সমাজবাসীর জনপদ লখিনপুরা টাউনের রামচরিত চৌবে। তাকে কেন্দ্র করে কাহিনীর নানা স্তরে বেশ্যার দালাল চৌপটলাল, রেণ্ডিটুলির মাসি মাদারীসহ একাধিক চরিত্রের সমাবেশ ঘটে, যারা সমাজের আলো ও অন্ধকারের বাসিন্দা। দিনের শুদ্ধতা ও রাতের ঘোরতর ভ্রষ্টাচারকে মথিত করে পঙ্কিল পথ বেয়ে রাজনীতি কিভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে প্রবাহিত হয়, উপন্যাসটি সে বিবরণই দিয়েছে। স্খলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির পতিত ব্যবহারিক রূপটিকেই ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছে আখ্যানের নানা বাঁকে।
কেতাবি কথায় রাজনীতির মূল স্তম্ভ জনগণ নামক সত্তাটি বাস্তবে কতোটুকু সংকট ও ষড়যন্ত্রের শিকারের বস্তু হয়, উত্তর ভারতের ক্ষমতা কাঠামোর অন্ধি-সন্ধি ঘেঁটে কাহিনীতে সেটিই দেখানো হয়েছে।
এজাজ ইউসুফী সে উপন্যাসটিরই তাবৎ কাহিনী, চরিত্র ও বিষয়কে অক্ষুণ্ন রেখে নাট্যরূপে উপস্থাপিত করেছেন আকস্মিকভাবে। বইটি তার হাতে আসে ঘটনাচক্রে। তিনি এতে আকৃষ্ট হন এবং সংলাপ সৃজন, কাহিনীর বিন্যাস, দৃশ্যান্তর ইত্যাকার করতে করতে উপন্যাসটিকে নাট্যরূপ দেন।
উপন্যাসের নামটিও ‘রামচরিত্র’ থেকে ‘রামচরিত’-এ বদলে যায় নাটকে এসে। ফলত উপন্যাস ও নাট্যরূপ একই কাহিনী নির্ভর দু’টি স্বতন্ত্র শিল্প মেজাজের দাবিদার। যেমনটি আমরা চলচ্চিত্রে দেখি- নির্মিত হওয়ার পর অনেক উপন্যাস আর চলচ্চিত্র দু’টি আলাদা শিল্পসত্তা লাভ করে।
তবে, মূল উপন্যাসটি বহুল প্রচারিত ও পঠিত নয় বলেই মূলের প্রতি নাট্যরূপের আনুগত্য নিরূপণ ও তুলনামূলক আলোচনা এক্ষেত্রে দুরূহ এবং কাহিনীর প্রতি নাট্য রূপান্তরকালে বিশ্বস্ততার পরিমাপও এক্ষেত্রে আপাতত অসম্ভব। এমনকি, নাট্যরূপ পাঠে স্পষ্টতই প্রতীতী জন্মে যে, কাজটি যতো না মঞ্চের জন্য যুৎসই, তার চেয়ে বেশি নাট্য সাহিত্যের পদবাচ্য। অতএব, ফলিত দিক থেকে শিল্প বিচারের সুযোগও মঞ্চের দিকে তাকিয়ে দর্শক করতে পারবেন না। যতোটুকু মূল্যায়ন তা একরৈখিক পাঠের মধ্যেই সীমিত।
তথাপি রূপক ও প্রতীকের হাত ধরে যেভাবে অবরুদ্ধ সময়, সমাজ ও পরিস্থিতি দেখতে হয় এবং অনেক পেছনের কাহিনী টেনে এনে যেভাবে ‘ক্রীতদাসের হাসি’টি হাসতে হয়, তেমনিভাবে এই রূপান্তর প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরাজমান কিছু পশ্চাৎপদতা ও অন্ধকারও পরোক্ষে উন্মোচিত করা হয়ে যায়।
ফলে বহুধা বিভক্ত ভারতীয় সমাজের একটি অতি সাধারণ সামাজিক অসঙ্গতির চিত্র বা দৃর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক উপজীব্যতার বাইরেও বাংলাদেশে বিদ্যমান সমকালীন রাজনৈতিক রূঢ়-বাস্তবতা ও গুরুত্বের সঙ্গে মিলিয়ে দেখে নাট্যরূপায়নের মূল অর্জন তালাশ করার সুযোগ ও প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে।
ড. মাহফুজ পারভেজ: কবি-কথাশিল্পী-গবেষক। অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশ সময়: ১১০৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৭, ২০১৭
এমপি/এএসআর