ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

বেঁচে থাকার সাহস

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪৩৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ২০, ২০১৭
বেঁচে থাকার সাহস কবীর সুমন

জীবনবাদী গান গেয়ে কবীর সুমন বাংলা সংগীত ঘরানায় আলোড়ন তুলে এখনো সজীব। কোথায় পান তিনি জীবনের সবুজ আলো আর বেঁচে থাকার সাহস?

সাহসের অগ্নিস্পর্শ কবীর সুমন পেয়েছিলেন ১৯৭২ সালে। তখন তিনি নরেন্দ্রপুরে ইউনাইটেড ব্যাংক অব ইন্ডিয়ায় কেরানির চাকরি করছেন।

একদিন অকস্মাৎ ১২-১৩ বছরের একটি ছেলে, গায়ে আধময়লা জামা-প্যান্ট, খালি পা, অফিসে ঢুকে বললো- ‘তোমরা আমায় টাকা ধার দেবে? আমি ব্যবসা করবো’।

‘কিসের ব্যবসা?’

‘লজেন্সের। একটা কাঁচের বয়াম কিনবো, লজেন্স কিনবো। গড়িয়ার মোড়ে বিক্রি করবো। কুড়ি টাকা হলেই হবে’।

ব্যাংক এমন গ্রাহককে ঋণ দেয় না। কবীর সুমন আর তার বন্ধুরা, তরুণ কেরানিরা চাঁদা তুলে তাকে টাকা দিলেন। ঘটনাটি সবাই ভুলেই গিয়েছিলেন। মনে থাকারও কোনো কারণ ছিল না।

মাসখানেক পর রথতলা স্টপেজে দাঁড়িয়ে আছেন কবীর সুমন, দেখলেন সেই ছেলেটি। তাকে দেখে ছুটতে ছুটতে আসছে। সেই একই আধময়লা জামা-প্যান্ট, খালি পা। হাতে কাঁচের বয়ামে সবুজ সবুজ লেবেঞ্চুস।

এক গাল হেসে হাঁফাতে হাঁফাতে বললো- ‘দেখেছ, তোমাদের দেওয়া টাকা নষ্ট করিনি, ব্যবসা করছি’।

কি গর্ব ছোট্ট ছেলেটার চোখে-মুখে!

কবীর সুমন নিজেও সব সময় গর্বের সঙ্গে স্বীকার করেন,  ‘ওই ছেলেটা আমায় বেঁচে থাকার সাহস দেয়’।

ঘটনাটির এক যুগ পর, ১৯৮৫ সাল। নিকারাগুয়ার বিপ্লবের ওপর বই লিখতে কবীর সুমন গেছেন সে দেশে। মানাগুয়ার পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

একটি কিশোর রাস্তায় খেলছে, ঠিক আমাদের দেশের সাধারণ ছেলেদের মতো। তাকে একথা ওকথা জিজ্ঞাসা করতে করতে হঠাৎ দুম করে তিনি প্রশ্ন করেন, ‘তোমার দেশে একটা বিপ্লব হয়েছে। তুমি জানো?’

‘হ্যাঁ’- ছেলেটি উত্তর দেয়।

বিপ্লব কি? সুমনের পাল্টা প্রশ্নে কিশোরটি ভাবতে লাগল। একটু অন্যমনস্ক হয়ে, রাস্তায় পায়ের আঙ্গুল ঘঁষতে ঘঁষতে। তারপর হঠাৎ মুখ তুলে বললো- ‘সোই লা রেভলুসিয়ন – আমিই বিপ্লব’।

গড়িয়ার লেবেঞ্চুস বিক্রেতা ছেলেটির সঙ্গে যদি মানাগুয়ার ওই ছেলেটির দেখা হতো? নিশ্চয়ই খুব বন্ধু হতো দু’জনে। বেঁচে থাকা আর বিপ্লবকে ওরাই তো সফল করেছে।

মানুষ, বিপ্লব, প্রকৃতি, পরিবেশ, প্রাণবৈচিত্র্য এ কারণেই কি কবীর সুমনের গানে গানে বার বার ঘুরে ফিরে আসে? সাহস জাগানিয়া আবেশ তৈরি করে। তার একটি গানে এসব কথা আছে। গানটির শিরোনাম  'প্রস্তুতি', অ্যালবামের নাম 'পাগলা সানাই'। প্রথম প্রকাশ পেয়েছিল ১৯৯৯ সালে।

‘কার জঙ্গল কাদের দখলে?
অরণ্য চায় ভাবুক সকলে
কারা জন্মায় বাঁচে আর মরে?
আদিবাসীদের প্রতি ঘরে ঘরে?
কাদের ভাষায় জঙ্গল পায় সবুজের সম্মান?
আমি রেখে যাই প্রশ্নের মত এই নাগরিক গান’।

‘কারা চিরকাল জঙ্গলে ছিল?
গাছের ঠিকানা কারা বলে দিল?
শদর, সেগুন, পলাশে ফাগুন কাদের বুকের জান?
আমি রেখে যাই প্রশ্নের মত এই নাগরিক গান’।

‘আদিম পৃথিবী কাদের জন্য
গড়ে তুলেছিল এত অরণ্য?
বুনো শূয়রের দাঁতের আঘাতে কারা দিয়ে গেছে প্রাণ?
আমি রেখে যাই প্রশ্নের মত এই নাগরিক গান’।

‘কাদের স্বদেশ এই বনভূমি?
দখল করলে সরকার তুমি,
কাদের বন্য গ্রামে সরকারি ঠিকেদার হেঁটে যান?
আমি রেখে যাই প্রশ্নের মত এই নাগরিক গান’।

‘গাছের শরীরে কুঠার চালাও
আদিবাসীদের কতটা কাঁদাও?
ভেবেও দেখ না দিনভর তারা কতোটুকু খেতে পান?
আমি বেঁচে খাই প্রশ্নের মত এই নাগরিক গান’।

‘কাটা গাছগুলো নিলামে উঠে
গাছ সদাগর কিনতে ছোটে
কত দর হাঁক, কত টাকা লেখ, কার টাকা কারা খান?
আমি খেতে পাবো কেউ যদি কেনে এই নাগরিক গান’।

‘যাদের হাসিতে চোখের জলে
অরণ্য তার গল্প বলে,
তারাই নিচ্ছে প্রস্তুতি দেখ বিদ্রোহে টান টান’।

‘অপেক্ষাতেই রইল আমার এই নাগরিক গান’।

প্রকৃতি আর মানুষকে কষ্ট দিলে বেঁচে থাকার সাহসটুকুই যে হারিয়ে যাবে! সবুজ-সুন্দরে বেঁচে থাকতে এ সত্য আমাদেরকে উপলব্ধি করতেই হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১০৩৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২০, ২০১৭
এমপি/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।