জামাল উদ্দিনের ইচ্ছে ছিল, আরাকান ও চট্টগ্রামের ইতিহাস-ঐতিহ্য খুঁজে বের করা। নানা বিরূপতার পরেও গবেষণা বন্ধ রাখেননি তিনি।
অতি সাম্প্রতিক বর্তমানই শুধু নয়, অতীত ইতিহাসও এখনো কাঁদে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে নির্যাতিত রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর জন্য। ইতিহাসের পর্বে পর্বে এখানে ঘটে গেছে মানবিক বিপর্যয়ের নানা কালো অধ্যায়। আদিতে যে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা জাতির সদস্য নিজেদের জনপদে বসবাস করতেন, বছরে বছরে সেটি কমেছে। বিশেষত গত সত্তর বছরে প্রকাশ্য ও সুপ্ত নিধনের তোপে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন রোহিঙ্গারা। দেশান্তরের এসব ঘটনার মাত্র কয়েকটি পৃথিবীর নজরে এসেছে, অনেকগুলোই আসেনি।
এক সময় কক্সবাজার থেকে বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে বিশ্বের নানা দেশে চলে গিয়েছিলেন হাজার হাজার রোহিঙ্গা। মধ্যপ্রাচ্য, বিশেষত সৌদি আরবে থাকা বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা এখনো বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী। ভারত, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া হয়েও নিজ দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন অনেক রোহিঙ্গা।
এখন নিজ জন্মভূমিতে বসবাসকারীদের চেয়ে দেশান্তরি আশ্রিত রোহিঙ্গার সংখ্যাই বেশি। অর্থাৎ, যতো না রোহিঙ্গা আরাকানে আছেন, পালিয়ে গেছেন তার চেয়ে বেশি। যারা রয়েছেন বাংলাদেশের আশ্রয় শিবিরে, মধ্যপ্রাচ্যের নানা দেশে, পাকিস্তান ও মালয়েশিয়ায়।
কিভাবে একটি আস্ত জাতিসত্তাকে কখনো প্রবল আক্রমণে, কখনো ধীরগতির নিপীড়ন-নির্যাতনে বাড়ি-ঘর, দেশছাড়া করা হচ্ছে- সেটি ইতিহাসের নির্মম পাঠেই জানা সম্ভব। আজকের জাতিগত বা আঞ্চলিক রাজনীতি কিভাবে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে, সে তথ্যও আমাদেরকে জানতে হবে ইতিহাস ঘেঁটেই। তবে সীমান্তঘেঁষা চরম এ সমস্যা, যার আঁচ নানাভাবে বাংলাদেশকে আক্রান্ত ও বিব্রত করছে, সেটির বিষয়ে বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা ও তথ্য-উপাত্ত একেবারেই অপ্রতুল। কিছু লেখালেখি আছে রাজনৈতিক ধাঁচের, কিছু আছে আবেগসর্বস্ব। রোহিঙ্গা সমস্যার একাডেমিক, বস্তুনিষ্ঠ, নৈর্ব্যক্তিক ইতিহাস পাঠ ও সমীক্ষা দেখা যায় না বললেই চলে।
একাডেমিক অঙ্গন থেকে যে কাজটি করা যেতো, সেটিই সম্পন্ন করেছেন মুক্ত ইতিহাস গবেষক জামাল উদ্দিন। মুক্ত গবেষক এজন্যই যে, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দেশের স্থানীয় ও আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চায় স্বপ্রণোদিত হয়ে নিয়োজিত রয়েছেন, খুঁজে বের করেছেন একাত্তরের বর্বরতার ইতিহাসও। মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম বিষয়ক কয়েকটি বই রচনা ছাড়াও এখানকার সুপ্রাচীন ঐতিহ্য, স্থাপনা, কৃষ্টি, সভ্যতার নানা দিক অনুসন্ধান করেছেন অন্য নানা মাধ্যমেও।
রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষণায় প্রায় ৩০০ পৃষ্ঠার ঐতিহাসিক পর্যালোচনায় হাজার বছরের ইতিহাস ধরে টান দিয়েছেন জামাল উদ্দিন। রোহিঙ্গা জাতির সদস্যরা মিয়ানমারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, সামরিক বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছেন- এমন তথ্যও হাজির করেছেন। এক কথায়, জাতিটির উত্থান-পতনের দিকগুলোকে শনাক্ত করতে চেয়েছেন বহুমাত্রিকতায়।
পুরো গবেষণায় রোহিঙ্গা জাতিসত্তার রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব এবং জীবনবোধের সজীব চিত্র উপস্থাপন করে সর্বসাম্প্রতিক দেশত্যাগের পর্যায় পর্যন্ত পুরো সময়কালকে ধারণ করেছেন জামাল উদ্দিন। রোহিঙ্গা জাতিকে সামগ্রিকভাবে জানতে তার গবেষণা তাই গুরুত্বপূর্ণ সহায়কের ভূমিকা পালন করবে। রোহিঙ্গা বিষয়ক আলাপ-আলোচনায় তথ্যনিষ্ঠার অভাবও এ গবেষণায় দূর হবে।
বর্তমান আর অতীতকে মিলিয়ে রোহিঙ্গা সমস্যার সামগ্রিক চিত্র ইতিহাস, গবেষণা ও সাহিত্যে খুবই কম আসার প্রেক্ষাপটে জামাল উদ্দিনের গবেষণা রোহিঙ্গা বিষয়ক যাবতীয় তথ্যও পূর্ণাঙ্গভাবে উপস্থাপনের সুযোগ তৈরি করেছে। জাতিগত আক্রমণের শিকার হয়ে গত আগস্ট মাস থেকে এ পর্যন্ত সরকারি মতে যে সাত লাখ আর বেসরকারি হিসেবে দশ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছেন এবং যাদের অধিকাংশই পিতা-মাতা হারানো শিশু ও স্বামী-স্বজন হারানো নারী- তাদের আর্তনাদের গভীরতাও মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারবেন বিশ্বের মানুষ।
বাংলাদেশ সময়: ১২৪০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২০, ২০১৭
এমপি/এএসআর