ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

সোনালি কাবিন:কাবিনবিহীন দু’টি হাত | সালাহ উদ্দিন মাহমুদ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০১৭
সোনালি কাবিন:কাবিনবিহীন দু’টি হাত | সালাহ উদ্দিন মাহমুদ সোনালি কাবিন:কাবিনবিহীন দু’টি হাত | সালাহ উদ্দিন মাহমুদ

আল মাহমুদ (জন্ম: ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দ) আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। কবি আল মাহমুদকে যতোই পড়বেন; মনে ততোই বিস্ময় জাগবে। তার উপন্যাস, গল্প, কবিতা ও আত্মজীবনীতে এক অপার বিস্ময় খেলা করে। সব আলোচনা বাদ দিয়েও যদি একটি গ্রন্থ আলোচনা করা হয়; তা-ই যথেষ্ট তার জন্য। সেটি তার কাব্যগ্রন্থ ‘সোনালি কাবিন’। আমার স্বভাব অনুযায়ী, কখনই শিল্পীকর্মে শিল্পীর ব্যক্তিজীবন টানি না। শিল্পীকে তার শিল্প দিয়েই বিচার করি। ব্যক্তি আল মাহমুদকে নিয়ে আমার হাজারটা প্রশ্ন থাকলেও তার শিল্পকর্মের কাছে আমি বাকরুদ্ধ অর্বাচীন। শ্রদ্ধায় নত হওয়া এক কলমসৈনিক।

কবি আল মাহমুদের বিখ্যাত ও বহুলপঠিত কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে ‘সোনালি কাবিন’। গল্প ও উপন্যাসে সফলতা পেলেও কবিতাই তাকে পরিচিতি এনে দিয়েছে।

আর তার সব সাহিত্যকর্ম বাদ দিলেও কবি আল মাহমুদ শুধু সোনালি কাবিনের জন্যই অমর হয়ে থাকবেন। সোনালি কাবিন তার অমরত্বের সাক্ষী হয়ে থাকবে। যুগ যুগ ধরে সনেটের স্বাদ, কবিতার আস্বাদন গ্রহণ করবে পাঠক। সাহিত্যবোদ্ধারাও কবিতা প্রসঙ্গ এলে প্রথমেই মুখে আনবেন সোনালি কাবিনের নাম। তিনি আধুনিক বাংলা কবিতাকে নতুন আঙ্গিক, চেতনা ও বাকভঙ্গিতে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। একজন নগণ্য পাঠক হিসেবে আমার এমনটিই মনে হয়।
 
সে যাই হোক, সোনালি কাবিন সম্পর্কে কবি আল মাহমুদ বলেছেন, “একদা প্রেমের কবিতা লেখার ইচ্ছাতেই আমি ‘সোনালি কাবিন’-এর সনেটগুলো লিখে ফেলি”। শুধু কি প্রেম? তার সনেটে প্রেমের পাশাপাশি উঠে এসেছে বিরহ, বিপ্লব, দ্রোহ এবং মানবতাবাদ। শব্দে উঠে এসেছে মুসলিম ঐতিহ্য, হিন্দু পুরাণ, খ্রিস্টীয় আচার-অনুষ্ঠান।  
 
চলতি বছর ‘সোনালি কাবিন’ প্রকাশের ৪৩ বছর পূর্তি হয়েছে। এই ৪৩ বছরেও বইটি সমানভাবে সমাদৃত হয়েছে। এ খবরটি একজন জীবিত কবির জন্য সবচেয়ে বড় পাওয়া। কবি বলেছেন, “সনেটগুলো যখন লিখি, তখন প্রবল এক ঘোরের মধ্যে ছিলাম”। কবি সনেটগুলো লেখার সময় যেমন ঘোরের মধ্যে ছিলেন; তেমন পাঠকও সনেটগুলো পাঠ করার সময় ঘোরের মধ্যে পড়ে যান। এমনকি পাঠ শেষেও ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারেন না। কেমন মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে সোনালি কাবিনের গুণগান।
 
সোনলি কাবিনের সনেটগুলো পাঠককে সত্যি বিমোহিত করে। এর শব্দ চয়ন, বাক্য গঠন, পর্ব বিন্যাস সত্যিই মনে রাখার মতো। তাই তো প্রথম সনেটেই তিনি লিখলেন, ‘সোনার দিনার নেই, দেনমোহর চেয়ো না হরিণী/ যদি নাও, দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দু’টি’। তার কাবিনবিহীন হাত দু’টি যেনো সোনায় সোনায় ভরে উঠলো। প্রথম সনেট জন্মের উত্তেজনায় তিনি লিখে ফেললেন আরও ছয়টি সনেট। যে উত্তেজনা পরে সংক্রমিত হয়েছে পাঠকের অন্তরেও।
 
কবি যখন বলেন, ‘তুমি যদি খাও তবে আমাকেও দিও সেই ফল/ জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোঁহে পরস্পর হবো চিরচেনা/ পরাজিত নই নারী, পরাজিত হয় না কবিরা;/ দারুণ আহত বটে আর্ত আজ শিরা-উপশিরা’। কবি মূলত প্রথমেই এক টানে সাতটি সনেট লিখে ফেলেছিলেন। এরপর লিখেছেন আরও সাতটি। ফলে প্রথমত মোট ১৪টি কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয় সোনালি কাবিনে। কিন্তু আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে, পরে তিনি অনেক চেষ্টা করেও এই ১৪টির বেশি সনেট লিখতে পারেননি। তখন কবির কাছে মনে হয়েছিল, এটা হয়তো কোনো দৈব ব্যাপার হতে পারে।
 
কবিতার কথাগুলো দৈব বাণী না হলেও কবি হয়তো দৈবক্রমেই পেয়েছিলেন। যা তাকে বাংলা সাহিত্যে অমর করে রাখবে। শুধু তেতাল্লিশ বছর নয়; কবি আল মাহমুদের সোনালি কাবিন পঠিত হবে যুগের পর যুগ; অনন্তকাল। কেননা সোনালি কাবিন লেখার জন্য তিনি সনেট নিয়ে অনেক পড়াশোনা করেছেন। সনেটের নিয়ম অনুসারে প্রথমে আট, পরে ছয় লাইনের এই ফর্মের প্রথম রূপ দিয়েছিলেন পেত্রার্ক। কিটসও লিখেছেন একই ধারায়। বাংলা ভাষায় অনেকে লিখেছেন। মাইকেল মধুসূদন দত্তের সনেটও চৌদ্দ মাত্রার। এর অনেক পরে কবি আল মাহমুদ লিখলেন ‘সোনালি কাবিন’।
 
প্রথমে মাত্র ১৪টি সনেট নিয়ে কলকাতায় পকেট সাইজের সোনালি কাবিন প্রকাশ হয়। পরে সোনালি কাবিনের চৌদ্দটি সনেট ছাড়াও মোট একচল্লিশটি কবিতা নিয়ে ‘সোনালি কাবিন’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এরমধ্যে একটি কবিতা ‘সোনালি কাবিন’ এবং এই কাব্য শিরোনামে গ্রন্থটির নামকরণ করা হয়।
 
সোনালি কাবিনের সনেট প্রসঙ্গে কবি বলেছেন, “লেখার পরই মনে হয়েছিল, সনেটগুলো বাংলা সাহিত্যে আমাকে অমরতা এনে দেবে। আজ দেখি, আমার ধারণা বেঠিক নয়, আশ্চর্যজনকভাবে সফল হয়েছে সনেটগুলো”! কবির ধারণাই সত্যি হয়েছে। ঈর্ষাতীতভাবে সফল হয়েছে তার সৃষ্টিকর্ম। যদিও কেউ কেউ ঈর্ষান্বিত হয়ে থাকবেন; কিন্তু আল মাহমুদের ‘সোনালি কাবিন’র মতো সনেট আগামী কয়েক যুগেও সৃষ্টি হবে না। হলেও তা এখনই কেউ বলে দিতে পারবেন না। কারণ সে সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। কারণ, যারা কবিতায় ছন্দকে অবহেলা করেন তারা তো কোনোভাবেই পারবেন বলে মনে হয় না। একটু খেয়াল করে দেখবেন, সোনালি কাবিনের কোথাও এতোটুকু ছন্দপতন নেই। মাত্রার বাড়াবাড়ি নেই। কী এক মধুর তালে দামি অলঙ্কারে সাজিয়েছেন তিনি কবিতার শরীর।  
 
সোনালি কাবিনে তিনি খুব সাহসের সঙ্গে ‘কাবিন’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তার আগে বাংলা কবিতায় এ শব্দটির ব্যবহার তেমনভাবে কেউ করেননি। যে শব্দটি মুসলিম বিবাহের সঙ্গে অর্থাৎ ধর্মীয় আচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ফলে সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু একইসঙ্গে তিনি নর-নারীর চিরায়ত সম্পর্ক, সমাজতান্ত্রিক সাম্যব্যবস্থা, স্বজাত্যবোধের কথাও বলেছেন। তার ভাষার গভীরতা মাটি মাতৃকাকেন্দ্র পর্যন্ত প্রথিত। তার কবিতায় ফুটে ওঠে চিরায়ত জীবনের রূপ। কবি বলেন, ‘বৃষ্টির দোহাই বিবি, তিলবর্ণ ধানের দোহাই/ দোহাই মাছ-মাংস দুগ্ধবতী হালাল পশুর,/ লাঙল জোয়াল কাস্তে বায়ুভরা পালের দোহাই/ হৃদয়ের ধর্ম নিয়ে কোনো কবি করে না কসুর’। (সোনালি কাবিন-১৪)
 
সুতরাং বলা যেতেই পারে, কবি আল মাহমুদের অন্যান্য সাহিত্যকর্ম ছাড়াও সোনলি কাবিনের বিশিষ্টতা তাকে বাংলা সাহিত্যে চির জাগরুক করে রেখেছে এবং রাখবে। কেননা জীবন সায়াহ্নে এসেও তিনি রচনা করে যাচ্ছেন তার কাব্য অলঙ্কার। তার কাব্যসুধা পান করে তৃপ্ত হচ্ছে পাঠককূল। দিগি¦দিক ছড়িয়ে পড়ছে বাংলা কবিতা। সনেটদিগন্তে উচ্চারিত হচ্ছে আল মাহমুদের নাম। পূজিত হচ্ছে সোনালি কাবিন।  
 
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০১৭
এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।