ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

নিঃসঙ্গতার একক | তানিয়া চক্রবর্তী

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৫১ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০১৭
নিঃসঙ্গতার একক | তানিয়া চক্রবর্তী নিঃসঙ্গতার একক | তানিয়া চক্রবর্তী

“যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে”
সকলেই শুনেছি এই গান, যতোটা প্রাণ খুলে গাইতে পারি— জীবনে ততোখানি ধার্য হলে জীবন খুব সুখের অনুভূত হয় না আশাকরি, তবে এই গানের অবশ্য অন্য ইতিবাচক দিক আছে তা আমরা জানি। আমরা সবাই জমাট বেঁধেই বাঁচতে চাই। কেউ কেউ বলেন, এই যে সব বিচ্ছিন্ন পরিবার; যৌথ পরিবার তো দেখাই যায় না তাহলে আমরা নিজেরাই একা হতে চাই!

না, আমার মনে হয় ব্যক্তি কখনই একা হতে চায় না তবে ব্যক্তি নিজেকে সর্বদা সুখী দেখতে চায়, সেটাই তার ভেতরের মূখ্য বিষয় তাই এখানে আঘাত লাগলে সে বিছিন্ন হয় কিংবা তাকে বিচ্ছিন্ন হতে হয়। জীবনের সেই সন্ধিমুহূর্তগুলো রচনাতেও সমমনস্ক মানুষ না আসলে দেহ বেশীদিন কিছু বহন করতে পারে না।

নিঃসঙ্গতা ও একাকীত্ব দু’টো কিছু হলেও ভিন্ন, একটি অনুভূত বোধ আর একটি অবস্থা কিন্তু দু’জনে ভীষণ সম্পর্কিত।

মার্ক টোয়েন বলেছিলেন, “সবচেয়ে খারাপ একাকীত্ব হলো নিজেকেও ভালো না লাগা”।
 
ভাবুন এই পরিস্থিতি কোন অবস্থার মধ্য দিয়ে গেলে তৈরি হতে পারে, তৈরি হলে তার পরিণতি কী হতে পারে! সামাজিক পরিস্থিতি, নিজের মূল্যবোধ বা নিজের চাহিদা কিংবা আদান-প্রদানের সূত্র ভ্রান্ত হলে ধীরে ধীরে ব্যক্তি বিচ্ছিন্ন হয় চারপাশ থেকে, এবার এই চলার পথ খুব কঠিন নাও হতে পারত কিন্তু হয়ে ওঠে তার কারণ, মানুষ সংবেদনশীল জীব, সে মেশার জন্য ভাব আদান-প্রদানের কারণে বাক্য বানিয়েছে, সুর বানিয়েছে, স্বপ্ন দেখছে এবং বন্ধনপূর্ণ পরিবেশ বানিয়েছে ফলে আপেক্ষিক চাপেই সে একার থেকেও বেশী একা বোধ করতে শুরু করে। বলা হয়, বিভিন্ন সমীক্ষায় একাকীত্ব’র অনুভূতিতে ভুগতে থাকা মানুষের ক্ষয়ও তীব্র হয়। শরীরে কর্টিসলের পরিমাণ বেড়ে ব্যক্তি স্থূল, অবসন্ন এবং ধীরে ধীরে হৃদরোগের কাছাকাছি চলে যেতে থাকে। আসলে আমরা নিজেদের প্রকাশ করতে ভালবাসি, আর সেই প্রকাশ কারও দ্বারা প্রতিফলিত না হলে অর্থাৎ প্রশংসা কিংবা নিন্দা কিছুই না হলে বিষয়টা কিছুটা মৃতপ্রায় হয়ে আসে। ব্যক্তি তার অস্তিত্বকে সন্দেহ করতে শুরু করে এই মুহূর্ত থেকে, মানসিক স্বাস্থ্য ব্যাহত হয়। এই বোধ নিজেকে না পাওয়ার বোধেরই কোনো এক সমার্থক ভঙ্গি। জীবনের বিভিন্ন মুহূর্তে এই সব সময়ের সঙ্গে যুঝেছেন শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি, গায়করা— কারণ ওই এক। নিজেদের বহুমাত্রিক বোধ কিংবা আদান-প্রদানের সূত্রগুলো তারা জায়গামতো রাখতে পারেননি কিংবা কেউবা এতো ভিন্ন ভঙ্গি ও জীবনের দ্বারা প্রভাবিত, তারা সেই জায়গায় অন্য কাউকে বা সমাজের মৌলিক কাঠামোকে বিরুদ্ধ দিকের করে ফেলেছেন। জীবন মূলত বিভিন্ন মাত্রার আর তা ব্যক্তিসাপেক্ষে খুব সহজও নয় ফলে তাকে ধারণ ও বহন মূখ্যত এক তীব্র বিষয় বিশেষত, যেসমস্ত মানুষ সাধারণের চেয়ে অন্য দিক দিয়ে জীবনকে দেখেন।

প্রতীকী ছবিআমেরিকার বিশিষ্ট কবি এমিলি নিজস্ব কোনো বোধ থেকেই ২০ বছর বয়স থেকেই বিচ্ছিন্ন জীবন স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছিলেন। এই অন্তর্মুখী কবি জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো এক তীব্র গতিতে শুধু লেখায় নিজেকে আবদ্ধ করে রেখেছিলেন। ৫৬ বছর বয়সে এই নিঃসঙ্গ জীবন থেকে তিনি মুক্তি লাভ করেন। ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় রোমান্টিক কবি জন কিটসের জীবনের পরিণতিও একাকীত্বর সঙ্গেই বন্ধুতা, তাই মাত্র ২৫ বছর বয়সে চলে যান যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে। তার মৃত্যুর পর থেকে তাকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়— উনিশ শতক তার জনপ্রিয়তা ধারণ করতে শুরু করে। মার্কিন আরেক কবি ও লেখক এডগার এলান পো একাকীত্বের বেদনা, অতিরিক্ত মদ্যপান সব নিয়ে জর্জরিত হয়ে ওঠেন। মৃত্যুর মুহূর্তে তাকে অসুস্থ অবস্থায় রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা যায়।
 
জনপ্রিয় আইরিশ কবি অস্কার ওয়াইল্ড, ১৮৯০ সালে তার লেখা নাটকের জনপ্রিয়তা সম্পর্কে নতুন করে না বলাই ভালো। এই মানুষটি তার স্ত্রীর মৃত্যুর পর ছন্নছাড়া জীবন শুরু করেন ফলে অর্থাভাব, নিঃসঙ্গতা এসব নিয়ে ৪৬ বছরে সেরিব্রাল মেনিনজাইটিসে আক্রান্ত হয়ে তার প্যারিসের বাড়িতে মৃত্যু হয়।
 
যারা রক সঙ্গীত শোনেন তারা আশা করি সকলেই “পিঙ্ক ফ্লয়েড” নামক ব্যান্ডের নাম শুনেছেন। ব্যান্ডের লিড গিটারিস্ট ও গায়ক ছিলেন ব্যারেট। তার শেষ অ্যালবামটির মুক্তির পরেই তিনি নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নেন বা হয়ে যান। ক্যানসারে আক্রান্ত এই মানুষটি ভক্তহীন, বন্ধুহীন অবস্থায় কেমব্রিজে তার বাড়িতে ২০০৭ সালে জুলাই মাসে মারা যান। এতো পরিচিত ও জনপ্রিয় এক শিল্পীর মৃত্যুর খবর সংবাদমাধ্যমের কাছে যায় না। এইভাবে কতো... মাইকেল জ্যাকসন, মেরিলিন মনরো যাদের আক্ষরিক অর্থেই ভালোবাসার লোকের অভাব ছিলো না, তাদের মরদেহটাও একাকী অবস্থায় পাওয়া যায়। বলা হয়, অতিরিক্ত ড্রাগ সেবন কিংবা আত্মহত্যা। সে যাই হোক, সেই একা একা মৃত্যুর কাছে চলে যাওয়া। কার্ট কোবেনের ক্ষেত্রেও তাই। জনাথন সুইফট নিজে অসাধারণ সুদর্শন যুবাপুরুষ হয়েও একা জীবন অতিবাহিত করেছেন, যাকে ভালোবেসেছিলেন তাকে বলেছিলেন, তিনি বিয়ে না করলে হারিয়ে যাবেন, সেই নারী বিয়ে না করায় তিনি সত্যিই হারিয়ে গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ব্যাঙ্গরসাত্মক লেখা লিখে জনপ্রিয় হন।
 
যারা জীবনের দিক ধরে রাখার মানুষ তথা কবি, শিল্পী তারা বোধের অন্যমাত্রায় গিয়েও একা থেকেছেন, একা হয়েছেন বারবার হতাশায় ভরে গিয়েছে তাদের জীবন একাকীত্বের বোধে।
 
বার্নার্ড শ একটি উক্তি করেছিলেন বোধ করি জীবনবোধ থেকেই, তার মর্মার্থ এইরকম, “যখন একা থাকার অভ্যাস হয়ে যায় ঠিক তখন ঈশ্বর কিছু মানুষের সন্ধান দেন। যখন তাদের নিয়ে ভালো থাকার অভ্যেস হয়ে যায়, ঠিক তখনই আবার একা হয়ে যেতে হয়”।
 
এই একা হওয়া বা একাকীত্ব বোধ কখনও মানুষকে অনেকবেশী শক্তিশালী ও কায়েমীও করে তোলে যদি অবশ্য তা যদি হতাশা ও তীব্র পীড়ায় পরিণত না হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার জীবনের জটিল বিষাদ ও একাকীত্বের মুহূর্তে যা সব লেখা লিখেছিলেন তা পড়লে অবাক হতে হয় বৈকি!
 
বোধহয় এই কারণে আইনস্টাইন বলেছিলেন, “THE MONOTONY AND SOLITUDE OF A QUIET LIFE STIMULATES THE CREATIVE MIND”।
 
আবার অ্যারিস্টটল এক চরমপন্থীর মতো বলেছেন, “WHOSOEVER IS DELIGHTED IN SOLITUDE IS EITHER A WILD BEAST OR A GOD”।
 
আইনস্টাইন এ কথাও বলেছেন, যৌবনে একা থাকা পীড়াদায়ক কিন্তু পরিণত অবস্থায় কিছুক্ষেত্রে আনন্দদায়ক।
 
কেউ বলেছেন, একাকীত্ব এমন অবস্থা যা দিয়ে ব্যক্তি নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে পারে। কেউ বলছেন, একা থাকার ক্ষমতা আসলে স্বাধীনতার অন্য মাত্রা।
 
কিন্তু একথা অস্বীকার করলে ভুল হবে যে, একা থাকাটাই মূখ্যত জিতে গেছে কিংবা শ্রেয়, আসলে একা আমরা থাকতে পারিও না চাইও না। হিসেবে করলে দেখা যাবে, ব্যক্তি যে পরিমাণ ভোগ অন্যের সাহচর্যে করে সেই মানুষেরই একা থাকাকালীন ভোগ কমে। হ্যাঁ, এটাও সত্যি কেউ কেউ স্বেচ্ছায় একা থাকেন সে প্রসঙ্গ আলাদা কিন্তু যে একা থাকেনি বা একা থাকতে চায় না; জীবনবোধ, কর্ম, ভঙ্গি, আরও বহুকিছুর জন্য তাকে একা হতে হয় তার একাকীত্ব বোধ পীড়াদায়ক! আমরা আসলেই সমষ্টিগত আমরা জমাট বাঁধতে চাই তাই একা নির্বাসিত হলে আক্ষরিক অর্থেই তা জীবনের ক্ষয় ঘটাই। তাই তো মানুষ সমাজবদ্ধ জীব!
 
বাংলাদেশ সময়: ১২৫০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০১৭
এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।