(১)
'জলনূপুরের কান্না'
নদী বুঝি স্বর্গে যায়
আমি এর কিছুই জানি না
তবু নদীজলে পুণ্যার্থী মানুষ দেখে
আমিও ব্যাকুল হই,
নদীজলে ভেসে যাওয়া ছাইভষ্মে খুঁজি অবয়ব অামারই প্রতিরূপ কিংবা তার
পরখ করি হাজার বছরের পুরাতন করোটিতে রোমাঞ্চ ভালোবাসা অপার
নদী বুঝি স্বর্গে যায়
আমি ওসবের কিছুই বুঝি না
তবু বালিকার কাঁখের কলসি-জলে আমি আজো জলনূপুরের কান্না শুনি মানুষের কান্না শুনি বিষাদ-বেদনার
(২)
'মৃত্যুঞ্জয়ী'
সিঁড়িতে পা রাখতেই
রক্তস্রোতে ভেসে যাই ডুবে যাই
সাদা অন্ধকারে কে কখন কাকে হত্যা করে বলো!
তোমার চোখের জলজ নদীতে ধাবমান মৃত্যুর প্রহর
তবুও তোমার দিকে যেতে চাই
চৌরাস্তায় ওরা কারা!
ওরা তোমাকে বুঝেছে কতটা!
ওরা প্রতিদিন প্রতিক্ষণে তোমাকে
তোমার চেতনাকে কী নির্মমভাবে হত্যা করে অবলীলায়
আজ লাল নীল হলুদ বেগুনী বাতির আলোকোজ্জ্বল সভায়
কে বাজায় বাঁশী!
শহরের অলিতে গলিতে নেঙটো ইঁদুর পালিয়ে বেড়ায়
একটি হুইসেল আমাকে থামিয়ে দেয়
অসংখ্য সিঁড়ির পাদানিতে
অসংখ্য পথরেখায় - বারবার
হাত নাড়ছি দুলে উঠছি
কথার পিঠে কথা বলছি
পায়ে পায়ে পা রাখছি
আলোতে কিংবা আঁধারে
মৃত্যুর এক সফেদ কফিন
(৩)
'এ কোন্ বাংলাদেশ'
বাংলাদেশ
আমরা তোমাকে দেখতে পাচ্ছি, আলোর ভুবন থেকে উদার প্রাঙ্গণ থেকে অনেক দূরে, অসহায় করুণ ভঙ্গিমায় - দাঁড়িয়ে আছো।
বাংলাদেশ
তুমিও আজ আমাদের মত বড্ড অসহায়।
শিক্ষক শ্যামল কান্তি হয়ে
তুমি! হ্যাঁ তুমিই গিয়েছিলে কারাগারে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ
তোমার চেতনার আলখেল্লায় মুখোশ পরাদের ভীড়ে আজ আর তোমাকে চেনা যায় না, বড্ড বেমানান তুমি।
বাংলাদেশ
এ কোন্ আঁধারে কৃষ্ণপক্ষে হারিয়ে যাচ্ছো তুমি
অনমনীয় দানবীয় সাম্প্রদায়িক শক্তির কাছে তোমার নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ
আমরা মানি না, মেনে নিতে কষ্ট হয় - ভীষণ।
বাংলাদেশ
তবে কী তোমার বায়ান্ন, ঊনসত্তর, ৭মার্চের অমোঘ বজ্র নিনাদ, মুক্তিযুদ্ধ, মা-বোনের সম্ভ্রম, লাখো শহীদের আত্মদান, বঙ্গবন্ধু, পঁচাত্তরের ঘোর অমানিশা ইতিহাসের কালো অধ্যায় - আজ কী কেবলই মলিন পাণ্ডুলিপি।
বাংলাদেশ
তবে কী তুমিও আজ হাতেপায়ে শেকল পরা মৃত এক কয়েদি!
কালো কাপড়ে মোড়ানো একটি কফিন!
বাংলাদেশ
'এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়' বলো?
(৪)
'প্রত্ন সংলাপ'
ফুলজান মুখিজান
তোমাদের কথা কেউ রাখে নি মনে,
ঘরদোর বসতভিটায় রাতবিরেত আজো সেই হারিয়ে যাওয়া বেদনাবিধুর দোহার সুরে পায়েলখানি বুক-পাঁজরে বাজে।
তরুণ আত্মার কলতান উচ্ছ্বাস মন্দিরার সুর - আজো মেঘনা ডাকাতিয়ায় রমু মাঝির রমুর খালে বহুবিধ স্মৃতিরেখায়, বিষাদ অরণ্যে - কান পেতে শুনি।
তোমাদের ধাবমান কণ্ঠস্বর, অপরূপ অবয়ব বিধ্বস্ত করোটির পাশে আজো কী শুয়ে আছে - ছাঁইভষ্মে, পোড়ানো পাতার ফসিল জড়িয়ে!
ফুলজান মুখিজান
দেখতে তোমরা কেমন ছিলে!
শত বছরের বসত-ভিটায় মাটির দেয়ালে, পুরাতন ভগ্ন চুলার কাঠ কয়লার অবশেষে কিংবা টুকরো টুকরো খেলনা পুতুল আর বহুবিধ তৈজসপত্রে - তোমাদের কোমল হাতের পরশে কেঁপে উঠি আজো প্রত্ন-হৃদয়ে।
ফুলজান মুখিজান
তোমাদের সেই পুরাতন আকাঙ্ক্ষার আঙ্গিনায় বেড়ে ওঠা আমিও এক উত্তর পুরুষ,
আমাকেও পার হতে হয় এ বাড়ির বয়সন্ধির উঠান।
(৫)
'প্রেমপুরাণ'
পাঁজরে রাখবো হাত
অন্ধকারে ধু ধু মাঠে প্রান্তরেখায়
মাটির মূর্তির অগ্নিবালক - অস্তিত্বে আমার
ছুঁয়ে দেখ
এই হাতে শত আলোকবর্ষের কোমল পরশ
আদি নারী ইভের দোহাই
পালঙ্কে সরিয়ে রাখো ঘুম-রাত
অরণ্য-বাসর পাললিক ডানা
বিদ্রূপের হাসি নয়
কান পেতে শোন
ধমনীতে ক্রদন অগ্নিবৃষ্টির
আর বুকে বাজে সুর প্রত্ন দোহার
(৬)
'কোথাও যেতে নয়'
না! কোথাও যেতে নয়
শুধু এই জলাভূমি মাঠে ঘাটে পাহাড়ে অরণ্যে স্থিত হতে চেয়েছি
পাওয়া না পাওয়ার বেদনাবিলাস পুষ্পের চাষাবাদ হয়েছে প্রচুর
আমিতো চেয়েছি কেবল অদেখা আলোয় জোনাক-পতঙ্গ হতে
আর বাজাতে বাঁশী অচেনা সময়ের সুরে
আহা আজো ধুলিকণায় হৃদয়ের সব রঙ মেখে
দুপুরের গনগনে রোদে স্মৃতির পালক ওড়ে
দূরে বহুদূরে--
কে তুমি!
পেছন থেকে সম্মুখে এসে দাঁড়াও
সেই স্বপ্নমুখর একুশ পেরুনো বয়সন্ধি সীমায়!
আজো না হয় একবার পরখ করি রাতের মেঘ হয়ে উড়ন্ত আকাশে
আর পোড়াই অসমাপ্ত প্রহর নৈকট্য যাবতীয় নামাবলী
(৭)
'গন্তব্য'
শাটল ট্রেন যাবে কতদূর দেবযানী!
আজো ট্রেনে যেতে নিস্তব্ধ হয়ে যাই
পাতালে সমতলে কিংবা উড়ন্ত আকাশে
হুইসেল বাজলে কান পেতে শুনি - স্বপ্নঘোর ঘুঙুরের শব্দ
আজো ট্রেনে যেতে অলৌকিক অচেনা
কোন এক স্টেশনে নেমে
মৃত সব সারিবদ্ধ লাশ দু'হাতে সরাই --
হ্যাঁ কিংবা না - ঈশ্বর ঈশ্বরীর খণ্ড-বিখণ্ড অবয়ব - অসংখ্য অগনন
আজো রাতের আকাশে দূর নক্ষত্র-আলোয় পরখ করি অস্তিত্ব
অবয়ব
নীলকণ্ঠ সমুদ্রজল
জলের গভীরতা
জন্মপাঠ
জীবনের সমূহস্পন্দন
আজো শাটল ট্রেনে
না কিংবা হ্যাঁ অস্তিত্বের সহযাত্রী এক বাড়ি ফিরি
প্রহর গুনি গতিময় জীবন ও যৌনতায়
শাটল ট্রেন যাবে কতদূর - দেবযানী!
হুইসেল বাজলে ঝাউতলা সময় মাপার পালা--
লেখক:
হোসাইন কবির
চট্টগ্রাম ও নিউইয়র্ক: ২০১৭।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০১৭