এই বছর না গুনলে বা একে নিয়ে এতো উচ্ছ্বসিত না হলে কিছু কী খুব এসে যেত! হয়তো না, হয়তো হ্যাঁ! এসে যেত সভ্য সমাজে কারণ, এই জীবনকে ধারাবাহিকতার রঙ্গমঞ্চে নিয়ম ধরিয়ে আমরা একঘেয়ে করি। আমরা যে মানুষ, আমরা যে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে চলেছি এটা আমাদেরই অনুধাবন করা উচিত গুরুত্বের সঙ্গে।
মনোবিদরা বলেন, এই বছর উদযাপন আসলেই একটি ইতিবাচক প্রক্রিয়া আর সঙ্গে যুক্ত ভাবনাও প্রাসঙ্গিক! কারণ, এই নতুনের মধ্যে নতুন করে যাওয়া অর্থাৎ কোনোকিছু শুভারম্ভ করার নতুন সুযোগ থাকে। নিজেকেই নিজে করে দেওয়া আসলে সংশোধনের উপায়, সুস্থ সামাজিক গঠনের উপায়। আমরা সালতামামির মাধ্যমে পেছন ফিরে তাকাই ফলে আমাদের পূর্বতন আমাদের ভবিষ্যতকে সতর্ক ও সম্ভাবনাময় করে!
আমরা অসহিষ্ণুতার চাপে এবার সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশকে হারিয়েছি, উচ্চকিত স্পষ্ট স্বর পৃথিবীতে বিরল তা হারিয়ে ফেলা ভীষণ ক্ষতির বিষয়। হারিয়েছি কালিকাপ্রসাদের মতো একজন বোধসম্পন্ন গায়ককে। আমরা পেয়েছিও নিশ্চয় অনেককিছু। তবে হারানো যখন নশ্বরের নিয়ম মেনে হয় তাকে মানা যায় কিন্তু যা প্রণোদিত তা আঘাতকারী। আমরা যেনো অসিষ্ণুতাকে বর্জন করতে পারি। যেনো কিছু অনিয়মে হারাতে না হয়। ভালোদের স্মরণ করা ও তাদের এগিয়ে নেওয়া সহজ। খারাপের পরিশুদ্ধীকরণ কঠিন তাই এই বিশেষ ঘটনাগুলি তুলে আনলাম। বহু বিশিষ্টজনকে আমরা হারিয়েছি এ বছর, বহুকিছু পেয়েওছি। তাই সময় যেহেতু সময়ের অনুঘটক তাকে সময়ের জন্যই সৎ হতে হবে।
এবার আসি এ বছরের কিছু জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের কথায়! বইয়ের কথায় কেন লাফ দিলাম সবকিছু ছেড়ে? আসলে বই এমন বস্তু যা পড়ার পর মস্তিষ্ককে অনেক কাজের জন্য সক্রিয়ভাবে প্রয়াসী করে তোলে। আমরা পশু-পাখি নই আবার রোবটও নই। আমাদের সংবেদন হলো আমাদের সবচেয়ে মহার্ঘ্য অস্ত্র! এর সংবেদনই জারিত হয়ে লেখকের লেখায় রূপান্তরিত হয়। লেখনী ও তার পাঠকগদের প্রতিক্রিয়া একটা সময়ের গাঠনিক রূপকে তুলে আনে।
এ বছরের যে সমস্ত বই আলোচনায় এসেছে তার মধ্যে অন্যতম “LINCOLN IN THE BARDO BY AMERICAN WRITER GEORGE SAUNDERS”। জর্জের এই উপন্যাস মূলত ম্যাজিকাল রিয়েলিজমকে ধরে একটি পরীক্ষামূলক উপন্যাস। টাইম ম্যাগাজিন ২০১৭ সালের উন্নত প্রথম দশটি উপন্যাসের মধ্যে এটিকে স্থান দিয়েছে। এই বই এর জন্য তিনি ২০১৭ বুকার প্রাইজে সম্মানিত হয়েছেন। র্যান্ডম হাউজ প্রকাশনী থেকে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এটি প্রকাশিত হয়। আমেরিকায় এটি বেস্ট সেলারের শিরোপাও পেয়েছে।
এরপরের যে বইটি নাম করব সেই বইটির পটভূমিকা রয়েছে দেশান্তরী হওয়া এবং রিফিউজি সমস্যাকে কেন্দ্র করে। সাঈদ আর নাদিয়াদের নিয়ে এই গল্প। এক্সিট ওয়েস্ট “EXIT WEST BY PAKISTANI AUTHOR MOHSIN HAMID”, এই হলো সেই উপন্যাস। এই বইও ২০১৭ বুকার প্রাইজের জন্য নির্বাচিত তালিকায় আসে। মহসিন হামিদের এটি চতুর্থ উপন্যাস। এর আগেও ২০০৭ সালে তার লেখা বই বুকার প্রাইজের জন্য মনোনীত হয়। বহু আন্তর্জাতিক সম্মান পেয়েছেন তিনি। এ বছর মার্চ মাসে এই উপন্যাস প্রকাশিত হয়।
“SING, UNBURIED, SING BY JESMYN WARD” এই বইটিও এ বছর ন্যাশন্যাল অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে। টাইম ম্যাগাজিন জেসমিনের এই উপন্যাসকে ১০টি প্রথম সারির উপন্যাসের মধ্যে স্বীকৃতি দিয়েছে।
এবার আসি ভারতীয় লেখক অরুন্ধতী রায়ের লেখা উপন্যাসের কথায়। পেঙ্গুইন থেকে প্রকাশিত এই উপন্যাস অরুন্ধতী লিখলেন তার নিয়ত লেখার প্রায় ২০ বছর পরে। ২০১৭ ম্যান বুকার প্রাইজের জন্যও এটি নির্বাচিত তালিকায় স্থান পেয়েছে, পূর্বেই ১৯৯৭ “THE GOD OF SMALL THINGS” এর জন্য তিনি বুকার প্রাইজ পেয়েছেন অবশ্য। ৪৪৯ পৃষ্ঠার উপন্যাসের নাম “THE MINISTRY OF UTMOST HAPPINESS”।
এই দুর্দান্ত সব উপন্যাস পৃথিবীর তালিকা থেকে খুঁজে পেয়েছি আমরা যা জীবনের চিনি বা নুনকে সময়ের গ্লাসে অনায়াসেই নাড়িয়ে নাড়িয়ে মিশিয়ে দিতে পারে। আসলে এই সমস্ত উচ্চকাঠামোর একার্থে রক্ষক বুদ্ধিজীবীরা ও তাদের লেখার প্রভাব জনমানসে পড়বেই। সেই প্রভাবে সম্মানের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছে এসব বই! এইসমস্ত বন্দুক, ঝগড়া, দলীয় হিংসা আর নিজেকে ক্ষমতাবান করে তোলার প্রয়াসে আমরা যেনো হারিয়ে না যাই! বিগতরা যেনো স্মৃতির ভিত্তি হয়ে বেঁচে থাকতে পারে, তবেই যাপনের সাফল্য আসবে। আমরা যেনো অতিক্রম করতে পারি কিন্তু পেরিয়ে বা মাড়িয়ে যাওয়ার অস্থিরতা যেনো না থাকে!
সাহিত্যে “NEVER LET ME GO” এই উপন্যাস লিখে কাজুও ইশিগুরো নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ২০১৭ সালে। জাপানী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ এই লেখক ১৯৮৯ সালেই তার উপন্যাস THE REMAINS OF THE DAY এর জন্য পেয়েছিলেন বুকার প্রাইজ। এছাড়াও তিনি প্রায় চারবার বুকার প্রাইজের জন্য নির্বাচিত তালিকায় মনোনীত হন। টাইম ম্যাগাজিন নেভার লেট মি গো উপন্যাসকে ১৯২৩ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে ইংরেজি সাহিত্যের সবচেয়ে ভালো উপন্যাস বলে আখ্যা দিয়েছে। সেই বই ২০১৭ সালে এসে তার যোগ্য সম্মান প্রাপ্ত হয়েছে। সাহিত্যের প্রতিষ্ঠায় সাহিত্যের সেবক হিসেবে আমাদের গর্ব করাই সাজে।
টেনিসন বলেছিলেন, “HOPE SMILES FROM THE THRESOLD OF THE YEAR TO COME, WHISPERING, ‘IT WILL BE HAPPIER”।
বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন বলেছিলেন, “BE AT WAR WITH YOUR VICES , AT PEACE WITH YOUR NEIGHBORS, AND LET EVERY NEW YEAR FIND YOU A BETTER MAN”।
চলুন নিঃশব্দে এই সময়ের গণনাকে ধরে মৃত্যুর পথের কাছে নিয়ে যাওয়ার সময় আরও মোহময় করে তুলি। জন্ম যদি প্রবেশ আর মৃত্যু যদি নির্গমন হয় তাহলে এক্ষেত্রে এটাই সত্যি পৃথিবী ছাড়ার সময়ের কাছাকাছি এলে আমাদের উচিত পৃথিবীকে আরও বেশী করে ভালোবেসে নেওয়া। ইংরেজি নতুন বছরের শুভেচ্ছা ও শুভকামনা।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৭
এসএনএস