হারাধন বাবু এমন ছিলেন না। প্রতিদিন সকাল নয়টার অফিস ধরতে ঘণ্টাখানেক আগেই বেরিয়ে পড়তেন।
দিন যত গড়ায় গভীর রাতে বাসায় ফেরা অভ্যাসে রূপ নেয়। ব্যাচেলর জীবন থেকে যৌথ জীবন। সংসার বড় হয়, খরচের ডালপালা মেলে। পরিবারের নিত্যনৈমত্তিক খরচ সামলাতে সন্ধ্যার পর একটা পার্টটাইম জব নিয়েছেন হারাধন। তাই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সন্ধ্যার পরপর অথবা আগে বাসায় আর ফেরা হয় না। সবার অফিস আট ঘণ্টা হলেও তার অফিস পুরো দিন; এই বলে গ্যানর-গ্যানর করে স্ত্রী কানন বালা। প্রায়শই ভোরে বেরিয়ে গভীর রাতে ফেরেন। এ নিয়ে কানন সারাক্ষণই বকবক করেন। হারাধন বাসায় আছেন কী নেই সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। অবশ্য সব কামকাজ শেষ হলে স্বামী কখন ফিরবে সে চিন্তায় বিভোর থাকেন। হারাধন বোঝেন, কানন বালা তাকে অনেক বেশি ভালোবাসেন বলেই চিন্তুা মুক্ত থাকতে পারেন না। আর এমনটি না করলে হয়তো সপ্তাহে একদিন বাসায় ফিরতো হারাধন। বাসায় এলে বউয়ের ক্যানক্যান শব্দ বিরক্তি আর মেজাজ খারাপ হলেও খেপতেন না। অবশ্য কদাচিৎ যে প্রতেউত্তর করতো না তাও কিন্তু নয়। কানন বালার বকবক করার পেছনেও যুক্তি আছে। বাসায় দেরি করে ফেরার যথাযথ কারণ উপস্থাপন করলেও একতরফা কানন বালা জয়ী হতেন। যতো যৌক্তিক কারণই হারাধন বাবু দিতেন কোনোভাবেই কানন বালাকে বোঝাতে পারতেন না। এক কথায়, বাসায় ফিরতে তো দেরি হয়েছে। আর কোনো ব্যাখ্যা চলে না।
হারাধন বাবু গ্রামের স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করেন। এরপর প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উপ-শহরে উঠেছেন বছর তিরিশেক আগে। শহরে এসেই একটা প্রাইভেট কোম্পানির সেলসম্যান হিসেবে চাকর নেন। আর পেছনে ফিরতে হয়নি। পদন্নোতি পেয়ে পেয়ে হারাধন বাবু আজ জোনাল ম্যানেজার। এতোদিনে চাকরির প্রতি খুব মায়া জন্মায়। তাই অন্য কোম্পানিতে দ্বিগুণ বেতনের অফার পেয়েও ফিরিয়ে দিয়েছেন। কাপড় কাচার সাবান কোম্পানি হলেও গাবগাছ মার্কা সাবানের বাজার খুব সরগরম ছিলো। অন্তত পনের বছর রমরমা বাণিজ্য করেছে কোম্পানিটি। এখন সময় বদলেছে। ডিটারজেন্টের যুগ এসেছে। তাই বল সাবান কোম্পানির বাজার খুব খারাপ। হারাধনের চাকরি যায় যায় অবস্থা। গত মাসে সারা দেশের তেশট্টিজন জোনাল ম্যানেজারকে চাকরি থেকে অব্যহতি দেওয়া হয়েছে। শুধু খুব সিনিয়র হওয়ায় হারাধন বাবুকে তিন মাস সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এই ফাঁকে অন্য কোথাও চাকরি খুঁজে নিতে বলা হয়েছে। পার্টটাইম জব যেখানে করতেন সেখানে ফুলটাইম লোক নিয়েছে কোম্পানি। সব মিলিয়ে জটিল সময়ের মুখোমুখি হারাধন।
তিন মাস এতো তড়িৎ গতিতে চলে যাবে বুঝতেই পারেননি তিনি। এর ফাঁকে কতো জায়গায় চাকরি খুঁজেছেন তার কোনো হিসেব নেই। কতোজনের কাছে বলে রেখেছেন একটা চাকরির জন্যে। সবাই বলে সুযোগ পেলেই খবর পৌঁছাবো। স্থানীয় পত্রিকাগুলোতে প্রতিদিন চোখ আওড়ান হারাধন। জাতীয় পত্রিকা চোখ বুলিয়ে আশাহত হন প্রতিদিন। যেকোনো চাকরির জন্য বয়স নির্ধারণ করা ত্রিশ। হঠাৎ স্থানীয় ‘দৈনিক ভাঙ্গাগড়া’ পত্রিকার শেষের পাতায় দৃষ্টি পড়ে। এক ভদ্রলোক প্রথম পাতা পড়ছিলেন। শেষ পাতায় ‘আয়া আবশ্যক’ কালো সেডের উপর লেখা বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনটি দেখে তিন টাকায় পত্রিকাটি কিনে নেন।
সেদিন খুব ক্লান্ত বিষণ্ন মুখে দুপুর বিকেলের মাঝামাঝি সময়ে বাসায় ফেরেন হারাধন। কানন বালা দরজা খুলতেই হাসি মুখে বাসায় ঢোকেন। অথচ মনের ভেতর চাপা কষ্ট আসন্ন দিনের দুর্ভাবনা গোল্লাছুট খেলছে। জেলা শহর থেকে প্রকাশ হওয়া ‘দৈনিক ভাঙ্গাগড়া’ পত্রিকার কপি হাতে দিয়ে বলেন, দেখো দেখো; কিছু পাও কী না?
-কী?
-দেখই না। ভালো করে দেখ। বলে হারাধন বাবু কাপড় বদলাতে যান। বাথরুমে হাত মুখ ধুতে ধুতে বলেন, কি, কিছু পাইছো?
-কতো কিছুইতো পাইছি। তুমি কোনটার কথা বলছো? ওই যে প্রেমিকের হাত ধরে তিন সন্তানের জননী উধাও। এটার কথা বলছো?
-আরে না।
-তাইলে; দুই হাজার পিস ইয়াবাসহ স্বামী-স্ত্রী আটক; এটা?
-তোমার যে কী হলো, ভালো কিছুর দিকে নজর দাও। দেখ দেখ ভালো করে দেখ। হারাধন বাবু ভাবছে কানন বালা যদি নিজে থেকে বিজ্ঞাপনটি দেখে তবে সমস্যা মিটে যায়। মুখ ফুটে কিছু বলতে হবে না। পার্টটাইম জবটা হারানোর পর সংসারে যে টানাপোড়ন শুরু হয়েছে। এ উপলব্ধি থেকেও যদি বিজ্ঞাপনটি নজরে আসে। একে একে চার পাতার পত্রিকার সব নিউজের হেডলাইন পড়লেও কোনো কিছুর প্রতি বিশেষ নজর পড়লো না কানন বালার। তিনি বিরক্ত হয়ে পত্রিকা ছুড়ে ফেলে বলেন, তোমার পত্রিকা তুমিই পড়।
-থাক; থাক; তোমার আর পড়তে হবে না। খাবার দাও। কনিকা-মনিকা স্কুল থেকে এখনও ফেরেনি?
-ফিরবে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই। এরই মাঝে দরজার কড়া নাড়লো কনিকা বালা ও মনিকা বালা।
-নে ভালোই হলো। এসো এসো; সবাই মিলে একসাথে ভাত খাবো। অনেক দিনতো একসাথে খাওয়া হয়নি। সুযোগ হয়েছে তো খেয়ে নেই; দ্রুত এসো।
কতোদিন পর একসাথে দুই মেয়েকে নিয়ে খাবার খেতে বসেছেন হারাধন বাবু। হিসাব মেলানো মুশকিল। মেয়ে দুটো বড় হয়েছে বেশ। কনিকা বালা এ বছর দশম আর মনিকা বালা নবম শ্রেণীতে পড়ছে। দেখতে দেখতে মেয়েরা বিয়ের উপযুক্ত হয়ে যাচ্ছে। ভাবতেই কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে হারাধনের। জীবনে যেটুকু আয় তার সবটুকুই ব্যয় হয়েছে সংসারের পেছনে। মাঝে মাঝে গ্রামে বাবা-মায়ের জন্য কিছু টাকা পাঠাতে হয়। অবশ্য স্ত্রীর অগোচরে। টাকা পাঠানোর কথা জানলে প্রশ্নের অন্ত থাকবে না। নারীরা স্বামীর আত্মীয়কে ভিন্ন চোখে দেখে। বিষয়টি জিনগত।
ভাতের পাতিলে চামচ দিতে দিতে কানন বালা বলেন, আজকাল তুমি কেমন যেন হয়ে গেছো। কী হয়েছে তোমার?
-কই কী হয়েছে? কাজ-কাম আর ভালো লাগে না। ভাবছি গ্রামে চলে যাবো। গ্রামে গিয়ে কিছু একটা করে জীবন চালিয়ে নেব। শহর থেকে দিন দিন মন উঠে যাচ্ছে। এখানে নির্ভর করার সাহস দিনদিন হারিয়ে ফেলছি। এ বয়সে অন্য কোথাও চাকরি পাওয়াও কঠিন।
-কেন? এ চাকরির কী হয়েছে?
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, কী হবে আর? যে দিন এসেছে। বল সাবানের বাজার ভালো না। মানুষ এখন গুঁড়ো সাবান ব্যবহার করে। বল সাবানে কাপড় কাচতে কষ্ট বেশি। মানুষ দিন দিন অলস হচ্ছে। প্রযুক্তি মানুষকে আলসে বানাচ্ছে। মানুষ সময়ে সময়ে শারীরিক কর্ম ক্ষমতা হারাচ্ছে। এখন শহরে প্যাডেলের রিকশা কয়টা আছে? নাই বললেই চলে। যন্ত্রের যুগ এসেছে। আজকাল রিকশা চালকরাও হার্টফেল করে। স্ট্রোক করে মারা যায়। বুঝতেইতো পারছ? আমরা মানুষরা কতো অলস হয়েছি।
কনিকা ও মনিকা বাবা আর মায়ের কথা শুনছে। কোনো কথা না বলেই খাবার শেষ করে তারা। হারাধন বাবু খাবার শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত আর একটা কথা বলেনি। খাবার শেষে হারাধন বিছানায় পিঠ ঠেকায়। কিছুক্ষণ পর আবার ওঠে। অস্থিরতা। অজানা শঙ্কায় ছটপট করেন হারাধন। মেয়েরা পড়ার টেবিলে। কানন বালা রান্না ঘরে বাসন-কোসন ঘঁষা-মাজা করছেন। সন্ধ্য ঘনিয়েছে। দুর্বল দেহখানা আবার বিছানায় এলিয়ে দেন। শরীর কেমন যেবো নিঝুম হয়ে আসছে। গরমের দিনে শীত শীত লাগবে কেন? নিজেকে প্রশ্ন করে হারাধন। বড়মেয়ে কনিকাকে ডেকে বলেন, আমাকে একটা পাতলা কাঁথা দাও মা। শরীরটা ভালো লাগছে না। চারদিক নীরব হয়ে আসছে। কনিকা কাঁথা এনে বাবার শরীর জড়িয়ে দেয়। কাঁথাটা পুরো শরীর জড়িয়ে মাথা মুড়িয়ে নেয় হারাধন।
বাসায় সন্ধ্যাবাতি জ্বলে। ধূপ জ্বলে। রাত নামে। গত কয়েক মাস আগেও এমন অসময়ে হারাধন কখনও ঘরে থাকেনি। ঘুমানো তো দূরের কথা। রান্না ঘরের কাজ সেরে রুমে ঢুকে কানন বালা। স্বামীর মাথার কাছে বসে ডাকে, কী গো এ অসময়ে ঘুমিয়ে আছ? শরীরটা কী খুব খারাপ লাগছে? কোনো সাড়া শব্দ দেয় না হারাধন। কানন বালা ঘুম না ভাঙিয়ে ‘দৈনিক ভাঙ্গাগড়া’ পত্রিকাটি হাতে নেয়। আর মনে মনে ভাবে কী আছে এতে? হঠাৎ করে পত্রিকা হাতে দিয়ে দেখতে বললো কেন? আর তো কখনও এভাবে বলেনি। একটু ভালো করে দেখি।
খুঁজতে খুঁজতে কালো শেডের উপর লেখা ‘আয়া আবশ্যক’ বিজ্ঞপ্তিটি চোখে পড়ে। একটা বেসরকারি হাসপাতালে আয়া নিয়োগ দেওয়া হবে। বেতন প্রায় আট হাজার। পড়া শেষ করে আবারও পুরো পত্রিকার হেডলাইনগুলোতে চোখ বোলায় কানন বালা। হঠাৎ করে বাসায় পত্রিকা নিয়ে আসার কোনো মানে খুঁজে পান না তিনি। তাই হারাধন বাবুর নিকট দরদ গলায় জানতে চান, কী গো পত্রিকায় বিশেষ এমন কী আছে? বললে না যে। আমিতো কিছুই পেলাম না বলে গায়ে হাত দিয়ে আলতো ধাক্কা দেয়। কানন বালা পত্রিকায় চোখ রেখে গায়ে হাত দিতেই চমকে ওঠেন। পুনরায় দরদী ধাক্কা দেওয়ার বসনা ফিকে হয়ে যায়। হারাধনের কোনো সাড়া শব্দ নেই। শরীর হিম হয়ে গেছে। আমার কী হইলো গো... বলে চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারান কানন বালা।
বাংলাদেশ সময়: ১৮১৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০২, ২০১৮
এসএনএস