এই ঘোরে যে পড়ে সে বোধহয় একটু অন্য মনের মানুষ! লালন সাঁই, তার দেশ, তার জীবন এই নিয়ে আমরা বহু কথাই শুনেছি! আমার একবার অভিজ্ঞতা হয়েছিল বাউল শফি মণ্ডলের সঙ্গে যৌথভাবে অনুষ্ঠান করার! আমার কিছু কবিতা তার মাঝে তার গান, এই নিয়ে একটি টিভি চ্যানেলে অনুষ্ঠান হয়— এই কথাটা এই প্রসঙ্গে তোলার কারণ, আমি ব্যক্তিসচেতনতা থেকে যা লিখেছি তা আমার কবিতাই ছিলো কিন্তু ঘটনা বা সময়ের পারম্পর্য এমন ছিলো না যে, সেই গান বা কবিতাগুলির মেলবন্ধন হয়! বাউল গানের বোধকরি এটাই ক্ষমতা যে, তার মধ্যে পৃথিবীর সবমাত্রা বশীভূত হয়ে আছে! সেই সূত্র ধরে সেদিন যা পড়েছিলাম অজানা গানের চারণের সঙ্গে তারা যেনো নিজেই জীবন্ত মিলে যাচ্ছিল! এইভাবে দু’টো শিল্পকাঠামো একে অপরের সঙ্গে স্রোত বিনিময় করেছিলে লেখক ও গায়কের অজান্তে! কবিয়াল বিজয় সরকার (১৯০৩ থেকে ১৯৮৫) তার পঞ্চাশ বছরের জীবনে তিনি প্রধানত রামায়ণ গান ও কবিয়াল গান গেয়েছেন। শেষ জীবনে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
এরপরে আসা যাক কবি রাধারমণ দত্তের কথায়। তিনি সম্ভবত চক্রপাণি দত্তের বংশধর। কৃষ্ণপ্রেমে বিভোর হয়ে তিনি সংসার ছেড়ে দেন। এবং নলুয়া হাওরের পাশে এক আশ্রম বানান, সেখানেই নামসংকীর্তন হতো। বলা হতো তিনি ধ্যানমগ্ন অবস্থায় গীত রচনা করতেন। তার মৃত্যুর পর ভক্তরা তাকে বৈষ্ণব মতে রক্ষা করেন! তিনি তার চারণে লিখেছেন, “ভাইবে রাধারমণ বলে ঠেকলাম ভবের/ মায়াজালে/ আমি চাইয়া দেখি সব বিদেশী/ আপন দেশের কেহই নাই”। আবার লিখেছেন, “বৃথা জনম গেলো/ হারিয়ে বন্ধের নাম পড়িলাম জঞ্জালে”। আরও এক অপূর্ব চরণ, “তোর সনে নাই লেনাদেনা যে জন প্রেমের ভাও জানে না/ কানা চোরায় কৈলে চুরি ঘর থইয়া শিং বারে দেয়/ মিছামিছি কাটে মাটি চোরের বাটে মাল টানে না/ কুমারীয়ার পইলের মাটি মাটি হয় না পরিপাটি/ কাচা মাটিয়ে রং ধরে না পোড়া দিলে হয় সোনা”।
“না জেনে তত্ত্ব খুঁড়ে গর্ত কাল ভুজঙ্গ ধরিলে/ অপরে ছলিতে গিয়ে নিজে ছলে পড়িলে”— জীবনের ভাব আর মানুষের জীবনের আত্মাগত উচ্চস্তর বোঝাতে এবং এই মনুষ্যজন্ম! তা যে শুধু ভোগের নয়– প্রতিমুহূর্ত থেকে তা বোধের জন্য এসেছে আর তার বহুমাত্রিক ব্যস্ততা! এসবই তাদের গীতির মূল আলেখ্য!
বলা হয় বাতুল মানে উন্মাদ সেই থেকেই নাকি বাউল শব্দের আগমন, অর্থে পাগলের গান। এই গানের যে মূল তত্ত্ব তা আসলে বাউল তত্ত্ব! সাধারণ যাপনের একটি নিয়ম থাকে তার একটি ছাঁচ থেকে। এখন সমাজ তো এক ব্যক্তির মাধ্যমে গঠিত নয়, সেখানে সমন্বয় সাধিত হয়! ফলে তা নিয়ম বর্জিত হতে পারে না, তাই ভোলগা-গঙ্গার সময় ধরে ধরে আমরা নগরী স্থাপন করেছি। এ কথা বলাই যায়,অভ্যাস আর তার জালে উচ্চকিত বোধেরা ঢুকতে পারে না! কারণ, তারা প্রতিবর্ত ক্রিয়ার মতো ঘণ্টার নির্দেশে ধাবমান। এই লাইনের প্রতি এই সারির প্রতি যাদের অনাসক্তি আসে তারা হয়ে ওঠেন পাগল! অর্থাৎ এই পাগলামি আক্ষরিক পাগলামি নাও হতে পারে! জীবনকে নিয়মের বাইরে এসে জানা তো নিয়মের সাপেক্ষে পাগলামি কিন্তু মহত্তর বোধের কাছে তা জ্ঞানের রূপক!
তাই বাউল গানে এই দেহকেই পরম সম্পদ ধরা হয়েছে কারণ, এই দেহের আত্মার মূলগত অবস্থান! “মিলন হবে কত দিনে/ আমার মনের মানুষের সনে” এখানে প্রেম তো আছেই কিন্তু তা যে সর্বদা দু’টি আলাদা সত্ত্বার প্রতি তা কিন্তু নয়। এখানে বক্তা ও মনের মানুষটি একই দেহের হতে পারে! এই মনের মানুষ আসলে সেই দেহেরই আসল আত্মা বা পরমাত্মাকে জানার চেষ্টা! বাউল গানের অজস্র স্তর ও বিষয়ভেদ আছে। রূপ, গৌর, দেহ, মানুষ, জাতি, প্রেম, রাধা-কৃষ্ণ এমনিই অজস্র শ্রেণিতে এর বিভাজন আছে।
“বস্তুকেই আত্মা বলা যায়/ আত্মা কোনো মৌলিক বস্তু নয়”, লিখেছেন বিশিষ্ট বাউল কবি দুদ্দু শাহ (১৭৯৬-১৯০৭)। এই দীর্ঘ জীবনে দেশে-বিদেশে তার লোকগানের প্রতিষ্ঠা দেখে গেছেন। তার লেখনীর বেশীরভাগই খুব সিদ্ধান্তমূলক ও দৃঢ়। তার ঈশ্বর এবং মিলনভাবনায় নিরপেক্ষ দার্শনিক মন চারণে এই কথা তুলে আনে, “বেদ পুরাণে পাবে নারে/ নিরূপ নিরাকারে/ নিরাকারে জ্যোতির্ময় বসে আছে নিত্যস্থানে/ অনাদির আদি মানুষ/ আছে সে অতি গোপনে/ সেই মানুষ সাধ্য করে রাধাকৃষ্ণ বৃন্দাবনে”।
এই লাইনগুলি তুলে এনে বলতে চাই, সারা পৃথিবী খুঁজে আমরা দর্শনের অবগাহনের জন্য নির্মিলিত হই। অথচ এই অসাধারণ লোকগান জীবনের যে কী বিমূর্ত হিসেবের দিকে আমাদের কাঁপিয়ে দেয় তা আমরা ক্ষণিক বুঝেই বেমালুম জীবনের নিয়মে ডুগডুগি বাজাই।
জীবনের ভোগরসের মুহূর্তদের সরিয়ে সেখানে টুকরো বোধ আর মনের ক্ষিধেকে চিরন্তন করার জন্য এই দেহকে নিয়ে যারা নিদ্রা-জাগরণের খেলা খেলেন তারাই প্রকৃত বাউল। এই বাউল জলে আমরা ডুব দিয়ে আবার উঠে আসি, সমপর্ণ করতে পারি না! চোরাবালির ভয়ে দূর থেকে দেখি! বাউলের চরণ বোধকরি পৃথিবীর শেষ্ঠতম দর্শনের এক দিশা…
বাংলাদেশ সময়: ১৪৫৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৭, ২০১৭
এসএনএস