ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

গন্তব্য | সানাউল্লাহ সাগর

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০১৮
গন্তব্য | সানাউল্লাহ সাগর গন্তব্য | সানাউল্লাহ সাগর

দুই হাতেই ব্যাগ নিয়ে হাঁটছে রাজিব। রাত তেমন হয়নি। এরই মধ্যে অন্ধকার ঝেঁকে বসেছে কোর্টবাড়ি এলাকাটিতে। সদ্য গড়ে ওঠা এই আবসিক এলাকার মতো এখানকার সড়কগুলো অল্প রাতেই মানুষ শূন্য হয়ে যায়। তবে সুনশান নীরবতাকে একটু জিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ দিয়ে; মাঝে মধ্যে শালবন বিহার পেরিয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিক থেকে দু-একটা অটো রিকশা এখানে দেখা যায় কদাচিৎ।

শালবনের দিকেই যাচ্ছে রাজিব। এতোক্ষণ একটা অটো রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে অবশেষে হতাশ হয়ে দেখলো ঘড়ির কাঁটা চল্লিশ মিনিট পেরিয়ে গেছে।

তার আর ধৈর‌্যে কুলালো না। ভাবলো— এইটুকুন তো পথ। এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে না থেকে হেঁটে গেলে, বহু আগেই সে তার গন্তব্যে পৌঁছে যেতো। নিজের বোকামীর জন্য নিজেকেই বিড়বিড় করে গালি দেয়, ‘ধ্যাৎ দাঁড়াইয়া না থাইক্কা এতোক্ষণে হাঁটলেই অইতো’। রাজিবের মনের কথা মনেই ঘোরে। বাইরে বের হয় না। বের করতে দেয় না রাজিব। বের করেই বা কী হবে! এই তন্দ্রাচ্ছন্ন পথে নিজের পায়ের আওয়াজ শুনতে শুনতেই যখন তাকে হাঁটতে হচ্ছে তখন কে আর শুনবে তার কথা। মনে মনে ভাবে— সময়ের কাছেই তো আমরা সব অকপটে বলে দিই। ইচ্ছায়, অনিচ্ছায়। এই একটু বমির তৃপ্তি পাওয়ার জন্যই শ্রেণি বৈষম্য ভুলে, আভিজাত্যের অহংকার ভুলে, ঝুপড়ির মধ্যে বেড়ে ওঠা কিশোরীর বাড়ন্ত স্তনের দিকে চোখ চলে যায় সমাজের। হয়তো তাই হবে! তারপরও বমি করা যায় না। বমি করার জুতসই জায়গা খুঁজে পাওয়া যায় না।
 
রাজিবের হাত ব্যথা হয়ে যাচ্ছে। ব্যাগ ডানহাত-বামহাত করে নেয়। দু’টি ব্যাগের ওজন তেমন একটা তারতম্য নেই। তারপরও হাত পাল্টে নিজেকে একটু সান্ত্বনা দেওয়া।
 
আস্তে আস্তেই হাঁটছিলো। রাজিব একটু দাঁড়ায়। তার আরও দ্রুত হাঁটা উচিত। আরো দ্রুত। কিন্তু দূরের পথে অল্প ওজনও শেষ পর্যন্ত ভারী হয়ে ওঠে। দূরের পথ মানে— কতোটা দূরের পথ! মনে মনে মাপতে চেষ্টা করে রাজিব।
 
ঘণ্টাখানেক আগে যখন সে কোর্টবাড়ি বিশ্বরোড নেমে সিএনজিচালিত অটোরিকশার জন্য অপেক্ষা করছিল তখনও বুঝতে পারেনি যে, কোর্টবাড়ি থেকে শালবনের দিকে যেতে আসলে কিছু পাওয়া যাবে না। তাকে শেষ পর্যন্ত সেই আদম গাড়িতেই দৌড়াতে হবে!
 
বিশ্বরোডে বাইশ মিনিট অপেক্ষা করে একটা অটোরিকশা পেলো। কিন্তু অটোরিকশাটি কোর্টবাড়ি বাজার পর্যন্ত আসবে। শালবনের দিকে যেতে রাজি হলো না। রাজীব কিছু না ভেবেই রাজি হয়ে সেটায় উঠে পড়লো। ভাবলো অন্তত ওই পর্যন্ত যাওয়া যাক, তারপর কিছু না কিছু তো পাওয়াই যাবে।
 
ঢাকা থেকে এসে কোর্টবাড়ি বিশ্বরোড নামা পর্যন্ত তার মধ্যে এক ধরনের চিন্তা ঢেউ তুলেছিল। কিন্তু রয়েল কোচ থেকে নামার পর অটোরিকশার জন্য অপেক্ষার বাইশ মিনিট তাকে হাঁটিয়েছে প্রায় এগারোটি বছর। যে এগারোটি বছরের প্রতিটি মাস, সপ্তাহ, দিন, ঘণ্টা, মিনিটগুলো পর্যন্ত রাজিবের কানে মুখ ঘঁষেছে। তবে তারা কোনো কথা বলেনি। শুধুই ঘোঙাচ্ছিলো। তাহলে কি তারা বোবা হয়ে গেছে! রাজিব নিজের মধ্যে ডুব দেয়। তুলে আনতে চায় সেই কথা বলা সময়। যারা পর্যায়ক্রমে কথা বলা শেখাবে এই বোবাঘড়িকে। যে টিকটিক করে বাজবে। আর সিনেমার দৃশ্যের মতো কথা বলে যাবে অনর্গল। কথা বলবে, শিফা-সীতাকুণ্ড, সেই বহদ্দারহাট, সেই অদম্য উচ্ছ্বাস...
 
হাত থেকে ব্যাগ রাস্তার পাশে রাখে। তলপেটে জমে ওঠা অনেকক্ষণের পানি বিসর্জনের জন্য দাঁড়ায়। যে চাপ সেই পথের মধ্য থেকে এই কোর্টবাড়ি পর্যন্ত বয়ে এনেছে। এখন হাঁটতে গিয়ে সেটা আবার ফুলে ব্যথা হয়ে যাচ্ছিল। রাস্তার বাম পাশে একটা বাড়িতে লাইট জ্বলছে। সেদিকে চোখ যায় রাজিবের। বাড়ির সামনে একটি কুকুর। রাজিব হাসে। মনেমনে গালি দেয়— ‘আরে শালার কুত্তা! জগতের সব পাল্টে গেলো তোরা পাল্টাইলি না। এখনও ফেন খাওয়ার মজুরি দেও; বাড়ি পাহারা দিয়ে। তার চেয়ে মানুষ হয়ে যা সময় সময় চেহারা পাল্টে ফেলতে পারবি’।
 
রাজিবের এসব চিন্তা সামনের বাড়ির দরজা জানালা পেরিয়ে এঘর-ওঘর ঘুরে ঘুরে একেবারে বেডরুমের মধ্যে চলে যায়। সে দেখতে পায় ডিম লাইটের আলোয় একটা বস্তা নিয়ে ধস্তাধস্তি করছে বিপরীত লিঙ্গের একজোড়া মানুষ। তাদের চোখে মুখে রহস্য। রাজিব সামনে আগায় না। নিজেকে থামিয়ে রাখে। যেমনভাবে গত পাঁচটি বছর নিজেকে থামিয়ে রেখেছে।
 
সেই পাঁচ বছর আগে শিফার বোন নিতুর কাছ থেকে শুনেছিল মাহবুবের মৃত্যুর খবর। শিফার বর মাহবুবের সাথে কখনও দেখা হয়নি রাজিবের। কিন্তু তার মৃত্যুর সংবাদ শোনার পর মাহবুবকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল। সেই ইচ্ছেকে দমিয়ে রেখেছে রাজিব। দেখতে ইচ্ছে করলেই সে দেখতে পারতো না। তখন সে অবস্থা ছিলো না। তাছাড়া অনেক যুক্তির সামনে দাঁড়াতে হতো তাকে। তখন সেই যুক্তি দাঁড় করানো এই সমাজকে, প্রচলিত দেশ নামক কলকে মনেমনে অনেক গালি দিয়েছে রাজিব। যে গালি কখনও কোনো মানুষের সামনে সে দিতে পারেনি। পারবেও না। কারণ, সেই সাহস রাজিবের মতো মানুষের থাকে না। যারা হামাগুড়ি ভুলে দাঁড়িয়েছে। মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে যাদের অনেক ভাবতে হয়। রাজিব সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। কিছুই করতে পারেনি। কখনও নিজেকে ছাড়িয়ে যেতেও আর ইচ্ছে করেনি তার। সেই চেষ্টাও করেনি। ভাবে, কিইবা হবে ব্যর্থ দৌড়ে নিজেকে ব্যস্ত রেখে! এইসব কঠিন সিদ্ধান্ত তার নিতে হয়েছিল আরও নয় বছর আগে।
       
শিফার সাথে বিয়েটা ভেঙে যাওয়ার পর দু’বছর কোনো কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারেনি রাজিব। আর সেই দু’বছরের প্রতিটি কঠিন মুহূর্ত রাজিবের কোমল মনটাকে আস্তে আস্তে পাথরে পরিণত করে দিয়েছে। সেই পাথর আরও শক্ত হয়ে যায় যখন সে জানতে পারে শিফা আবার বিয়ে করেছে। লেফটেনেন্ট পদবীর একজন অফিসারের কাছে শিফা কেমন থাকবে? কেমন করে তাদের বাতিবন্ধ সিনেমা বা বাতি জ্বালা নাটক চলবে! এসব খুব বেশি ভাবায়নি রাজিবকে। কিন্তু রাজিবকে ভাবাতো, শিফা যেমন বাচ্চামানুষ— অফিসারের সাথে সংসারটা হয়তো ভেঙেই যাবে। আবার একটা নাটকের গল্প জানতে হবে তাকে। কিন্তু তেমন কোনো নাটক জানতে হয়নি রাজিবকে। দু’বছর যেতে না যেতেই অফিসারের ঘরে একটি মেয়ের জন্ম দেয় শিফা। এরপর আর কোনোরকম আশার জায়গা থাকে না রাজিবের।
 
তখন থেকে রাজিবের বেঁচে থাকার নতুন মিশন শুরু হয়। স্রোতের বিপরীতে দাঁড়ানোর পণ থেকে সরে আসে। অকপটে টাকার টানে ঢাকার গলিপথে চলতে থাকে, দৌড়াতে থাকে। কোথায় চলছে! কেন চলছে? মনের মধ্যে ফুঁসে ওঠা এসব প্রশ্নকে পাত্তা দেয়নি সে। কেবল মনকে বুঝিয়েছে তাকে বাঁচতে হবে। বাঁচাতে হবে একটি পরিবারকে। এতো বছরের মধ্যে রাজিবের সাথে কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি ঠিক তা নয়। তবে সেগুলোর কোনোটাই শরীর অতিক্রম করতে পারেনি। একসময় প্রেমহীন শরীরে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে রাজিবের শরীর। অনেক বছর আর শিফার কোনো খোঁজ নেওয়া হয় না তার। প্রথম দিককার শিফার উপর অভিমান-অভিযোগ ছিলো না রাজিবের। কিন্তু অফিসারের সাথে সেচ্ছায় বিয়ে করা, বাচ্চা হওয়ায় অনেক রাগ, ক্ষোভ, অভিযোগ জমা হয় শিফার প্রতি। সেই কাঠগড়ায় অনেক বড় অপরাধী হয়ে ওঠে শিফা। আবার দিনে দিনে শরীর পাল্টে পাল্টে সেগুলো ঢিলেও হয়ে যেতে থাকে রাজিবের মনের অজান্তেই।
              
শিফার সাথে রাজিবের পরিচয়টা অনেকটা সিনেমার মতোই। সীতাকুণ্ডের জোড়া পাহাড় চন্দ্রনাথ থেকে নামছিলো দুই বন্ধু। এই প্রথম এতো উচ্চতার কোনো পাহাড়ে ওঠে সমতল ভূমিতে বেড়ে ওঠা দুই যুবক। ক্লাসের পাঠ্য বাদে কখনও কোনো কবিতা, গল্প পড়ার মতো ইচ্ছে জাগেনি রাজিবের। পাহাড়ের এই সবুজ আর ডালে ডালে হাওয়ার নাচন দেখে মনটা নিশপিশ করে ওঠা ছেলেদের কাতারে সে না। সেই কারণেই এই দৃশ্য তাকে উদাস করে দিতেও পারেনি। কেবল দেখার জন্য দেখা আর ঘাম ঝরানো। হঠাৎ করে শুরু হওয়া এরকম বৃষ্টির এতো বড় ফোঁটা এর আগে দেখেনি কখনও। শুনেছে পাহাড়ি বৃষ্টি ভয়ংকর। তবে বৃষ্টিটা স্থায়ী হলো না। সিঁড়ি দিয়ে নামনে নামতে ওরা টের পাচ্ছিল এই সিঁড়ি কতোটা পিচ্ছিল হয়ে গেছে। একবার পিছলে পড়লে সোজা...।  
 
শৈশবের দৌড়-ঝাঁপ আর প্রথম যৌবন কেটেছে ক্রিকেট প্রেমে। যে কারণে মা-বাবার তির্যক বাক্যবাণেরও কমতি ছিলো না তার প্রতি। কিন্তু বরাবরই বড়বোনের ওকালতিতে বেঁচে যেত রাজিব। বড়বোন মেধাবী ছাত্রী হওয়ায় পরিবারে তার একটা আলাদা গুরুত্ব ছিলো। সে যখন রাজিবের পক্ষে ওকলতি করতো তখন একবারে বেকসুর খালাস হয়ে যেতো। তবে পড়াশুনা বেশি দূর হয়নি রাজিবের। মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে আর কলেজমুখী করা যায়নি তাকে। সে কারণে তার উকিলকেও বকাঝঁকা খেতে হয়েছে শেষের দিকে। সেসব অনেক বছর আগের গল্প।
 
সেই বড়বোনের বাসায়, সীতাকুণ্ডে বেড়াতে এসেছিল। বোনজামাইয়ের চাকরি সূত্রে তারা সীতাকুণ্ডেই থাকে।
 
কিছুদূর নামার পর একটা ছাউনির মতো জায়গায় তারা সিগারেট ধরানোর জন্য দাঁড়ালো। সিগারেট জ্বালাতে গিয়ে রাজিবের চোখ আটকে গেলো পনেরো-ষোল বছরের এক মেয়ের প্রতি। তার সাথে আরও দু’জন। একজন মেয়ে ও একজন ছেলে। পরে রাজিব জেনেছিলো খালাতো বোনের প্রেমের পাহারাদার হিসেবে শিফাকে তারা সঙ্গে এনেছিল।
 
গল্প, উপন্যাসের চরিত্রদের মতো প্রথম দেখায়ই শিফার চোখে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল রাজিব। যদিও সে কোনোভাবেই প্রথম দেখায় মেয়েটির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি। অবশ্য সেরকম খুব বেশি চেষ্টাও তখন তার ছিলো না। কিন্তু রাজিব হিসেব-নিকেষ না করেই মেয়েটিকে তার বাড়ি পর্যন্ত অনুসরণ করলো। একথা না বলে এটা বলা ভালো যে— শিফার চোখ রাজিবকে তার বাড়ি পর্যন্ত টেনে নিয়ে গিয়েছিল। দুই বন্ধু মিলে অনেক কৌশল করে দ্বিতীয় দিনই শিফার সাথে দেখা করলো। কথা বললো। তৃতীয় ও চতুর্থ দিন শ্রম দিয়ে পঞ্চম দিনে শিফাকে রাজি করিয়ে ফেলেছিল রাজিব। আর বাকি ঘটনাগুলো ঘটে গিয়েছিল মাত্র একমাস সাত দিনের মধ্যে। পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করা, ঢাকায় এক অপরিচিত লোকের বাসায় বাসর রাত কাটানো, মেয়ের বাবার করা মামলায় জেলে যাওয়া, সব যেনো চোখের পলকের মধ্যেই হয়ে গিয়েছিলো।
 
সেই মামলায়ও রাজিবের ত্রাণকর্তা তার শৈশবের উকিল বোন। রাজিবকে রক্ষা করে একটা মীমাংসার ব্যবস্থা করেছিল। শিফাকে দিয়ে ডিভোর্স দিইয়ে ছিলো তার প্রভাবশালী ব্যবসায়ী বাবা। মামলা তুলে নেওয়ার আগে শর্ত ছিলো— তার মেয়েকে কোনো রকমভাবে বিরক্ত করতে পারবে না রাজিব। রাজিব কখনই শিফাকে আর বিরক্ত করেনি। তার মনে হয়েছিল, নবম শ্রেণি পড়ুয়া মেয়ের কম বয়সের কারণে কিডনাপিং কেইসে ফেঁসে বিয়েটা টেকাতে পারেনি। তবে শিফার বয়স আঠারো হলে তারা আবার বিয়ে করবে। কিন্তু তা আর কখনই হয়নি।
       
এইচএইচসি পাশের পরই যোগ্য পাত্র খুঁজে শিফাকে বিয়ে দিয়ে দেয় তার বাবা। এই খবর জানার পর রাজিবের কলিজায় চোট লাগে ঠিক; কিন্তু মনে হয় পাত্র তো সত্যিই যোগ্য। লেফটেন্টে অফিসার। রাজিবের মনে হয় তার সম্পর্কে কোনো তথ্যই হয়তো দেওয়া হয়নি এই পাত্রকে। আর পাত্রও শিফার মতো ওই রকম আগুন রূপসীকে দেখে হয়তো গলে গেছে। অথবা শিফাও অফিসারের কাছে সব কিছু লুকিয়েছে।
 
রাজিব হাতের ভারসাম্য রক্ষা করতে আবার ব্যাগ পাল্টায়। হাত লাল হয়ে গেছে। ব্যথা করছে। নিজেকে বোঝায় সে— ‘আর তো সামান্যই পথ। একটু কষ্ট না হয় করি’।
 
শালবন বিহারের প্রত্নতত্ব জাদুঘর পার করে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোড় এখনও পার হয়নি রাজিব। এর মাঝামাঝি জায়গাটা অতিক্রম করছে মাত্র।
 
রাজিবের পাশ দিয়ে সাঁই করে একটা অ্যাম্বুলেন্স চলে গেলো।
অন্যমনস্ক রাজিব চমকে ওঠে।
অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ শুনলে রাজিবের মনটা খারাপ হয়ে যায়। তার মায়ের কথা মনে পড়ে। নিজেকে বারবার অপরাধী মনে হয়। মনে হয় আরেকটু সচেতন হলেই সে তার মাকে বাঁচাতে পারতো। রাজিব সামনে হাঁটতে থাকে। লেফটেনেন্ট থেকে মেজর হয়ে ওঠা মানুষটা আবারও তার ভাবনার মধ্যে চলে আসে। এই মানুষটার প্রতি কখনও ঈর্ষা হয়নি তার। আর এখন মরে যাওয়া মানুষের প্রতি ঈর্ষা পুষে কী করবে। সব রাগ, ক্ষোভ ঝেড়ে ফেলেছে রাজিব। অফিসারের মরে যাওয়া ছাড়াও অনেক বছর তাকে কোনোভাবে তেমন প্রভাবিত করেনি শিফা। রাজিবের সবসময় মনে হয়েছে, কোথায় প্রাণ-আরএফএলের টিএসএম আর কোথায় মেজর! কিন্তু বিডিআর বিদ্রোহের ছয় দিন পর রাজিবকে শিফার ছোটবোন ফোন করে মেজরের মৃত্যুর খবর দিয়েছিল। কেন দিয়েছিল! সেটা রাজিব জানে না। হয়তো শিফার ছোটবোনও জানে না। সেটা ওই শোনা পর্যন্তই।
 
এইসব জানার পরও রাজিব শিফার সঙ্গে একবারের জন্যও যোগাযোগ করেনি। সে হয়তো তাকে সান্ত্বনা দিতে পারতো। কিন্তু কী সান্ত্বনা দিতো! কিছুই তো আর করার ছিলো না তার।
 
হাঁটতে হাঁটতে অনেক প্রশ্নের জবাব খোঁজে রাজিব।
সন্ধ্যায় আসা ফোনের মানুষটিকে প্রথমে চিনতে পারেনি। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে নারীকণ্ঠ, ‘আমি শিফা। তুমি কি একটু কুমিল্লা আসতে পারবে? কোর্টবাড়ি। কুমিল্লা ইউনিভার্সিটি পার হয়ে সোজা রাস্তায় এসে ফোন দিও’।
 
রাজীবকে কোনো কথার সুযোগ না দিয়েই অপর প্রান্তের নারীকণ্ঠ ফোন রেখে দেয়। রাজিব ততোক্ষণে চিনে নেয় নারী কণ্ঠের মানুষটিকে। আর তখনই অফিসের বসকে একটা মেসেজ দিয়ে বের হয়ে পড়ে। অটোরিকশার দৌড়ে অবশেষে নয়টার শেষ বাসটা পেয়ে যায় সে।
 
সারা পথে মাথাটা ঘুরেছে তার। মাথা ঘুরছে না চোখ খেলছে; সেটা বুঝতেও কষ্ট হয়েছে রাজিবের। সব এড়িয়ে একটাই চিন্তা তার— শিফা ডেকেছে। তার কাছে যেতে হবে। শিফার কাছে যাচ্ছে রাজিব…
       
রাস্তার মাঝে একটা খাদে পড়ে দেশের উন্নয়নের অংশীদার হয় রাজিব। পা তুলে দাঁড়াতে গিয়ে খেয়াল করলো ব্যথা লাগছে। সহজ করে কদম ফেলতে পারছে না। ব্যাগ থেকে বের হয়ে পড়া আট বছর আগে কিনে রাখা শাড়ি ও শিফার প্রিয় বডি স্প্রে ব্যাগে ভরে অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ায়। এতো বছর সাথে করে ঘ্রাণ নিয়েছে। কিন্তু এই শাড়িটা আজ শিফাকে ছোঁবে। হয়তো রাজিবও শিফার ঘ্রাণ উড়তে থাকা হাওয়ায় নিজেকে ওড়াবে! পা টেনে টেনে হাঁটতে থাকে রাজিব। কোথায় যাচ্ছে সে!
 
ইউনিভার্সিটি পার হয়ে সেই নম্বরে ফোন করে রাজিব। অপর প্রান্তের কণ্ঠস্বরটা আলাদা। তবে সেই কণ্ঠস্বরকেও চেনে রাজিব। এখন অপর প্রান্তে যে কথা বলছে সে শিফার ছোটবোন নিতু। ফোন রিসিভ করে রাজিবকে কিছু বলতে সুযোগ দেয় না সে। যা বলার নিতুই বলে দেয়। মাথা ঘুরতে থাকে রাজিবের। রাস্তার মধ্যেই বসে পড়ে সে। বারবার পিছনে তাকিয়ে একটু আগে চলে যাওয়া অ্যাম্বুলেন্সের খোঁজে তার চোখ উড়তে থাকে...
 
বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০১৮
এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।