নিজের লেখালেখি নিয়ে এভাবেই বলছিলেন বাংলা ভাষার বরেণ্য কথাসাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। শনিবার (১০ নভেম্বর) ঢাকা আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসবের (ঢাকা লিট ফেস্ট) শেষ দিনে ‘শীর্ষেন্দুর সঙ্গে কথোপকথন’ শীর্ষক সেশনে কথা বলছিলেন তিনি।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘নিজের কাছে লেখা পছন্দ না হওয়া পর্যন্ত আমি চেষ্টা করে যাই। আমি সবসময় একটা চেতন-অবচেতনে বিরাজ করি। অনেক সময় মনেও থাকে না আমি লেখক। অদ্ভুত ধরনের এক অন্যমনস্কতা কাজ করে। রাস্তাঘাটে আমি খুবই অনিরাপদভাবে চলাচল করি। ’
আরও পড়ুন>>> সুন্দরের আহ্বানে পর্দা নামলো লিট ফেস্টের
সাহিত্যে অনন্য অবদানের জন্য বিদ্যাসাগর পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার, সাহিত্য অাকাদেমি পুরস্কার, বঙ্গবিভূষণসহ বিভিন্ন সম্মাননায় ভূষিত এ লেখক বলেন, ‘আমি যখন লেখালেখি শুরু করি, তখন আমার লেখা কেউ বুঝতে পারতো না। সেজন্য আমি জনপ্রিয় লেখক হতে পারিনি। আমার মধ্যে তখন ভয় কাজ করতো, আমার লেখা যদি কেউ বুঝতে না পারে তাহলে আমার পত্রিকা থেকে চাকরিটা না চলে যায়!’
শীর্ষেন্দু স্মরণ করেন, ‘আমার প্রথম উপন্যাস ‘ঘুণপোকা’ পড়ে কেউ কেউ বলেছিলেন- “ওর লেখা পড়ো না, মন খারাপ হয়ে যায়”। আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম তা শুনে। কিন্তু লিখতেই সবসময় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতাম। তাই ওগুলোকে বাধা হিসেবে দেখিনি কখনো। ’নিজের লেখার ধরন নিয়ে দুই বাংলার জনপ্রিয় এ লেখক বলেন, ‘আমার লেখার কোনো ছক নেই, পরিকল্পনা নেই। আমার লেখার ধরন অদ্ভুত। লিখতে বসার আগে পর্যন্ত জানি না কী লিখবো। একটা মনে ধরার মতো লাইনের জন্য অপেক্ষা করি। যদি ওই বাক্যটি পছন্দ হয় লিখতে শুরু করি। এমনও হয়েছে বাক্যে একটি শব্দ খুঁজতে গিয়ে ১২-১৩ দিন লিখতে পারিনি। আবার কোনো কোনো দিন ১২-১৩ ঘণ্টা টানা লিখে গেছি। আমার লেখার ধরন অনেকটা তুলোর গুটি থেকে সুতো পাকানোর মত। ধীরে ধীরে একেকটি চরিত্রকে দেখতে পাই। তাদের মুখ, শরীর কাঠামো, পোশাক ভেসে ওঠে চোখের সামনে। তাদের জীবনযাত্রা, কথা দেখতে পাই। তখন আমার গল্প, উপন্যাস যেন হয়ে ওঠে একটি প্রতিবেদন লেখার মতো। তবে এভাবে লেখা প্রত্যাশিত নয়। আমার লেখার ধরনটা বৈজ্ঞানিকও নয়। কিন্তু আমি নিরুপায়। ’
এসময় উঠে আসে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দেবদাস’ উপন্যাস প্রসঙ্গ। এ নিয়ে ‘দূরবীন’ ও ‘মানবজমিন’ লেখক শীর্ষেন্দু বলেন, ‘দেবদাস উপন্যাসে লজিকের খুব অভাব। শরৎচন্দ্র অল্প বয়সে লিখেছিলেন। ওই বয়সে বুদ্ধি পাকে না। সেজন্য লেখায় গ্যাপ রয়েছে। কিন্তু স্টোরি টেলিংয়ে শরৎচন্দ্রের মতো ম্যাজিশিয়ান বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয়জন নেই। ওই রকম একটা উপন্যাস এ অঞ্চলের মানুষ গত ১০০ বছর ধরে পড়ছে। তার কষ্টে চোখের জল ফেলছে। ’
‘একজন মানুষ ব্যক্তি জীবনযাপনে অনেক টুকরোতে বিভক্ত হয়ে জীবনযাপন করে। স্ত্রীর স্বামী, সন্তানের বাবা। আমিও তাই’- বলেন শীর্ষেন্দু। ৮৩ বছর বয়সী লেখক বলে চলেন, ‘মানুষের জীবনের চলার পথে কিছু গর্ত রয়েছে। যা এড়ানো যায় না। মানুষ ভেতরে ভেতরে নিষ্ঠুর, কখনো কখনো খুব দয়ালু হয়ে ওঠে। মনের সঙ্গে এই খেলা চলে, যাকে আমরা বুঝতে পারি না। মনের মধ্যে এমন ভাবনা আসে যা প্রকাশ করা যায় না, যাকে আমরা বোতলবন্দি করে রাখি। কিন্তু মনের মধ্যে সেটা থেকে যায়। আমি এই বিচিত্র জীবনকে দেখি। জীবন কতোভাবেই না প্রকাশিত হচ্ছে। সেটিও দেখি রাস্তায় ঘুরে ঘুরে। ’
‘শীর্ষেন্দুর সঙ্গে কথোপকথন’ সেশনের মধ্য দিয়েই শেষ হয় দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ সাহিত্য উৎসব ‘ঢাকা লিট ফেস্ট’। তিন দিনের উৎসবে ৯০টির বেশি সেশনে ১৫ দেশ থেকে দুই শতাধিক শিল্পী সাহিত্যিক গবেষক অংশ নেন।
বাংলাদেশ সময়: ২১২১ ঘণ্টা, নভেম্বর ১০, ২০১৮
এইচএমএস/এইচএ/