শুক্রবার (২৯ নভেম্বর) সন্ধ্যায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় উদ্বোধনী মঞ্চায়ন হলো পান্থ শাহরিয়ারের রচনা ও নির্দেশনার এ নাটকটি। নাটকের গল্পের সঙ্গে মিশে আছে জাহাজভাঙা শিল্পের সঙ্গে জড়িত সাধারণ মানুষ।
নির্দেশকও জানালেন তেমন কথা। শেক্সপিয়ারের 'মার্চেন্ট অব ভেনিস' গল্পটির আবহ এসেছে এ নাটকে। তবে তার সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুনত্ব। তা হলো আমাদের দেশের বর্তমান সময়। জাহাজভাঙা শিল্প!
এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের দুর্ঘটনার কথা মাঝে মধ্যেই উঠে এলেও খুব হালকাভাবেই তা দেখি আমরা। কিন্তু তাদেরও রয়েছে আমাদের মতোই সমাজ। তবে সেটি ভীষণ কঠিন আর কালো। প্রতিদিন সকালে মৃত্যুকে সঙ্গে নিয়েই যেন কাজে যায় তারা। প্রাণহীন জাহাজের ভাঙা টুকরার মতোই যেন ইস্পাত কঠিন তাদের ভেতরটা। এই মানুষগুলো যেন রাষ্ট্র, সমাজবহির্ভূত অন্য কোনো এক জগতের। সেই জগতের হাসি-কান্না-দুঃখের সঙ্গে শেক্সপিয়ারের 'মার্চেন্ট অব ভেনিস'র চুম্বক অংশ জুড়েই নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের নতুন নাটক 'কালো জলের কাব্য'।
নাটকের কাহিনিতে দেখা যায়, জাহাজভাঙা শিল্পের শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ‘ভাঙাড়ি' নামক এক লোকের হাতে। সেখানে মেরুদণ্ডহীন দারোগাও ভাঙাড়ির হাতের পুতুল। জাহাজভাঙা জিনিসপত্র কেনা-বেচা করা, চড়া সুদে ধার দেওয়া ব্যাপারগুলো এক ধরনের খেলায় পরিণত হয় ভাঙাড়ির কাছে। এরই মাঝে 'সুদখোর' হিসেবে আখ্যা দেওয়ায় ভাঙাড়ির নির্লিপ্ত রাগ উঠে আসে শ্রমিক এন্তাজের উপর। সে যেন দিন গুনতে থাকে কবে এন্তাজ এসে ধার চাইবে ভাঙাড়ির কাছে।
একদিন ভাঙাড়ির হয়ে কাজ করা চোর বাশার জাহাজের একটি বাক্সের ভেতর থেকে উদ্ধার করে একটি মেয়েকে। সেই মেয়ে ভাঙাড়িকে বলে তার কোনো নাম পরিচয় নেই। তাই ভাঙাড়ি তার নাম দেয় 'পদ্ম'। কি যেন এক নিজের মতো ছায়া দেখতে পেয়ে পদ্মকে মেয়ের জায়গায় বসিয়ে ফেলে ভাঙাড়ি। এদিকে পদ্মের প্রতি প্রেম জন্মে বাশারের। সে তখন এ কথা জানায় এন্তাজকে। শ্রমিক এন্তাজ ছোট ভাইয়ের মতো বাশার আর পদ্মের ভালোবাসার পূর্ণ একটি পরিণতি ঘটাতে গিয়ে প্রায় বাধ্য হয়েই টাকা ধার নেয় ভাঙাড়ির কাছ থেকে।
টাকা ধার দিলেও এন্তাজকে ভাঙাড়ি শর্ত দেয় যে, সঠিক সময়ে টাকা পরিশোধ করতে না পারলে এন্তাজের বুক থেকে এক কেজি মাংস কেটে নেবে সে। অগত্যা কোনো উপায় না দেখে এই শর্তেই রাজি হয় এন্তাজ। আর ঝড়ের শুরুটা এখান থেকেই! এখানেই মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় বাংলাদেশের এক জাহাজ ভাঙা শিল্পের সাধারণ জীবনের সঙ্গে শেক্সপিয়ারের মার্চেন্ট অব ভেনিস'।
নাটকের শেষ প্রান্তে ভাঙাড়ির পরম পরিণতিতে দর্শক জানতে পারে দরিয়ার পানি কিভাবে নীল থেকে কালো হয়ে যায়। সে কথা দর্শককে জানাতে গিয়ে ভাঙাড়ি বুঝতে পারে, দরিয়ায় ভাইসা আসা মানুষ কোনোদিন নিজের হয় না! তবুও সে হার মানে না। বরং জিতিয়েই রাখে নিজেকে!
মূর্ত-বিমূর্ত কথামালা, একটি নির্দিষ্ট সমাজের নিজস্ব সংস্কৃতি আর দুঃখগাঁথা কাহিনীগুলো শিল্পীদের পরম ভঙ্গিমায় আঁচল পরায় গল্পের শরীরে। গল্প এগিয়ে যায় কুশীলবের কাঁধে ভর করে দর্শকের মনোভূমে। এমন একটি নাটকের রস আস্বাদনের সুযোগ পেয়ে তৃপ্ত হন তারা। বলেন, মানবতার জয়যাত্রা তুলে ধরা হয়েছে নাটকটিতে। অভিনয়ে দক্ষতা দেখিয়েছে অভিনেতারা।
শেষে নাটক প্রসঙ্গে নাট্যকার নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাংলানিউজকে বলেন, নাটকটি আমার ভালো লেগেছে। দলগত জায়গা থেকে উপস্থাপনা, দৃশ্য পরিকল্পনা খুবই ভালো ছিল। এই নাটকটি নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের একটি বাঁক-বদল বলা যেতে পারে।
নাটকটিতে গাঁথুনির সমস্যা আছে উল্লেখ করে রামেন্দু মজুমদার বলেন, নাটকটির মধ্যে অনেক চিন্তার খোরাক আছে এবং শেক্সপিয়ারকে অবলম্বন করে, দূরবর্তী অবলম্বন করে এখানকার জাহাজভাঙা শিল্পের মানুষদের দুঃখ-দুর্দশার কথা তুলে ধরা হয়েছে। আমার মনে হয় যে একটু গাঁথুনির সমস্যা আছে নাটকটির মধ্যে। তবে সবচেয়ে বড় পাওয়া হচ্ছে আসাদুজ্জামান নূরকে আবার অভিনয়ে পেলাম।
কালো জলের কাব্য নাটকটিতে ভাঙাড়ির চরিত্রে অভিনয় করেছেন বিশিষ্ট অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর এবং পদ্ম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন অপি করিম। মঞ্চ পরিকল্পনা করেছেন সাইফুল ইসলাম (প্রাচ্যনাট)।
নাটক সম্পর্কে এর রচয়িতা ও নির্দেশক পান্থ শাহরিয়ার বাংলানিউজকে বলেন, পৃথিবীর অনেক দেশেই এখন ক্ল্যাসিক গল্পগুলোকে নিজেদের আঙ্গিকে ফেলে তৈরি করা হচ্ছে নতুন নতুন নাটক। এটিও ঠিক তেমনি একটি। তবে এটি একান্তই আমাদের। মার্চেন্ট অব ভেনিস থেকে কিছু নেওয়া হয়েছে ঠিক, কিন্তু পুরো বিষয়বস্তুটাই আমাদের নিজেদের। সবকিছু মিলেয়ে আমাদের আঙ্গিকে করার একটি চেষ্টাই করা হয়েছে এই কালো জলের কাব্যে।
বাংলাদেশ সময়: ০৪৫৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩০, ২০১৯
এইচএমএস/এএ