আধুনিক যন্ত্রসভ্যতার ক্রমায়ত পথযাত্রায় বাঙালি জাতির আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক জীবনে যে আলো- অন্ধকারের দোদুল্যমানতা, অনিশ্চয়তা ও অবক্ষয় এসেছে; সম্পূর্ণরূপে না হলেও অনেক কবির কবিতাতেই আমরা তার দ্বন্দ্বময় উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করেছি।
অবশ্য প্রলম্বিত লয়ে হলেও কাব্যভাষা, শৈলী, প্রতীক ও চিত্রকল্পের প্রচলিত পরিকল্পের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করে অনেকেই পাশ্চাত্য দর্শন ও রহস্যময়তার ভাবলোকে অবগাহনের প্রচেষ্টায় হয়েছেন আত্মমুখী এবং আত্মকেন্দ্রিক।
সুতরাং সমাজ, সময় ও সমকালস্পর্শী জীবনাগ্রহের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে দূর দিগন্তে উড্ডয়নের ঐকান্তিকতার নামই কবিতা। তবে দীর্ঘকাল ধরে আলোর দাপটে সেই অন্ধকার জগৎ ছিল পর্যদুস্ত।
কিন্তু তরুণ কবি ইমরান মাহফুজ তার ‘দীর্ঘস্থায়ী শোকসভা’ গ্রন্থে সেই বিবমিষার ধূসর জগতকেই আঁকতে চেয়েছেন নিঃসঙ্কোচে।
‘দীর্ঘস্থায়ী শোকসভা’ ২০০৫ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে মা, মাটি, মানুষ, নদী, নারী প্রকৃতি, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি কবির দৃষ্টিভঙ্গির সানুপুঙ্খ রূপায়ণ। এ কবিতাগুলোর দ্বারা তিনি শিল্পের জমিতে বাস্তবতার বীজ প্রোথিত করেছেন, যার অপূর্ব সুবাস অনুপম মোহে আচ্ছন্ন করে তোলে পাঠককে; আর পাঠকের চিত্তকে করে তোলে দ্বিধাদীর্ণ।
উপরন্তু ‘মাধ্যমিক সকাল: গাছের ছায়ায় মাছের জীবন’, ‘উচ্চ মাধ্যমিক সকাল: মেঘের আয়োজনে নগরে মিছিল’ ও ‘সম্মান সকাল: মুখোশের পাঠশালায় ঘাসফুলের কান্না’ শীর্ষক তিনটি পর্বে কবিতাগুলোকে ভাগ করে কবিতাকে জীবনের সঙ্গে সমীকৃত করেছেন কবি।
এ ধরনের অভিনব চিন্তা তার লেখাকে কেবল চমকপ্রদই করেনি, লেখায় নিয়ে এসেছে নতুন সুর। জীবনানন্দ বলেছিলেন, ‘সকলেই কবি নন। কেউ কেউ কবি। ’ ইমরান মাহফুজের কবিতা সচেতনভাবে পাঠ করলে তাঁকে কবির তকমা দিতে তিলমাত্র ভাবতে হয় না। কালের স্রোতে হারিয়ে যাওয়ার জন্য যে ইমরান কাব্যজগতে পদার্পণ করেননি তার শক্ত প্রমাণ ‘দীর্ঘস্থায়ী শোকসভা’।
বর্তমানে পুঁজিবাদের করাল গ্রাসে সমগ্র বিশ্ব আক্রান্ত; ক্ষত - বিক্ষত সমাজ, সময়, শিল্প ও সাহিত্য। সভ্যতার বিপর্যস্ত কঙ্কালের ওপর দাঁড়ালে কবিতাও মূক হয়ে ওঠে, হয়ে ওঠে সন্ত্রস্ত। কবিতা অন্তর্দৃষ্টির সর্ববিস্তারী নির্যাস। কিন্তু সংঘর্ষ ও দ্বন্দ্বের ফলে স্বপ্নমুখর কবিতা উত্তরণসম্ভাবনার দোরগোড়া থেকে ছিটকে, বেদনার্ত মীমাংসায় উপনীত হয়; হয় সবার করুণার পাত্র।
ইমরান তাই লিখেছেন, ‘মুহূর্তে পিচঢালা মাঝপথে, ধূসর সময়ের আলিঙ্গনে থমকে দাঁড়ায়। খুউব যে, বিপাকে জন্মান্ধকবিতা। করুণ গোঙানি ছাড়া কিছুই নিঃসৃত হয় না কণ্ঠ থেকে। অসহায় কবিতার যাত্রা দেখে, রোদের পকেট থেকে বৃষ্টি; গন্তব্যে পৌঁছার একটি হলুদ চিঠি এগিয়ে দেয়। ’
আর এই ব্যর্থতা ছড়িয়ে পড়ে সমস্ত চরাচরব্যাপী। কেউ রেহাই পায় না তার হাত থেকে। তখন,
‘সাইরেন বাজায় মাটিমগ্ন কৃষক -
পৃথিবীজুড়ে আপেল হাহাকার। ’
দেশপ্রেম ব্যক্তির মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটায়। ১৯৭১ সালে যে বোধ বা চেতনাকে সামনে রেখে মহান মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, স্বাধীনতার পর এতগুলো বছর অতিক্রান্ত হলেও কার্যত অদৃশ্য সেই চেতনার এখনো শুভ উদ্বোধন ঘটেনি।
বৃহত্তর এই জনগোষ্ঠী স্বার্থপরতা, নেতিবাচকতা ও স্বৈরতান্ত্রিক অপশাসনে হারিয়ে ফেলেছে তার আমিত্বকে। কবি উপলব্ধি করছেন মানুষ কি আদৌ প্রাণচঞ্চল ও গতিময় নাকি সে পণ্য; কর্পোরেটদের কাছে বিক্রি হওয়াই তার পরিণতি? ‘পরিচয়’ কবিতাতে দেখি,
‘ইমরান মাহফুজ -
এক বৃক্ষের নাম, তাকালে দৃষ্টি বাড়ে
কর্পোরেটদের আগ্রহ - না, বৃক্ষ কারো একার হয় না!’
তবে বাংলাদেশ নিয়ে তিনি যে ভাব ব্যক্ত করেছেন তা সত্যিই সংহত, সুচিন্তিত ও বাস্তব। যুগপৎ বৃত্তাবদ্ধে আত্মসমর্পণ না করে ইমরান দৃঢ়ভাষায় লিখেছেন,
‘অসুখী নদীতে ঢেউ নেই
কণ্ঠে পাখির গান নেই, সুরে নেই আবেশ
চোখে নেই স্বপ্ন, মায়ের কানে সোনাও নেই!
সব হারিয়ে সিটি গোল্ড বাংলাদেশ!!’
কোনো উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বক্তব্য প্রকাশ করলে কবিতা পর্যবসিত হয় স্লোগানে, ক্ষুণ্ণ হয় এর শিল্পমান। কিন্তু উদ্দেশ্যবাদী প্রচারপত্রের পক্ষপাতদুষ্ট না হয়ে কবিতাটি হয়ে উঠেছে শোষিত কাননের দলিত অথচ সুগন্ধী কুসুম।
ইমরান মাহফুজ একজন প্রাজ্ঞ শব্দ কারিগর। তার শব্দব্যবহার নিপুণ এবং মনোলীন কারিশমায় সমুজ্জ্বল। কবি আবদুস সাত্তার তার ‘আত্মপ্রতিকৃতি’তে লিখেছিলেন, ‘আমাকে কিছু না কিছু লিখতেই হবে। এবং লেখার মলম দিয়ে সব রকমের দুঃখের ক্ষত নিরাময় করতে হবে। লেখা আমার অস্থিমজ্জার সঙ্গে জড়িত। আমিই লেখা। ’
ইমরান মাহফুজের সঙ্গেও এই কথা সম্পূর্ণভাবে মনোলীন ঐক্যসূত্রে যুক্ত। একজন জাত-কবি বলেই তিনি অজস্রভাবে সৃষ্টি করে চলছেন শব্দের খেলনা। মা, মাটি ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে তিনি যেসব কবিতা লিখেছেন, অসংখ্য পাঠক তা পাঠ
করে ঋদ্ধ করবে নিজেদের - এই আমাদের বিশ্বাস।
কাব্যগ্রন্থ: দীর্ঘস্থায়ী শোকসভা, কবি ইমরান মাহফুজ; পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৮০, দাম: ১৩০ টাকা; প্রকাশক: ঐতিহ্য; প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৪০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৩, ২০১৯
এমএ/