ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

লালবাগ (পর্ব-২)

নভেরা হোসেন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০১০ ঘণ্টা, আগস্ট ২১, ২০২০
লালবাগ (পর্ব-২)

সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার মিশেলে এই জীবন। একগুচ্ছ মুহূর্তের কোলাজ।

গল্প-উপন্যাস সেই মুহূর্তগুলো ধরে রাখার উৎকৃষ্ট মাধ্যম। পুরান ঢাকার লালবাগকে যেমন সময়ের ফ্রেমে বেঁধেছেন লেখক নভেরা হোসেন। ‘লালবাগ’ একটি নভেলা। এটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে বাংলানিউজের শিল্প-সাহিত্য পাতায়। নভেলাটি পড়তে পাঠক বাংলানিউজে চোখ রাখুন প্রতি শুক্রবার।

২.
আব্বা তোমার এই পুরানা জমানার কথাতো অনেক শুনছি।

আরে শোন বেটি, এইসব কথা আমি না থাকলে আর কারও কাছে শুনতে পারবি না। যেদিন যায় তা আর ফিরা আসে না। শোন আমার দাদির কথা। নূরজাহান বিবির ঠমক-ঠামোক ছিল আলাদা। সে বান্দি দিয়া ঘরের কাম করাইতো, শুধু রান্ধনের কাজটা নিজে করতো। তার হাতের রান্নার স্বাদ ছিল অন্যরকম। একবার খাইলে কেউ ভুলতো না। নূরজাহান বিবির ছিল বেজায় সাহস, দাদাজান তারে ডরাইতো। একবার বাড়িতে ডাকাত পড়লো, ডাকাতরা অনেক দেশি অস্ত্র নিয়া আসছিল, রামদা, বল্লম, কিরিচ।

নূরজাহান বিবি ঘরের দেয়ালে টাঙানো বন্দুক নিয়ে সদর দরজা খুইল্যা ডাকাতগো ডর দেখাইছে, আকাশপানে গুলি ছুড়ছে। এইসব কথা মনে হইলে বুকের ভেতরটা তিন বিঘাত লম্বা হইয়া যায়।

লাইলী কানের হেডফোনটা খুলে বলে বাবা নূরজাহান বিবির কথা কিছু কইলা।

লালু শেখ দু’পা এগিয়ে দরজার সামনে বসে। বৃষ্টির পর দরজায় একটু রোদ এসে পড়েছে। বৃষ্টি-বাদলের দিনে ঘরগুলো একদম স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে যায়। ঘরে থাকাই দায়।

লালু শেখের স্ত্রী জোৎস্না আজ কতদিন হয়ে গেলো ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি আছে, ছেলে-মেয়েরাই দেখতে যায়, লালু শেখ যেতে পারে না, বুকে, পিঠে চাপ চাপ ব্যাথা। মাঝে মাঝে জোৎস্নার জন্য মনটা খারাপ হয়, কী বউ কী হয়ে গেলো! লাইলী রান্না ঘরে বাতি জ্বেলে রাতের ভাত আর ছোট মাছের চচ্চড়ি দিয়ে ভাইকে খাবার জন্য ডাকে।

কীরে লাইলী তুই আজকেও সকালে কিছু রান্ধস নাই? এতো বাজার করি কী করতে? সোবাহান চচ্চড়ি দিয়ে ভাত মাখতে মাখতে রাগে গজরাতে থাকে। তোরে দিয়া একটা কাম যদি হয়, লেখাপড়া ছাইড়া এখন কান্ধে পাঙ্খা লাগাইয়া ঘুরাতাছস। কোনো চিন্তা নাই। কোথার থেকে সব আসতেছে, কোনো চিন্তা নাই। তোর নামে হাজারটা নালিশ।

লাইলী ভাইয়ের সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।

কীরে সোবাহান, যা আছে খাইয়া নে, এতো চিল্লাস কেন ভোরবেলা?

তুমি আর কথা কইয়ো না আব্বা, মেয়েরে আস্কারা দিয়া মাথায় তুলছো এখন আইছো কথা কইতে। এতো শুকনা শুকনা খাওয়া যায়? দেখ রাতের ডাইল আছে নাকি?

লাইলী রান্না ঘর থেকে রাতের ডালের পাতিল এনে সামনে রাখে, নাও একটু ডাইল আছে।

সোবাহান পুরো ডালটা পাতে ঢেলে নেয়। লাইলী তাড়াতাড়ি দুইটা ডিম ভাজি করে।

লালু শেখ বাসি কোনো খাবার খেতে পারে না। তার জন্য দোকান থেকে পরাটা, ভাজি আর ডাল আনা হয়। সোবাহান মাছের চচ্চড়ি ডাল আর ডিম ভাজি দিয়ে ভাত মেখে খায়।

লালু শেখ আবার তাড়া লাগায়। পুরুষ মানুষের খাইতে এতো সময় লাগে? মাইয়া মানুষগো মতো কী খুচুর খুচুর করতাছস? যা কামে যা।

সোবাহান ডালটা চুমুক দিয়ে খেয়ে একটা ফুলেল ছাপার শার্ট গায়ে দিয়ে ঘর থেকে বের হয়।

গলিতে কাদা থকথক করছে। প্লাস্টিকের জুতা কাদার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। গলির মুখে পান-বিড়ি-সিগারেটের দোকানে জব্বারের সাথে দেখা-

কীরে সোবাহান বৃষ্টি-বাদলার দিনে সক্কাল সক্কাল কই যাইতাছোস? খেপ আছেনি?

খেপতো থাকবোই জব্বার। কাম-কাজ থাকবো না? তোর কী খবর?

এইতো চলতাছে। বাপের দোকানে বইসা থাকি দিন-রাত।

না তোদের দোকানটাতো ভালোই চলতাছে দেখলাম। পোলাপান বিরক্ত করে? করে না আবার! বাকি খাইতাছে দিনরাত।

শোন জব্বার কোনো সমস্যা হইলে আমারে বলবি। আচ্ছা যাই কাম আছে, ঠেকে আসিস।

আইচ্ছা, তুমি আইসো আমাগো দোকানে। চাচার কিছু লাগলে লাইলীরে পাঠাইয়া দিও।

সোবাহান একটা গোল্ডলিফ সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ভাবে, মহল্লার পোলাপান সব ভাদাইম্যা, কাজ নাই, কাম নাই গুলতানি মারতে ওস্তাদ। কাউরে দেখলেই নিজের কাসুন্দি গাইতে থাকে।

সোবাহানের শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে কিন্তু আজ একটা মালের চালান আসবে, চালানটা আনার জন্য মিরপুরে যেতে হবে। ওখানে বিহারী ক্যাম্পের মামুদ ওর জন্য অপেক্ষা করবে। সবাই বলে এই বিহারীগুলোকে বিশ্বাস নাই, একবার ভালো পার্টি পাইলে ওকে ছাইড়া সেদিকে চলে যাবে। তবু সোবাহান মামুদের সাথে ব্যবসাটা ধরে রেখেছে।

ওর তিনটা বোন মহররম, রোজা আর শাবান। শাবানের জন্যই এই দিকে বেশি যাতায়াত। শাবানের পিঙ্গল চোখের দিকে তাকালে সোবাহানের ভেতরটা একটু কেঁপে উঠে। অন্যরকম এক অনুভূতি হয়। সোবাহানের ইচ্ছে করে শাবানকে নিয়ে ভালো কোনো হোটেলে গিয়ে খেতে, চন্দ্রিমা উদ্যানে ঘুরে বেড়াতে। কিন্তু এসব কথা মনেই থেকে যায়। সংকোচে বলা হয় না।

শাবান কলেজে ভর্তি হয়েছে ও কি এখন সোবাহানের কথা ভাবার সময় পাবে?

মামুদ এসবের কিছুই জানে না।

ওদের ঘরেই ব্যবসার কথাবার্তা হয়, মাল ডেলিভারি হয়। এইবার চালানে এক হাজার বোতল ফেন্সি আসার কথা। মামুদ খুব কম লাভে সোবাহানকে মালটা দিচ্ছে। কারণ সোবাহানের সাথে পরিচয়টা এই জগতে ওর ব্যবসার দরজা খুলে দিয়েছে। সোবাহানের যোগাযোগ খুব ভালো। পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা, মিরপুর, মোহাম্মদপুরের বড় বড় দালালদের সাথে ওঠা-বসা। লালবাগের ফেন্সির সর্দারিটা ওর হাতেই। এলাকার রাজনৈতিক নেতা, সাঙ্গ-পাঙ্গ সবার সাথে ওর জানাশোনা। তাদের বখরা দিয়ে ব্যবসাটা ভালো চালাচ্ছে। মাঝে মাঝে পুলিশের কিছু ঝামেলা হয়, তখন রাজনৈতিক বড় ভাইদের ফোন দিতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতারা সমাধান করে দেয়, সব তাদের হাতে। সোবাহান মাল সংগ্রহ করে দালাদের মাধ্যমে। সেই মাল চাঁনখারপুল, বকশিবাজার, আল্লাউদিন রোড, লালবাগ, আজিমপুর এসব এলাকায় পৌঁছে দেয়। এই এলাকাগুলো ড্রাগের একটা বড় আখড়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী, এলাকার তরুণরা, বিভিন্ন পেশাজীবী, ব্যবসায়ী, ডাক্তার অনেকেই সোবাহানদের নির্দিষ্ট কাস্টমার। মাঝে মাঝে চালান বন্ধ থাকলে বা সীমান্তে ঝামেলা হলে লোকজন অস্থির হয়ে যায়। তখন অন্য মাল আনাতে হয়, নানা মিকচার দিতে হয়।

এতো বছর ধরে সোবাহান ফেন্সির কারবার করছে কিন্তু নিজে কখনও খেয়ে দেখে নাই। ওর নেশা শুধু বিলাতি মদে। ব্যবসায় ভালো লাভ থাকলে ছেলেপেলেকে নিয়ে রহমতের ঠেকে আসর বসায়। জলিল, হিরু, ফেন্সি জুয়েল, বড় রানা সবাইকে নিয়ে ফুর্তি করে।

রাতের বেলা রহমতের ঠেক খালি থাকে। ওখানে সারারাত ছেলেপেলের হুল্লোড় চলে, তবে সোবাহানের একটা শর্ত দলের সবাইকে মানতে হয়। কেউ কোনো মেয়েকে আনতে পারবে না। বড় রানা প্রায়ই বখশিবাজারের রাস্তায় দাঁড়ানো মেয়েদের এনে ফুর্তি করতে চায়। কিন্তু সোবাহানের ভয়ে কিছু করতে পারে না।

সোবাহান কড়া সমন জারি করেছে, মেয়ে মানুষ নিয়ে ফুর্তি করতে চাও করো গিয়া কিন্তু আমার এইখানে এসব চলবে না। তাহলে কারও ঘাড়ে মাথা থাকবে না। ব্যবসার সাথে যারা জড়িত, সবাই এক বাক্যে সোবাহানের কথা মেনে নেয়। সবাই জানে ওকে রাগানো যাবে না, তাহলে চিরদিনের মতো ওর সাথে ব্যবসা খতম।

লালবাগ থেকে রিকশা নিয়ে সোবাহান আজিমপুর বাসস্ট্যান্ডে আসে। সেখান থেকে পল্লবীর একটা বাসে উঠে পড়ে। সোবাহানের জন্য যাওয়ার সময়টা বাসেই ভালো। আসার সময় মাল নিয়ে মামুদের পরিচিত ভাড়া করা গাড়িতে চড়ে লালবাগে ফিরে আসবে। সোবাহান মামুদ ছেলেটাকে খুব পছন্দ করে। ওর কথাবার্তা, চাল-চলন খুব সাধারণ, সরল মনে হয় সোবাহানের কাছে। সত্যি কথা বলে, কোনো ভান-ভনিতা নাই। অন্যরা নানা ঝামেলা করে কাজে, কথার ঠিক থাকে না, মামুদ এক কথার ছেলে। ওকে বিশ্বাস করা যায়।

সোবাহান বাবার কাছে কাবুলিওয়ালাদের গল্প শুনেছে। তারা কোনোদিন কথার খেলাপ করতো না। দরকার হলে জান দিয়ে নিজের সম্মান বাঁচাতো। মিরপুর ছয় নম্বরের রশিদ মামুদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় সোবাহানকে। প্রথম দিন মামুদ ওকে একেবারে বুকে জড়িয়ে ধরে আপন ভাইয়ের মতো। এগারো নম্বরে নিয়ে গিয়ে শওকতের কাবাব ঘরে বটি কাবাব, গরুর চাপ, লুচি এইসব খাওয়ায়। আহা কী স্বাদ! গরুর চাপগুলো একদম মাখনের মতো মুখের মধ্যে গলে যায়। মামুদ সোবাহানকে বাড়িতে নিয়ে গেছে। বাবা, বোনদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। মামুদের তিন বোন সোবাহানকে দেখলে একদম আটার মতো লেগে থাকে। সোবাহান ওদের জন্য পুরান ঢাকার মিষ্টি-দই এসব নিয়ে যায়। ওদের হাতের রান্নাও খেয়েছে, খুব স্বাদ, ভোলা যায় না। বার বার সোবাহান কাজের উছিলায় মিরপুরে আসে। দরকার না থাকলেও আসে।

শাবানকে দেখার পর থেকেই সোবাহানের মনে একটা অন্যরকম কিছু ঘটে গেছে। ওর ঘন কালো কোঁকড়া চুল, লাজুক হাসি এসব সোবাহানের মনে আলোড়ন তোলে। ইদানিং কাজ করতে অনেক ভালো লাগে। মনে একটা ফুর্তি ভাব।

সোবাহান এগারো নম্বর বাসস্ট্যান্ডে নেমে রাস্তা পার হয়ে একটা রিকশা নেয়। মামুদদের মিল্লাত ক্যাম্পের সামনে রিকশা থেকে নামে। একটা সরু গলি চলে গেছে ভেতরে। গলির ভেতর ঢুকে এগিয়ে গেলে সারি করা সব ঘর, ঘরগুলোর দরজা পাশাপাশি। গলির সরু রাস্তায় পুরানো ভাঙা লাল ইট বিছানো, ময়লা আবর্জনা স্তুপ করা, বাচ্চারা খেলছে, লোকজন বসে আছে ঘরের সামনে। কেমন একটা ভ্যাপসা দুর্গন্ধ। কোনো ঘরে রান্না চলছে। মাংসের সুঘ্রাণ ভেসে এলো নাকে, মামুদদের ঘরটা বেশ ভেতরে। কাদাপানি পেরিয়ে যেতে হয়।

নভেরা হোসেন
জন্ম ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫, মাদারীপুর শহরে নানাবাড়িতে। শৈশব থেকেই ঢাকায় বেড়ে ওঠা। তিনি লেখাপড়া করেছেন ধানমন্ডির কাকলি উচ্চ বিদ্যালয়, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ এবং নৃবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। লিটল ম্যাগাজিনে লেখা শুরু করেছেন ২০০০ সালের পর থেকে। বিশেষত কবিতা, গল্প ও নৃবৈজ্ঞানিক লেখালেখি করেন। e-mail: noverahossain@gmail.com

আরও পড়ুন>> লালবাগ (পর্ব-১)

বাংলাদেশ সময়: ১০০৫ ঘণ্টা, আগস্ট ২১, ২০২০
টিএ
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।