সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার মিশেলে এই জীবন। একগুচ্ছ মুহূর্তের কোলাজ।
৬
লাইলী বাবার কথা শুনতে শুনতে ঘুমে ঢুলতে থাকে। চুলায় ভাত পুড়ে গন্ধ বের হয়, দৌড়ে গিয়ে চুলা বন্ধ করে।
মার মৃত্যুর পর সোবাহান কিছুদিন কাজে মন বসাতে পারলো না। কাঁধে ঋণের বোঝা, কিন্তু কার জন্য এইসব? সেই মাইতো থাকলো না। সবকিছুর প্রতি সোবাহানের বিতৃষ্ণা ধরে যায়।
একদিন সোবাহান মিরপুরে যায় শাবানের সাথে দেখা করতে। শাবানকে ফোন করে বলে এগারো নম্বরে ফলপট্টির কাছে থাকতে। ওখান থেকে দুজনে রিকশায় চড়ে বোটানিক্যাল গার্ডেনের উদ্দেশে রওনা হয়। শাবান খুব ভয় পায় যদি মামুদ বা পরিচিত কেউ দেখে ফেলে, এ জন্য রিকশায় হুক দিয়ে দেয়, তবু ঘামতে থাকে।
সোবাহান বলে তুমি এতো ভয় পাইতাছো কেন? আমরাতো চুরি করতে যাইতেছি না।
না ভাই জানলে আমাকে খুব মারবে। আপনাকে কিছু বলবে না। আমাদের বাইরে কারও সাথে মেলামেশা লোকজন পছন্দ করে না, নানা কথা বলে।
কিন্তু আমিতো তোমাকে পছন্দ করি, একদিন আমরা বিয়া করবো। আম্মা চাইতো আমি তোমার মতো একটা শিক্ষিত মেয়েকে বিয়ে করি।
শাবান মাথা নিচু করে দাঁত দিয়ে নখ কাটতে থাকে।
তোমার কিছু বলার নাই শাবান?
শাবান একটু হাসি দিয়ে বলে ওহ এসব কথা না চলেন একটা সিনেমা দেখি আজকে।
কিন্তু আজতো বোটানিক্যাল গার্ডেনে ঘুরতে চাইছিলাম।
না অন্যদিন যাব আর ওইখানে অনেকেই আসে ঘুরতে, কেউ দেইখা ফেলব, বাড়িতে খবর যাবে।
বাহ তোমার মাথায়তো অনেক বুদ্ধি।
হা হা শাবান হাসতে থাকে।
দুজনে মিলে মিরপুর এক নম্বরে সনি সিনেমা হলে যায়, ওখানে শাকিব খানের সিনেমা চলছিল।
সিনেমা দেখে মিরপুর এক নম্বরে এসে প্রিন্স হোটেলে বিরিয়ানি খায়।
সোবাহানের মনটা একটু হালকা হয়। মা চলে যাবার পর সারাদিন মনমরা হয়ে থাকে, আজ একটু ভালো সময় কাটানোয় চেহারায় উজ্জ্বল আভা ফুটে ওঠে। সোবাহান শাবানকে নিয়ে ওর ভবিষৎ জীবনের স্বপ্ন দেখতে থাকে।
কী হইছে আপনার?
সোবাহান সম্বিৎ ফিরে পায়, কই কিছুনাতো। তোমার কথা ভাবছিলাম।
কী কথা?
না কত কথা আছে না, আমরা একসাথে থাকব, ঘুরব, ফিরব এইসব।
হুম আপনি শুধু ওই এক কথাই ভাবেন।
কেন তুমি কী ভাবো?
আমি ভাবি কলেজে পড়ব, বিএ, এমএ পাস দিব, চাকরি করব।
তাই, সত্যি? আমাদের বংশে কোনো মেয়ে কোনোদিন চাকরি করে নাই, লেখাপড়াও বেশি করে নাই। লাইলীটা বখাটেগিরি করল।
কেন আপনেওতো পড়েন নাই। আপনি বখাটেগিরি করেন নাই?
হুম, সোবাহান চুপ করে থাকে। জানো শাবান আমার খুব লেখাপড়া করতে ইচ্ছা করে আবার, চাকরি করতে ইচ্ছা করে।
তাহলে করবেন।
সত্যি তুমি আমার পাশে থাকবা তাহলে?
শাবান সোবাহানের হাতটা ধরে বলে আমিতো আপনার পাশেই আছি।
আমার এক বন্ধু এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে সরকারি চাকরি করতেছে। আমার সাথে স্কুলে পড়তো, লালবাগের ছেলে। ও কিন্তু একটুও বদলায় নাই। আমাকে দেখে অনেক কথা বলল। আগের কথা।
শাবান সোবাহানকে তাড়া লাগায়, চলেন চলেন আজকে ভাই ঠিকই টের পাইব।
আবার কবে দেখা হবে তোমার সাথে?
শাবান বলে লাল শুক্রবার।
সোবাহান একটা সিএনজিতে করে শাবানকে মিরপুর এগারো নম্বরে পৌঁছে দেয়।
মায়ের মৃত্যুর পর লাইলী আবার পাড়ায় পাড়ায় ঘুরতে থাকে, বখাটে ছেলেদের সাথে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায়। সোবাহান কাজে বের হলেই বাবাকে কিছু একটা বুঝিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। সিদ্ধিরগঞ্জের ছেলে বাবলুর সাথে লাইলীর ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়, তার সাথে সারা পুরান ঢাকা ঘুরে বেড়ায়। স্টার হোটেলে কাচ্চি বিরিয়ানি, আলাউদ্দিন রোডে হাজি বিরিয়ানি, কুলফি-মালাই কত কী!
মায়ের অনুপস্থিতিতে লাইলী অনেকটা স্বাধীন হয়ে যায়। মা থাকলে সারাদিন চোখে চোখে রাখতো। বাবাকে খাবার রান্না করে দিলে আর কোনো চিন্তা থাকে না। লালু শেখ সারাদিন শুয়ে শুয়ে টেলিভিশন দেখে, না হলে দরজায় বসে পাড়ার লোকেদের সাথে গল্প করে, দু-এক সময় মোড়ের দোকানে গিয়ে বসে থাকে। মেয়ে যা বলে তাই বিশ্বাস করে। ছয়মাসের মধ্যে লাইলী বাবলুর সাথে বাড়ি থেকে পালায়।
সোবাহান রাতে ঘরে এসে দেখে লাইলী ঘরে নাই কোথায় গেছে বাবা কিছু বলতে পারে না। মোবাইল বন্ধ। সোবাহান অনেকের কাছে লাইলীর খোঁজ করে, কেউ সঠিক খবর দিতে পারে না। কেউ বলে আলাউদ্দিন রোডে দেখা গেছে দুপুরে, কেউ বলে চকবাজারে।
অনেকে বলাবলি করতে থাকে বাবলুর সাথে লাইলী ভেগে গেছে।
সোবাহান মেজাজ ঠিক রাখতে পারে না, ঘরের জিনিসপত্র ভাঙচুর করে। দাদির আমলের একটা হ্যাজাক বাতি ছিল লালু শেখের অনেক পছন্দের সেটাকে লাথি মেরে ভেঙে ফেলে।
লালু শেখকে দুষতে থাকে সোবাহান।
ভাদাইম্যা, নিজের মেয়ের খবর রাখতে পারো না, খালি ভাত গেলন। পেটে দুইটা দানা পড়লেই হইলো। নিজের মেয়ে যে খারাপ মেয়ে হইয়া গেলো, পথে নামছে সেই খবর রাখো না? কেমন বাপ তুমি? রাগে গজগজ করতে করতে সোবাহান ঘর থেকে বের হয়ে যায়। লালবাগের মাস্তান জসিমের ডান হাত রসূল খবর দেয় লাইলী বাবলুর সাথে ওর নানাবাড়ি কেরানীগঞ্জে গেছে। ওইখানে বিয়ের আয়োজন চলছে।
সোবাহান আর সহ্য করতে পারে না, দলবল নিয়ে কেরানীগঞ্জে হাজি বাড়িতে হাজির হয়। ওখানে লাইলীর খোঁজ পায়। লাইলী ভেতরের ঘরে একটা লাল শাড়ি পরে বসা। সোবাহানের আসার খবর পেয়ে বাবলুর নানাবাড়ির মেয়েরা অনেকেই পাশের বাড়িতে চলে যায়। সোবাহান বাবলুকে ধাক্কা দিয়ে লাইলীকে ঘরের বাইরে নিয়ে আসে।
লাইলী তুই বাড়ি থেকে বের হয়ে আইলি কোন সাহসে?
লাইলী ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকে।
মা মরছে দুই দিনও হয় নাই, এরমধ্যে তোর এতো পাখা গজাইছে। তুই একজন অচেনা ছেলের সাথে বাড়ি-ঘর ফালাইয়া আইসা পড়লি। বাপ-ভাইর কথা ভাবলি না একবার?
লাইলী কোনো কথা বলে না, নখ দিয়ে মাটিতে দাগ কাটতে থাকে।
এইসব বিয়া-শাদি বন্ধ। এই লাইলী চল, বাড়ি চল। সোবাহান লাইলীর হাত ধরে টানতে থাকে।
লাইলী ভাইর হাত ছাড়ানোর জন্য অনেক চেষ্টা করে। বাবলু এসে লাইলীকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করে। সোবাহান বাবলুকে এক ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়, অনেকক্ষণ ধস্তাধস্তি হয়।
লাইলী চিৎকার করে ওঠে, ভাইজান তুমি বাবলুর গায়ে একটা হাত দিবা না।
হাত দিমু না? দেখ কী করি তোদের!
সোবাহান পকেট থেকে একটা ছোট পিস্তল বের করে বাবলুর দিকে তাগ করে।
বাবলু ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে হাত জোর করে দাঁড়িয়ে থাকে।
লাইলী ভাইর হাত থেকে পিস্তল কেড়ে নিতে চেষ্টা করে।
সোবাহানের দলবল বাড়ি ভাঙচুর করে। বাবলুরা অনেক বাধা দেয়। বড় রানা বাবলুকে হকিস্টিক দিয়ে পিটিয়ে হাড়গোড় ভেঙে দেয়, খুব খারাপ অবস্থা করে। বাবলুর নানাবাড়ির লোকেরা সোবাহানের কাছে মাফ চায়। লাইলী একটা আহত সাপের মতো ফুঁসতে থাকে। লাইলীর মুখ, হাত বেঁধে ভাড়া করা গাড়িতে লালবাগে নিয়ে আসে সোবাহান আর তার দলবল।
লালু শেখ মেয়েকে ডাকতে থাকে। লাইলী ওই লাইলী, লাইলী কই গেলি, আমার ওষুধ খাবার সময় হইছে। ওষুধটা দে, কই মরলি!
লাইলী কোনো সাড়া-শব্দ করে না। একমনে ঘর ঝাড়ু দিতে থাকে, লাইলীর যেন কোনো কিছুতে কিছু আসে-যায় না। মনের ভেতর দারুণ এক অস্থিরতা। লাইলী সেই অস্থিরতার ভাষা জানে না। শুধু জানে এই ঘর-বাড়ি, বাপ-ভাই সবাই ওর আপন হয়েও ওকে বোঝে না। সবাই যার যার স্বার্থে ব্যস্ত। লাইলীর মনের কী ইচ্ছা, ও কী চায় কেউ কোনোদিন জানতে চায়নি। সবসময় বাবা-মা, ভাই ওকে বকেছে, পাড়ার লোকেরা নানা খারাপ কথা বলেছে ওর নামে। কিন্তু কেউ কোনোদিন ওকে নিয়ে ভাবেনি। বাবলু ওকে বন্ধুর মতো কাছে টেনে নিয়েছে। সেই বাবলুকে ছেড়ে আসতে ওর অনেক কষ্ট হয়েছে। ও নাহলে আবেগের বশে একটা ভুল করেছে কিন্তু সোবাহান ওর ভাই হয়ে সবার সামনে ওকে ছোট করলো! লাইলীর মন পাথরের মতো ভার হয়ে থাকে।
লালু শেখ ডাকতেই থাকে লাইলী, লাইলী আমার অজুর পানিটা দে। লাইলী নিশ্চল মূর্তির মতো চুলার পাড়ে বসে থাকে।
বাবলুর বাবা আলমগীর খাঁ সোবাহানের নামে মামলা দেয়। খুনের চেষ্টা, ঘর-বাড়ি লুটপাট, ড্রাগসের ব্যবসা। মামলায় অভিযোগনামা দাখিল হয়ে যায়। সোবাহানকে খুঁজতে পুলিশ বাড়িতে আসে। সোবাহান কখনোই বাড়িতে থাকে না, রহমতের ঠেকে থাকাও বিপজ্জনক অনেকেই চেনে। মাঝে মাঝে বড় রানাদের টং ঘরে থাকে, কখনও অন্য কোথাও কোনো ঠিক-ঠিকানা নাই। দু-একদিন বুড়িগঙ্গায় ভেসে বেড়ায়, সাথে দলবল। সবাই মিলে দেশি মদ খায় আর সারাদিন গান চলতে থাকে। জুয়েলের গানের গলা খুব ভালো। জুয়েল নৌকায় ভাটিয়ালি গান গায়, লালনের গান গায়। কখনও নৌকা গিয়ে মুন্সিগঞ্জে থামে। সবাই নৌকা থেকে নেমে নদীর ঘাটের ছাপড়া দোকানে বসে চা-বিস্কুট খায়।
নভেরা হোসেন
জন্ম ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫, মাদারীপুর শহরে নানাবাড়িতে। শৈশব থেকেই ঢাকায় বেড়ে ওঠা। তিনি লেখাপড়া করেছেন ধানমন্ডির কাকলি উচ্চ বিদ্যালয়, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ এবং নৃবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। লিটল ম্যাগাজিনে লেখা শুরু করেছেন ২০০০ সালের পর থেকে। বিশেষত কবিতা, গল্প ও নৃবৈজ্ঞানিক লেখালেখি করেন। e-mail: noverahossain@gmail.com
আরও পড়ুন>>
লালবাগ (পর্ব-৫)
লালবাগ (পর্ব-৪)
লালবাগ (পর্ব-৩)
লালবাগ (পর্ব-২)
লালবাগ (পর্ব-১)
বাংলাদেশ সময়: ১০৪৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৮, ২০২০
টিএ