কলকাতা: ৭০ দশকের বিশিষ্ট কবি পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল (৭২) আর নেই। মঙ্গলবার (২৯ সেপ্টেম্বর) সকাল ৭টার দিকে কলকাতার নিজের বাসভবনে বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
কবি তমাল রায় বাংলানিউজকে এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই শ্বাসকষ্টসহ বার্ধক্যজনিত একাধিক সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি।
কবি পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল কলকাতার দমদম সিঁথির মোড় এলাকায় থাকতেন। তাঁর জন্ম ১৯৪৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর। নির্জন ও আত্মমগ্ন কবি হিসেবে দীর্ঘকাল ধরে মননশীল পাঠকসমাজে আদৃত ছিলেন পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল।
তাঁর প্রথম বই ‘দেবী’ প্রকাশ পায় ১৯৭০ সালে। স্বতন্ত্র ভাষাভঙ্গির জন্য প্রকাশের পরপরই তৎকালীন পাঠকমহলে আলোড়ন ফেলে দেয় কাব্যগ্রন্থটি। এছাড়া তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা ‘আকাশ’ (১৯৬৬) ও ‘অন্ধযুগ’ (১৯৭৩-৭৪)।
কবির প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলো হলো- ‘দেবী’ (১৯৭০), ‘রাত্রি চতুর্দশী’ (১৯৮৩), ‘টেবিল’, ‘দূরের সন্ধ্যা’ (১৯৮৪), ‘পাঠকের সঙ্গে’, ‘ব্যক্তিগত’ (২০০১), ‘ধর্মপুত্র’, ‘এখানে আসুন’ (২০০৭), ‘বর্ণজীবের সনেট’ (২০১৩), ‘বহিরাগত’ (২০০৮), ‘সাদা পাথরের গোলাপগুচ্ছ’ (২০১৫), এবং ‘নবান্ন’ (২০১৯)।
মঙ্গলবার বিকেলের মধ্যেই তাঁর দাহকার্য সম্পন্ন করা হবে বলে জানা গেছে। বাংলা কবিতায় এক নিজস্ব স্বরের জন্ম দিয়েছিলেন পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল। তাঁর প্রয়াণে বাংলা সাহিত্যের এক যুগাবসানের ইঙ্গিত দেখছেন অনুরাগীরা।
তাঁর বাবা নরেন্দ্রনাথ কাঞ্জিলাল। মা জ্যোৎস্না কাঞ্জিলাল। জীবনানন্দ পরবর্তী পরম্পরায় অগ্রগণ্য এ কবি এবং একদা-নিরলস সাহিত্যকর্মীর কবিতা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৫ সালে, ‘ইমন’ পত্রিকায়।
স্কটিশ চার্চ কলেজে ছাত্রাবস্থায় তাঁর উদ্যোগে প্রকাশিত একটি স্বল্পায়ু সাহিত্যপত্রিকার নাম ‘আকাশ’। সাতের দশকের প্রথমার্ধে সম্পাদিত ‘অন্ধযুগ’ও স্বল্পায়ু— কেবল দুটি সংখ্যাই প্রকাশিত হতে পেরেছিল— কিন্তু অভিঘাতের দিক থেকে প্রভাবশালী। অন্ধযুগের লেখকরা অনেকেই পরবর্তীকালে তাদের নিজস্বতার ছাপ রাখতে পেরেছেন। অধুনালুপ্ত বাণিজ্যিক সাহিত্য-সাপ্তাহিক ‘অমৃত’র সঙ্গেও তিনি ঘনিষ্ঠরূপে যুক্ত ছিলেন।
পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলালের কবিতার বই ও পুস্তিকাগুলো প্রকাশিত কবিতাসংগ্রহে সংরক্ষিত হলেও খ্যাতিমান ও অখ্যাত, মৃত ও জীবিত পত্রপত্রিকায় মুদ্রিত তাঁর বহু কবিতা আজও রোদে পুড়ছে, জল ঝড়ে ভিজছে; কবিতা-বিষয়ক অসংখ্য গদ্যরচনা এবং অন্তত দুটি উপন্যাসের ভবিষ্যৎ আরও অনিশ্চিত।
তাঁর একটি কবিতা;
ট্রেন
যশোর, সবুজ ট্রেন, তুমি কি এখন
অন্য কোনো বালকের মর্মে এসে পড়ো?
যখের গহনা আগলায় আজ এই
উত্তর-বালক, জড়-স্মৃতি করে জড়ো
অপারগ আচার্যের আঙুলের উন্মন
উপবীত যেন, যার ব্যবহার নেই।
শৈশব, সবুজ ট্রেন, ট্রেনের সতত
শৈলজল অগ্নিশব্দ, তমসাজীবিতা…
যত্নে স্বচ্ছ হলো আজ, তবু পথ-ক্ষত
যশোরেশ্বরীর ভূমে শয়ান কবিতা
আমাকে জানায় কীর্তিনাশা-দূরদেশে
আর্ত পারাপার আজো। ইন্দ্রিয়সঙ্কুল
অতীতে। সবুজ ট্রেন, তরুর অমূল
অন্য বালকের ঘুমে, চুলে ওঠে ভেসে।
পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলালের মৃত্যুতে ব্যথিত লেখক অমর মিত্রও। তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল চলে গেলেন। যখন আমি ১৯৬৮ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হই, তিনি ও নিশীথ ভড় সুখ্যাত কবি। দূর থেকে দেখতাম এই দুই প্রিয় কবিকে। নিশীথ ভড় চলে গেছেন, পার্থপ্রতিমও চলে গেলেন। পরে ১৯৭৭ নাগাদ পার্থর সঙ্গে আলাপ। অমৃত পত্রিকায় উনি লিখতেন। কয়েক বছর আগে ফোন করেছিলেন আচমকা। কত কথা হয়েছিল। পার্থপ্রতিম আমার সিনিয়র ছিলেন কলেজে। মনে পড়ে কলেজের সিঁড়িতে তরুণ কবি দাঁড়িয়ে, নবীন অভিনেত্রী রোমি চৌধুরী দাঁড়িয়ে, সদ্য রিলিজ করেছে অরুন্ধতী দেবীর সিনেমা ছুটি। মুগ্ধ চোখে এঁদের দেখছি আমি সাহিত্য-শিল্প পিপাসু রসায়নের ছাত্র। গল্প লেখার খুব ইচ্ছে। আলাপ করব, কী বলব কবিকে? পার্থপ্রতিম মানেই আমাদের স্কটিশ চার্চ কলেজ। স্কটিশ চার্চ কলেজে তাঁর স্মরণ অনুষ্ঠান হতে পারে। হোক। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৬০৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২০
বিএস/টিএ