সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার মিশেলে এই জীবন। একগুচ্ছ মুহূর্তের কোলাজ।
১৫
সোবাহান একদিন সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে মোহাম্মদপুরে বিহারি ক্যাম্পে যায়। ক্যাম্পের চারপাশে নানা রকম কাবাবের দোকান। একটা দোকানে ঢুকে কাবাব খায়, দোকানদারের সাথে গল্প করে।
এইখানে মিরপুরের মামুদের বোন শাবানার বিয়ে হইছে তার জামাইয়ের কাবাবের দোকান আছে। চেনো তুমি?
দোকানদার অনেকক্ষণ সোবাহানের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে আপনি কি এগারো নম্বরের মোহাম্মদের পোলার কথা কইতাছেন?
সোবাহান বলে হ, ওর বোন শাবান এইখানে থাকে না?
থাকব না কেন? মামুদের বোনের অনেক ভালো ঘরে বিয়া হইছে। জহুরি মহল্লায় বাসা নিয়া থাকে। জামাইয়ের অনেক ব্যবসা, কাবাবের দোকান আগে ছিল এখন নাই।
শাবানের জামাইয়ের বাড়ির ঠিকানা দিতে পারবা?
তুমি ওদের আত্মীয়?
আমার ভাই মামুদ।
মামুদতো শুনছি জেলে আছে।
না না ও এখন বাইরে।
আমিতো তোমারে ঠিকানা দিতে পারমু না তবে রকমারি কাবাব ঘরে যাও ওরা তোমারে বলতে পারবে। জাভেদ সাহেবের ঠিকানা দিতে পারবে।
সোবাহান অনেকক্ষণ রোদের মধ্যে ঘোরাঘুরি করে রকমারি কাবাব ঘরে গিয়ে পৌঁছায়। কাবাব ঘরে দুজন অল্প বয়সী ছেলে ক্যাশ-বক্সে বসে আছে।
সোবাহান গিয়ে বলে,
তোমরা কেউ জাভেদ সাহেবকে চেনো?
ছেলে দুটি বলে চিনুম না কেন? তারে সবাই চেনে।
সোবাহান বলে আমি তারে খুঁজতে লালবাগ থেকে আসছি তার বাসার ঠিকানাটা দিতে পারবা?
কী কাজ?
আছে কিছু ব্যবসার কাজ।
ঠিকানা দিতে পারব না, তবে বাসা দেখায় দিতে পারব।
সোবাহান ছেলেটিকে কিছু টাকা দেয় চা-সিগারেট খাওয়ার জন্য।
ছেলেটি সোবাহানকে জহুরি মহল্লায় একটা চারতলা বাড়ির সামনে নিয়ে দেখিয়ে বলল এইটা জাভেদ সাহেবের বাড়ি।
সোবাহান তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে শাবান এই বাড়িতে থাকে? ও এখন ভদ্রলোক হয়ে গেছে। সোবাহানকে কি আর চিনবে? মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। ভদ্রলোকেরা ওর মতো দাগী আসামির সাথে কি কথা বলবে? বাড়ির সামনে গিয়ে সোবাহান কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে যদি শাবান বারান্দায় আসে? এখন কী পরিচয় নিয়ে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াবে? ওর শ্বশুর-বাড়ির লোক ওকে নানা কথা শোনাবে। সোবাহান ভাবে নিজের জীবনটাতো শেষ হয়ে গেছে এখন শাবানের জীবনটাকে যন্ত্রণাময় করে তোলার কোনো মানে নাই। লালবাগে ফিরে আসে। শাবানকে চিরজীবনের মতো ছেড়ে চলে আসে সোবাহান। শাবান ভালো থাকুক, বেঁচে থাকুক এটাই ও কামনা করে। চোখ দিয়ে কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে গালে।
সোবাহানের মনে অনেক ক্ষোভ জমা হয়ে আছে। যে খবির মোল্লার জন্য ওকে জেলে যেতে হয়েছিল তার প্রতি আক্রোশে অস্থির হয়ে ওঠে। গলির রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করে। জুয়েল, রানা ওদের নিয়ে পরিকল্পনা করে খবিরের বাসায় অপারেশন করবে। জুয়েল একটা বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র জোগাড় করে। খবির মোল্লার একজন পছন্দের মেয়ে আছে চকবাজারে। প্রায় রাতে ওখানে আসে খবির মোল্লা। কিছুটা বেসামাল থাকে ঐসময়ে। সাঙ্গপাঙ্গরাও বেসামাল থাকে। সোবাহানরা চকবাজারের ওই বাসায় খবির মোল্লাকে হত্যার পরিকল্পনা করে। সব খোঁজ-খবর নিয়ে নিশ্চিত হয় শুক্রবার রাত ১২টার দিকে খবির মোল্লা ওখানে আসবে। সোবাহানরা রাত এগারোটার পর থেকে অপেক্ষা করতে থাকে। বাসার উল্টোদিকে অন্ধকার রাস্তায় শার্টের ভেতরে অস্ত্র লুকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সুযোগের অপেক্ষায়। দীর্ঘক্ষণ ওরা অপেক্ষা করে কিন্তু খবিরের দেখা নাই। রাস্তায় দাঁড়িয়ে মশার কামড় খেতে খেতে অস্থির হয়ে ওঠে সোবাহান। রাত প্রায় পৌনে একটা বাজতে চলেছে।
জুয়েলকে বলে কী খবর আনলি, আজতো মনে হয় শালায় আইবনা।
আইব বস আইব। একটু ধৈর্য ধরো। জেলে গিয়া তুমি তো একদম বদলাইয়া গেছো। একটু ধৈর্য-সৈর্য নাই। এইসব কামে সময় লাগব।
চুপ হারামি। আমারে তোরা জেলের খোটা দিবি না। আরেকদিন যদি এই কথা শুনি একদম শেষ কইরা ফালামু।
জুয়েল, রানা চুপ হয়ে যায়। শিকারের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ওদের চোখে আগুন জ্বলতে থাকে। সোবাহান জেল খাটলেও জুয়েল, রানা ওরা মোটা অংকের টাকা-পয়সা দিয়ে মামলা থেকে নিজেদের নাম কাটিয়ে নেয়। কিন্তু ওদের ব্যবসা সব খবির নিয়ে নেয়। এই তল্লাটে ওদের আর কোনো জায়গা থাকে না। জুয়েল, রানা ওরা এতদিন সোবাহানের ফিরে আসার অপেক্ষায় ছিল। সোবাহান এলে ওরা আবার নতুন করে সব শুরু করবে এই আশায় ছিল। এতদিন কোনোমতে ড্রাগের খুচরা কিছু ব্যবসা করে দিন চলেছে। খবির মোল্লার প্রতি ওদের সবার অনেক রাগ। শিকারের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ওরা হিংস্র হয়ে ওঠে। খবির মোল্লার জন্য ওদের কষ্ট করে জীবন ধারণ করতে হচ্ছে। আজ তার প্রতিকারের সময় এসেছে।
হঠাৎ একটা গাড়ি এসে থামে নীল রঙের বাড়িটার সামনে। খবির মোল্লা গাড়ি থেকে নেমে গেটের দিকে এগিয়ে যায়। দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ দারোয়ানের সাথে কথা বলে। হঠাৎ একটা গুলি এসে খবির মোল্লার মাথা এফোঁড় -ওফোঁড় করে চলে যায়। কিছু বোঝার আগেই খবির মোল্লা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। রাতের অন্ধকারে লাল রক্তের ধারাকে কালো মনে হয়। দরোয়ান বসে পড়ে নাকের কাছে হাত নিয়ে নিঃশ্বাস বোঝার চেষ্টা করে, সব থেমে আছে। বুকেও কোনো সাড়া-শব্দ নাই।
সোবাহানরা গুলি করেই দ্রুত ওই এলাকা ছেড়ে চলে যায়। খবির মোল্লার মৃত্যুর পর পুরো এলাকায় কার্ফুর মতো হয়ে যায়। লোকজন ভয়ে ঘর থেকে বের হয় না। সোবাহান, ফেন্সি জুয়েল, বড় রানার নামে ওয়ারেন্ট জারি হয়। ওদের ধরিয়ে দিতে পারলে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। খবিরের মৃত্যুতে প্রশাসনের ওপরের মহল থেকে চাপ আসতে থাকে। মাদক ব্যবসায়ীরা সোবাহান এবং ওর ছেলেদের ধরার জন্য পুরো পুরান ঢাকায় চিরুনি অপারেশন চালায়। কিন্তু ওদের কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। রানা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যায়। সোবাহান মাথার চুল কামিয়ে নতুন বেশভূষা পরে নৌকায় নৌকায় পালিয়ে বেড়ায়। অনেক জায়গাতেই সোবাহানের মতো চেহারার লোক দেখলে গ্রেফতার করে ধরে আনা হয় কিন্তু পরে দেখা যায় অন্য লোক।
লালু শেখ দিন দিন অসুস্থ হয়ে পড়ে। এলাকার লোকজন, তার চাচাতো ভাই জুম্মান দু’এক সময় টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করে। কখনও লালু শেখ মোড়ের দোকানে বসে এক কাপ চা আর টোস্ট বিস্কুট খেয়ে দিন পার করে। কোনোদিন কিছুই খায় না। ঘরে এসে পানি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। পুলিশ বহুদিন ধরে সোবাহানের খোঁজ করে কিন্তু কোথাও খুঁজে পায় না। কেউ বলে সোবাহান ইন্ডিয়া চলে গেছে, কেউ বলে লালবাগে লুকিয়ে আছে। পুলিশ সোবহানকে ধরার জন্য লালু শেখের বাড়ির পাশে ওত পেতে থাকে। কিন্তু কোনোদিন সোবাহান বাড়িতে আসে না। লালু শেখ ছেলের আশা ছেড়ে দেয়।
কখনও শোনা যায় সোবাহান ক্রস ফায়ারে মারা গেছে। এভাবে বছরের পর বছর সোবাহানের ফেরারি জীবনের গল্প গোল হয়ে ঘুরতে থাকে লালবাগের ঘরে ঘরে। গল্পের নানা ডাল-পালা গজায়। লালু শেখ জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে গলির মোড়ে শুয়ে থেকে। কেউ তাকে টাকা-পয়সা দিলে বনরুটি, চা কিনে খায়। লালু শেখ সব হারিয়ে রিক্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু দাদি নূরজাহান বিবির মুক্তার দুলজোড়া হাতছাড়া করে না। সবসময় কোমরে একটা থলেতে লুকিয়ে রাখে। ঘরে যা জিনিসপত্র ছিল সবকিছুই বিক্রি করে খেয়ে ফেলেছে। এতো সাধের সিন্দুকটাও নাই। শুধু মুক্তার দুলজোড়া কোনোদিন বিক্রি করতে পারে না। দুলজোড়া সাথে থাকলে তার মনে হয় লাইলী সাথে আছে। স্মৃতিতে লালু শেখ পুরানো আমলে ঘুরে বেড়ায়। বড় বড় জাহাজ, সাহেব-সুবো সবাই সে জাহাজ থেকে সদরঘাটে নামছে, ওর দাদা ওই জাহাজ চালিয়ে আনছে। ময়দান লোকে সয়লাব। তার মধ্যে দিয়ে লালু শেখ হেঁটে বেড়ায়। তার স্ত্রী জোৎস্না বেগম জ্বিনের কাছ থেকে আঙুর, বেদানা বিভিন্ন মেওয়া এনে তার হাতে দেয়। সেইসব মেওয়া খেতে বেহেস্তের ফলের মতো। কী তার খুসবু, কী তার স্বাদ! স্বপ্নে লালু শেখ সাত আসমান পার হয়ে আরও উঁচুতে উঠে যায়। যেখানে আরেকটা লালবাগ, আরেকটা জীবন। যেই জীবনের কোনো আদি নাই অন্ত নাই। কল্পনার সেই জীবনে লালু শেখ দাদি নূরজাহান বিবি, স্ত্রী জোৎস্না বেগম, লাইলী, সোবাহান সবাইকে খুঁজে পায়। এই জীবন থেকে কেউ কোনোদিন হারিয়ে যায় না। গোলাপি মুক্তার মতো ঝকমক করতে থাকে সে অনন্ত জীবন।
নভেরা হোসেন
জন্ম ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫, মাদারীপুর শহরে নানাবাড়িতে। শৈশব থেকেই ঢাকায় বেড়ে ওঠা। তিনি লেখাপড়া করেছেন ধানমন্ডির কাকলি উচ্চ বিদ্যালয়, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ এবং নৃবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। লিটল ম্যাগাজিনে লেখা শুরু করেছেন ২০০০ সালের পর থেকে। বিশেষত কবিতা, গল্প ও নৃবৈজ্ঞানিক লেখালেখি করেন। e-mail: noverahossain@gmail.com
আরও পড়ুন>> লালবাগ (পর্ব-১৪)
বাংলাদেশ সময়: ১৫৫০ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৯, ২০২০
টিএ