ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ইমরান মাহফুজের একগুচ্ছ কবিতা

ইমরান মাহফুজ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ২, ২০২০
ইমরান মাহফুজের একগুচ্ছ কবিতা কবি ইমরান মাহফুজ, ফাইল ফটো

দুধ সংকটে রাষ্ট্র

 

রাতের জোনাকি লাফিয়ে লাফিয়ে ঘুরছে, জানালার পাশে মতি। টিনের ঘরে খড় বিছিয়ে একমাত্র বউ কলি।

কালো শরীরে মাংসের আকাল। কঞ্চির মতো চিকন ও দীর্ঘ শরীর। জোয়ান বুকের মতো যথেষ্ট স্ফীত নয় তার দুধ। দরিদ্র নিতম্ব, কোমর চ্যাপ্টা ও সরু। প্রথমে পোলা বিয়াইছে। অথচ বুকে দুধ নাই। কিন্তু আল্লার রহমতে দুধের অভাবে মরে নাই। বহাল-তবিয়তে আছে বড় হচ্ছে। পাড়া-পড়শীর ভাতের মাড় পায় ঠিকঠাক। এতেই ছাওয়াল বড় হচ্ছে, খুব অসুবিধা নেই। এখন হামাগুড়ি দিয়ে চলে; প্রায় দাঁড়াতেও পারে এটা-ওটা ধরে।

মতি কলি কাজকর্ম সেরে ঘরে এসে দরজায় খিল এঁটে শুয়ে পড়ে। তারপর আকাশে চাঁদ ওঠে। জ্যোৎস্নায় প্রহেলিকাময় হয়ে ওঠে চরাচর। পেঁচা আর ডাকছে না, থেমে যায় শিয়ালের হুক্কহুয়া, নাই কোনো কুকুরের আর্তনাদ। বুক তাদের কাঁপে, তাদের শঙ্কা বোধ হয় জ্যোৎস্নালোকিত উল্লাসে সাঁতার কাটছে ছেলেটা; তার পাশে রাজরানির মতো গা ভাসিয়ে দিয়েছে বড়বাড়ির কুকুর, দুধের ঢেউয়ের দোলায় দুলছে স্ফীত ওলান। তালুকদার-বাড়ির উঠানে কলির পোলা আরও বড় হয় কুকুরের দুধসাগরে।

গরীব রাষ্ট্র যেমন, মায়ের দুধ সংকটে পড়শির পুষ্টিগুণে গায়গতরে এগিয়ে চলে।

 

জীবন আগে না ধর্ম আগে

 

মাসি তোমরা যে দিবস রজনীতে ঈশ্বরের নামে ফুল দাও অর্চনা করো, ভক্তি করে পানি ছিটাও সকাল সন্ধ্যা তা আমার খুব ভালো লাগে। মনে হয় তোমাদের হৃদয়টাই ফুলবাগান।

কিন্তু সেদিন দেখলাম তোমার পাশের ঘরের জেঠুমশাই একমুঠো ভাতের অভাবেই হাড্ডিসার! মরণদূত আসে যায়। অথচ রাখো না তার খোঁজ। তাহলে মাসি তুমি কতটা ফুলের আর কতটা জীবনের?

আর আমার চাচা তো কোটি টাকার মসজিদে আল্লাহকে খুঁজে- প্রার্থনা করে প্রাত্যহিক মঙ্গলের। অথচ পাশের ঘরে না খেয়েই মরে যাচ্ছে ষাটোর্ধ নজির আলী।

জানতে ইচ্ছে করে ভবসংসারে জীবন আগে না ধর্ম আগে!

 

রান্নাঘর


বহুতল শহরে বৃষ্টিহীন লাখো লাখো রান্নাঘর। বছরের পর বছর স্বামীবিহীন স্ত্রী কিংবা স্ত্রীবিহীন স্বামী একলা একা শৈশব রান্না করে। কারণে অকারণে কলিংবেল বেজে চলে, কানের পাশে মুঠোফোন নড়েচড়ে, অনুভব করে না ভাইব্রেশন। অভিমানে ভাষাহীন বালিশজোড়া শুয়ে থাকে, ঠোঁটের আগায় কথারা আসে ফিরে; কেউ বুঝে না কাউকে। বেখেয়ালে পানির মতো দুঃখরা ঝরে অধাতুর আঘাতে।

প্রেসার কুকারের আঁচে উত্তপ্ত সঙ্গীবিহীন শরীর। বিছানায় ছটফট করে রক্তাভচোখ। মেশিন সংসারের করুণতম দিনে ডিমের মতো বর্ষসেরা অন্ধকার। জীবনের মানে খুঁজে রাখাল শরীর। মৃতপ্রায় আলোর মুখস্ত ধারাপাত। ভবঘুরের মতো সুখ ক্লান্ত নদীর মতো শুয়ে থাকে। শৈশবের ভীষণ আনন্দ চিৎকার ক্রমশ দুর্গমে নর্তকীর পথে হারায়। নাগরিক অন্ধকারও জানে পৃথিবীতে লাবণ্য জোছনা প্রেমবিনে পরিত্যক্ত। প্রেম হারনোর ভয়ে রাজা ছেড়ে যায় রাজ্য। বেদনার মসনদ করে হাহাকার। সবুজ পাতারাও ঝরে পরে মায়াশূন্যতায়। আর প্রেমবিনে কেউ কী বাঁচে শতাব্দীর সংসারে!

 

পৃথিবীতে নেই কোনো বিশুদ্ধ চাকরি


আত্মশূন্য দুনিয়ায় বঞ্চিত শ্রমজীবী লেখক ও শিক্ষক। লেখকদের ঝোঁক পেশা দুটোর গোড়া থেকেই। লেখালেখির কাছাকাছি থাকার জন্য দুটোর একটি বেছে নিতেন অনেকে। তাদের দেখে কেউ মুচকি হাসে, কেউ কাটে টিপ্পনি।

কিন্তু বিশ শতকে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লেখাকে জীবিকা করার প্রথম উদাহরণ। ব্যতিক্রম সমরেশ বসু। প্রথম যৌবনে নকশাকারের চাকরি ও সবজি বিক্রির কাজ করলেও পরবর্তীকালে লেখাকেই জীবিকা হিসেবে নেন। সেজন্য তাঁকে অসহনীয় দারিদ্র্যের মোকাবিলা করেতে হয়েছে। একুশ শতকে তাঁর দোসর আসেন হুমায়ূন আহমেদ।
এর আগে ও পরে এপথে অনেকে এলেও সবার ভাগ্যে খুব সুখ জুটেছে তা বলা যায় না। বঞ্চিত বাঙালি লেখক কখনও খুঁজে পায়নি প্রকৃত জীবিকা।

রবীন্দ্রনাথ করতেন জমিদারি দেখভাল, সাংবাদিকতা করতেন নজরুল। জীবনানন্দ ও জসীম উদ্দীন করতেন শিক্ষকতা, জগদীশ গুপ্ত টাইপিস্ট, মাহমুদ রাহমান সাংবাদিকতা, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় জমিদারি স্টেটে চাকরি ও স্কুলে শিক্ষকতা। কিন্তু তাঁর আত্মভোলা জীবনাচরণ কখনও লেখা আর জীবিকার দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেনি। আবুল মনসুর আহমদের জীবিকা সাংবাদিকতা ও আইন পেশা। কমলকুমার আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা পরে শিক্ষকতা করতেন।

দেশের দেয়াল টপকালে মিলবে চার্লস ডিকেন্স কারখানার শ্রমিক, ফিওদর দস্তয়েভস্কি প্রকৌশলী, রবার্ট ফ্রস্ট শিক্ষক, আর্থার কোনান ডয়েল সার্জন, জমস জয়েস সিনেমা অপারেটর, হার্পার লি টিকিট এজেন্ট, জ্যাক লন্ডন ঝিনুক চোর, ফ্রাঞ্জ কাফকা আইন অফিসের কেরানি, জ্যাক কেরুয়াক ডিশ ওয়াশার, হারম্যান মেলভিল ব্যাংক কেরানি, জর্জ অরওয়েল ইন্ডিয়ান ইম্পেরিয়াল পুলিশ অফিসার, মার্গারেট অ্যাটউড কফিশপ কর্মচারী, নাগিব মাহফুজ সাংবাদিক, আল্লামা ইকবাল ও মওলানা রুমি ছিলেন আইনজ্ঞ।

মেধা আর প্রতিভা শব্দ দুটো পাশে সরিয়ে রেখে, কতজন কত আত্মঘাতী পেশায় সময়কে তুড়িমেরে উড়িয়ে দিয়ে চালিয়ে নিয়েছেন লেখালেখি। অর্থ আর কীর্তির বাইরে কেবল সচ্ছলতার জন্য বিপন্ন বিস্ময় হয়েই থাকবে লেখক জীবন!

আসলে পেশা আর নেশা ছাড়াও শিল্পীদের অস্থিরতা কাল থেকে কালান্তর। দস্তয়েভস্কির মতো কেউ জুয়া খেলা, তলস্তয়ের মতো কেউ পাপ ও পূণ্যের দ্বন্দ্বে ভুগে কখনও ভূমিদাসীর গর্ভেও সন্তানের জন্ম দেন। কার্ল মার্কস পরিচারিকার সন্তানের পিতা হয়েছিলেন। আবার মাইকেল মধুসূদন দত্তের মতো কেউ মদে উড়িয়ে দেন সব সঞ্চয়। হালের হেলাল হাফিজ সারাজীবন জুয়া খেলায় সঁপেছেন জীবন।

লেখাই লেখকের একমাত্র ধ্যান। কিন্তু সে ধ্যানে বাঙালি লেখক কখনোই যোগী হতে পারেননি। উনিশ শতকে ঈশ্বর গুপ্ত, বঙ্কিমচন্দ্র আর দীনবন্ধু মিত্র সাংবাদিকতা বা সরকারি চাকরি করেছেন। বুদ্ধদেব লিখেছেন, ‘বাড়িতে হাঁড়ি চড়ে তাঁর কলমের নিব ঘষে’। যদিও মুজতবা আলীর বিষয়টা একটু উল্টো। প্রথম লেখা দেশে বিদেশে দিয়েই বিখ্যাত। কিন্তু শিক্ষকতা বা সরকারি চাকরি কোথাও তাঁকে স্বস্তি দেয়নি। ওদিকে চাকরি যখন থাকত, তখন কলম চালাতে চাইতেন না। বলতেন, দেরাজে পয়সা থাকলে লিখব কেন?

অথচ জেনে শোনে বিষ কেউ যদি করে পান, তারে আর কী বলা যায়। যা হবার তাতো হয়েই গেছে। আর যা হবার তাই হবে। লেখক জীবনের কোনো ব্যাকরণ নেই। আর পৃথিবীতেও নেই কোনো বিশুদ্ধ চাকরি!
তাই যতক্ষণ মনে আরামে দোকান খোলা রাখা যায়!

 

আমি কিন্তু যামুগা


আজকাল সবাই এমন করে, মনে হয়- আমি ছিনিয়ে নিয়েছি রাজ্যের গুপ্তধন। ভ্রাম্যমাণ হকারের মতো মিছেমিছি ঝগড়া করে। কেউই মায়ার বুলিতে কাছে ডাকে না। শোনে না মনের কথা। দেখে না লুকিয়ে ক্লান্ত মুখচ্ছবি। চাকরের মতো বাহিরে রেখেই কথা কয়। কী অদ্ভুত দুনিয়া রে! মুখের ওপর দরজা ঠাস করে বন্ধ কইরা দেয়। সোফায় গা এলিয়ে পা নাড়ে ঘনঘন। একটু বসতেও দেয় না। এইভাবে রক্তাক্ত করে মানুষকে অমানুষ! ধীরে ধীরে আমি আমাকে বুঝাই প্রতিশোধ নিতে গিয়ে থেমে যাই। অভিমান হয় বড্ড অভিমান প্রেমহীন সমাজের প্রতি, প্রেমহীন মানুষের প্রতি।

মাঝে মাঝে কইতে ইচ্ছে করে তুমরা আমার লগে ক্যান এমন করো! ক্যান বারে বারে চ্যাতাও। আমি কিন্তু যামুগা। দুক্খো বুকে লইয়া পক্কির লাহান উরাল দিমু।

পরিচিতি:
ইমরান মাহফুজের জন্ম ১০ অক্টোবর ১৯৯০ কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রামের কোমাল্লা গ্রামে। ধর্মে মুসলিম, জাতে বাঙালি ও জন্মে বাংলাদেশি। বাবা বীরমুক্তিযোদ্ধা নুরুল আলম ও মা বিলকিছ বেগম। একাডেমিক পড়াশোনা উদ্ভিদবিদ্যায়, লিখেন বাংলায়, কাজ করেন ইংরেজি দৈনিকে। গবেষণা ক্লাসিক সাহিত্যে, সম্পাদনা করেন কালের ধ্বনি। তার সম্পাদনা ও গবেষণা গ্রন্থ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স, মাস্টার্স ও এমফিলে পাঠ্য সহায়ক হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। লেখালেখি শুরু ২০০৫ সাল থেকে।

প্রকাশিত গ্রন্থ
কায়দা করে বেঁচে থাকো (ঐতিহ্য)
আজ ও আগামীকাল (ডেইলি স্টার বুকস)
দীর্ঘস্থায়ী শোকসভা (ঐতিহ্য)
দ্য ইকুয়েশন অব লাইফ (কালের ধ্বনি)
মুক্তিযুদ্ধের অজানা অধ্যায় (জাগৃতি)
জীবনশিল্পী আবুল মনসুর আহমদ (আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পরিষদ)
লালব্রিজ গণহত্যা (১৯৭১: গণহত্যা ও নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্ট)
আবুল মনসুর আহমদ স্মারকগ্রন্থ (প্রথমা)
কষ্টের ফেরিওয়ালা: হেলাল হাফিজ, যৌথভাবে সম্পাদিত (বিভাস)

প্রামাণ্যচিত্র
‘দুর্লভ এই আলো’
সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদকে নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র।

অর্জন
পশ্চিমবঙ্গের যুগ সাগ্নিক একুশে সম্মানা ২০১৯।
কমনওয়েলথ ইয়ুথ ফিউচার সামিট স্মারক ২০১৮।
অল ইন্ডিয়া রেডিও আকাশবানী কলকাতা স্মারক ২০১৮।
সিএনসি আবুল মনসুর আহমদ গবেষণা পুরস্কার ২০১৮।
আবুল মনসুর আহমদ গবেষণা পুরস্কার ২০১৫।
শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন স্মৃতি পুরস্কার ২০১৩।

বাংলাদেশ সময়: ১৫১০ ঘণ্টা, নভেম্বর ০২, ২০২০
টিএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।