আফ্রিকি কথাসাহিত্যিক-নাট্যকার-প্রাবন্ধিক নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো তাঁর দেশে ইয়োরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসনের আওতায় সংঘটিত ভাষিক নির্যাতনের অনেক অজানা দিক উন্মোচিত করেন তাঁরই ডিকলোনাইজিং দ্য মাইন্ড : দ্য পলিটিক্স অফ ল্যাঙ্গুয়েজ ইন আফ্রিকান লিট্রেচার (১৯৮৬) গ্রন্থে।
উপনিবেশের প্রবর্তকেরা, থিয়োঙ্গোর ভাষ্যানুযায়ী, প্রথমে তাক করে অস্ত্র আর তার ঠিক পেছনে প্রতিষ্ঠা করে স্কুল।
অভাবক্লিষ্ট শিশুদের পক্ষে জরিমানা পরিশোধ কঠিন হয়ে পড়ে। প্রতিদিন এক ছাত্রকে দিয়ে দেওয়া হয় কিছু বোতাম। তার দায়িত্ব মৌখিকভাবে মাতৃভাষা ব্যবহারকারী সহপাঠীদের হাতে একটি একটি ক’রে সেই বোতাম দেওয়া। স্কুল ছুটি না-হওয়া পর্যন্ত সেই বোতাম হাতে রাখার নির্দেশ শিক্ষক আগেই দিয়ে রাখেন। এভাবই দিন শেষে ধরা হয় অপরাধীদের। আফ্রিকিদের নানান মাতৃভাষার ব্যবহার চলে কেবল পরিবার এবং তৃণমূল পর্যায়ে, মৌখিকভাবে। লেখকগণও জোরারোপিত বিদেশি ভাষায় লিখতে বাধ্য হন।
থিয়োঙ্গো নিজে মাতৃভাষায় লিখতে শুরু করেন প্রায় দেড় যুগ ইংরেজিতে লেখার পর। তিনি আফ্রিকার কৃষক ও শ্রমিকদের মাতৃভাষায় বিপ্লবী সাহিত্য রচনায় ব্রতী হন। বাংলাদেশের বাস্তবতা থিয়োঙ্গোদের অনুরূপ না হওয়া সত্ত্বেও আমাদের আঞ্চলিক জবানসমূহকে যেমন আমরা উপেক্ষা করি না তেমনি প্রমিত ভাষাকেও শত্রু ভাবতে আমরা অক্ষম। কেননা আঞ্চলিক ভাষা প্রমিত ভাষার ব্যাকরণেরই আওতাভুক্ত। কিন্তু প্রমিত ও আঞ্চলিক, জাতীয় ও বিজাতীয় ভাষাসমূহের মধ্যে একটি যখন অপর কোনোটির ওপর আধিপত্যবাদী, দমনকারী এবং স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে তখন দলিত জবানের মানুষদের আন্দোলনে ফেটে পড়তে হয়। আমাদের ইতিহাসে এভাবেই দ্রোহ, প্রতিরোধ ও প্রাণদানের গৌরবে অমর হয়ে ওঠে বায়ান্ন’র মহান ভাষা আন্দোলন।
উপর্যুক্ত প্রেক্ষাপটে উত্তর ঔপনিবেশিক চেতনা একজন কবি-লেখককে সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতায় সচকিত করে। সাহিত্যে এই বিরুদ্ধতার অভিব্যক্তির রাজনীতিক ও সাংস্কৃতিক দুটি ধরন থাকে। রাজনীতির বিষয় প্রধানত প্রবন্ধে এবং বিশেষত ও অংশত, আমাদের দেশে, সংস্কৃতিগত লড়াইয়ের প্রশ্ন ও প্রসঙ্গ, কবিতায় বাঙ্ময়তা লাভ করে বেশি। বিশ্বকথা ও নাট্যসাহিত্যে তো তা রাজনীতিক-সাংস্কৃতিক উভয়রূপে প্রকাশিতই। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই আসে ভাষাশ্রয়ী সচেতনতার প্রশ্ন।
প্রসঙ্গত ভুলে গেলে চলবে না যে, মানবেতিহাসে কবিতা লিখিতরূপে দাঁড়ায় পরে। কবিতা প্রথমে কবির মস্তিষ্কে রচিত হয়ে মুখে উচ্চারিত হয় মাত্র। শ্লোক এবং প্রবচনকেও কবিতার আদি রূপ বলা যায়। পুঁথি, গাথা ইত্যাদিরও ছিলো শ্রোতৃমণ্ডলি। এক পর্যায়ে আমাদের ভূখণ্ডে সামন্ত প্রভুদের পৃষ্ঠপোষকতায় কাব্য রচিত-লিখিত হতে শুরু করে। রাজকীয় আওতার বাইরেও কবিতা বা কাব্যপ্রতিম রচনা, স্থানীয় পর্যায়ে, গ্রামে গ্রামে রচিত-লিখিত হয়। ইয়োরোপে, শিল্প বিপ্লবের পর, এবং, পৃথিবীর অন্য অনেক দেশে ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ প্রভাবে, কবিতা তথা সাহিত্যও ক্রমান্বয়ে অর্জন করে এক প্রকার প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি। উপনিবেশের প্রবক্তারা তাদের অধিকৃত দেশের সাহিত্যকে অপর বা গৌণ জ্ঞান করতে শুরু করার সমান্তরালে শ্রেণী বিভক্তির প্রায়-অমোঘতায়, ওই বিজিত দেশগুলোর অভ্যন্তরেও, মধ্যবিত্তের সাহিত্যই ‘মূলধারার’ সাহিত্য হয়ে উঠতে শুরু করে। উপনিবেশের মধ্যবিত্ত পাঠকরাও মাইক্রো লেভেলের ওই মৌলিক সাহিত্যকেও ‘লোক সাহিত্য’ অভিধায় দূরে ঠেলে এর আলাদা শ্রেণীকরণ ঘটায়। প্রাগুল্লিখিত কবিতারও শ্রেণীকরণের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় সাহিত্যেও মার্কস-কথিত প্রলেতারিয়েতের সৃষ্টি গ্রাম আর বুর্জোয়াদের নির্মাণ নগর পৃথক হওয়ার পশ্চাতে উপনিবেশবাদও প্রায়ই দায়ী।
উল্লিখিত পটভূমিকায় শূন্য দশকে লোকসাহিত্যের তরুণ সংগ্রাহক-সম্পাদক-গবেষক শামসুল আরেফীন আত্মপ্রকাশ করেন তাঁর রচিত ২৫৯টি রুবাইয়ের সংকলন রুবাইয়াত-ই-আরেফীন (ফেব্রুয়ারি ২০১৪) যোগে। উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে তাঁর সাংস্কৃতিক যুদ্ধের প্রথম ধরনটি ভাষাকেন্দ্রিক। তিনি প্রমিত বাংলায় অন্তর্ভুক্ত করেন দক্ষিণ চাটগাঁর শব্দরাশি। এ-কাজের পথিকৃৎ হাফিজ রশিদ খানের (তাঁর এ-সংক্রান্ত প্রথম কাব্য আদিবাসী কাব্য) পরে আরেফীন এ-বিষয়ে উদ্যোগী হন এবং একইভাবে কর্তৃত্বকারী বচনকে প্রভাবিত করেন কর্তৃত্বহীনের বচন ও বাচন দ্বারা। কেবলই কি তাই? তিনি উল্লিখিত ক্ষমতাহীন ভাষার অংশবিশেষকে কিয়ৎ পরিমাণে হলেও ক্ষমতাপূর্ণ বাংলা ভাষার কাব্যিক অঙ্গেও পরিণত করেন।
এভাবে সিরাজুল হক সিরাজ কক্সবাজারের এবং জহির হাসান যশোরের ভাষার শব্দ নিজ নিজ কবিতায় অঙ্গীকৃত করেন। এ কি কিছুটা ফ্রাঞ্জ ফানোর রচনার ধরনে সমাজতান্ত্রিক জাগরণের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে চায় আমাদের? না। কেননা ‘জাতীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে’ শীর্ষক প্রবন্ধে (জগতের লাঞ্ছিত গ্রন্থভুক্ত) ফানো বলেন : জাতীয় সংস্কৃতির যুদ্ধ সর্বাগ্রে একটি জাতির মুক্তির যুদ্ধ; জাতীয় মুক্তি হচ্ছে কাঠামো-যার ওপর গড়ে উঠতে পারে সংস্কৃতির প্রাসাদ। গণমানুষের সংগ্রামের বাইরে সাংস্কৃতিক সংগ্রামের কোনো অস্তিত্ব নাই।
তাহলে আরেফীনের রুবাইয়াতের প্রাসঙ্গিকতা কোথায়? পঁয়তাল্লিশ বছর আগেই তো আমরা লাভ করি সর্বশেষ উপনিবেশ ও এর ভাষিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে জাতীয় মুক্তি। তাছাড়া আদিবাসীদের ধরনে চাটগাঁর গ্রামীণ সমাজ তো উপনিবেশিত নয়। তাহলে? গ্রামেও হাজির ধনতন্ত্রের শকটের (মুক্ত বাজার অর্থনীতির আওতায় যা কিনা পশ্চিমা পরোক্ষ সাম্রাজ্যবাদের বাহন) মুখে স্থানিক সংস্কৃতির ক্রম অবলোপনে আরেফীন বেদনার্ত। তাই লোকশ্রুতি-বিশ্বাস-পুরাণের বিস্তর অনুষঙ্গের অবিরলতায়, তিন গুচ্ছে সজ্জিত রুবাইয়াতে, তিনি হাহাকার মুদ্রিত করেন। সেইসঙ্গে এসব অনুষঙ্গের রূপকেও তিনি স্থানীয় ও জাতীয় নানান হৃতাবস্থার অনুবাদ সম্পন্ন করেন। অসঙ্গতি দেখিয়ে দেন ব্যঙ্গ-পরিহাসযোগে।
প্রথাবদ্ধ মূল্যায়নে অনাগ্রহী হওয়া সত্ত্বেও বর্তমান গদ্যকারকে আরেফীনের রুবাইয়ের অল্প কিছু অংশ উদ্ধার করতেই হয় : (১) শঙ্খ থেকে এক বেয়ালে নিয়েছিলাম এক ঘটি জল;/সুদ-আসলে সেই যে দেনা হয়েছিল ওই হিমাচল। /শঙ্খ হঠাৎ চাইলে তাহা, আমি দিতে ব্যর্থ হলে,/দখল করে নিয়েছিল আমার পুরো কদম্বতল। (রক্ত ঝরার কাল এসেছে; রুবাইয়াত-ই-আরেফীন) (২) হাজার চাঁপা চুমু খেল চান্নিভরা এই অধরে/তবু আমি হইনি মাতাল, বলছি দারুণ সত্যি করে। /পদ্মাবতী চুমুর আশে যেই চেয়েছে অধরপানে,/উথাল-পাথাল ঘটে গেছে বক্ষ-ডলুর বালুচরে। (সোনাই বিবির সোনার দেশে; ঐ) (৩) সেই যে ধৃতরাষ্ট্র-রাজা হাজার হাজার বছর পরে/ফিরে এলো অশ্বে বসে সুনামপুরের কালনীচরে। লাভ হলো না কালনীচরের; শকুনি ও রাজপুতেরা/রাজ-অমতে কালনীচরের ভাঙলো মাজা ভয়াল ঝড়ে। (মন তো আমার কৃষিভূমি; ঐ) রুবাইয়াতের উপর্যুক্ত প্রথমাংশে শহরে গ্রামের প্রবেশ, ধর্মাশ্রয়ী সংস্কৃতির ইন্দ্রিয়বিলাসে বদল, উচ্চবিত্তের স্ফীতি, সর্বহারার পেশা পরিবর্তন ও হরণ, বিদেশী সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ, অসাম্প্রদায়িকতার মৃত্যু, দেশীয় সংঘাতময় ক্ষমতালিপ্সু রাজনীতি, শ্রেণীশোষণ, কবির অকিঞ্চিৎকরতা, গণতান্ত্রিক আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অগাধ ভালোবাসা ইত্যাদি অভিব্যঞ্জিত হয়।
দ্বিতীয়াংশে মুক্ত প্রেমানুভূতি, কামচেতনা, ইন্দ্রিয়বিলাসের ধর্ম-অতিক্রমী সামাজিকতা, পরকীয়ার দুঃখ, প্রেমে প্রত্যাখ্যান লাভ, ভিলেনের আবির্ভাব, বিরহ প্রভৃতি বাঙ্ময়তা লাভ করে। বইয়ের শেষাংশে শাসন-শোষণের ধারাবাহিকতা ও পুঁজির প্রভাবে গ্রামীণজনের একাংশের উচ্চভাবসহ কিছু পরিবর্তমান বাস্তবতা অনূদিত হয়। লক্ষণীয়, লোকসাহিত্যের পরিচিত মননশূন্যতা বিষয়ে সজাগ থেকেই লোকজ অনুষঙ্গ ব্যবহারে প্রাণিত থাকেন আরেফীন। যদিও, দুঃশাসনকে ধৃতরাষ্ট্রের রূপকে চিহ্নিত করলেও অপশক্তি শনাক্তকরণে তাঁর ‘অসুর’ রূপকটির ব্যবহার প্রশ্নসাপেক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। কেননা, দুর্গা আর্য-শাসনের রূপক হলেও মহিষাসুর দলিত কৃষকসমাজের প্রতিনিধি হিসেবেই এরই মধ্যে স্বীকৃত।
শাহিদ হাসান সম্পাদিত আলোচ্যমান গ্রন্থে’র শেষে তাঁর ১১ পৃষ্ঠার একটি গবেষণামূলক-তথ্যবহুল গদ্য সংযোজিত হয়। বিশ্ব ও বাংলা রুবাইয়ের আধারে, বহুলচর্চিত জনবিচ্ছিন্ন ইন্দ্রিয়বিলাসের পরিবর্তে, আরেফীনের লোকজীবনানুষঙ্গ সংস্থাপনের বিষয়টিকে তিনি অভিনন্দিত করেন। তবে আড়াই শতাধিক রুবাই একই স্বরবৃত্ত ছন্দে (চরণ শেষে ক/ক/খ/ক মিলযোগে) রচিত হওয়ায়, প্রাকরণিক বৈচিত্র্যহীনতার দরুন, আগ্রহী পাঠকও ক্লান্তি অনুভব করেন। রুবাইগুলো আরো দুটি ছন্দ পয়ার এবং মাত্রাবৃত্তেও রচিত হতে পারতো। বাংলা ভাষায় এর নজিরও আছে। এতে কারুরই পাঠতৃষ্ণা ব্যাহত হতো না।
দ্বিতীয়ত উল্লেখ্য, আরেফীন প্রায় প্রত্যেক রুবাইয়ে, মূলত ও প্রধানত ‘এই এই ছিলো, এই এই নেই’ ধরনের ভাষ্য ও বাগভঙ্গি প্রতিষ্ঠিত করেন বিধায় তা গ্রাম্য কথক বা স্বভাব কবির উচ্চারণের মতো শোনায়। ফলে নিজের কবিত্বকে পরীক্ষিত করে তোলার পর্যাপ্ত সুযোগ তিনি নিজেই রাখেন না। পুরনো ওই বিশেষ আঙ্গিকের আধেয় বদলে দিয়ে শামসুল আরেফীন, এক অর্থে, লোকজ রুবাই রচেন বলেই কি এমনটি হয়? তবু, তাঁর সম্পর্কে, তাঁরই বইয়ের উৎসর্গপত্রের (আসহাব উদ্দীন আহমদকে উৎসর্গিত) ভাষায় (অতীত ও ‘তুমি’বাচক হলেও) বলতে হয়, ‘সোলায়মানের আকাশযানের অসীম বেগে তাই সে গিয়ে/হয়েছিল ঝিরিবুকের মানকচুটির পাতার ছায়া। ’
খালেদ হামিদী : কবি, গল্পকার ও প্রাবন্ধিক