ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

‘মান্নান হীরাকে বাঙালি চিরদিন মনে রাখবে’

ফিচার রিপোর্টার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১১০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৮, ২০২১
‘মান্নান হীরাকে বাঙালি চিরদিন মনে রাখবে’

ঢাকা: বাংলাদেশের পথনাটকের অন্যতম পুরোধা পুরুষ নাট্যজন মান্নান হীরা। সর্বতোভাবে নাট্যপ্রাণ এই ব্যক্তি সবসময় ভেবেছেন নাটককে ঘিরেই।

সেটা মঞ্চনাটক হোক বা পথনাটক। নাটকের মাধ্যমে তিনি যেমন বিশ্বসংসারকে দেখেছেন, তেমনি বাংলাদেশকেও দেখেছেন। একইসঙ্গে নাটকের মাধ্যমে তিনি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের মূল্যবোধকে উপলব্ধি করতে চেয়েছেন এবং তাকে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন।

শুক্রবার (৮ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় দেশের বরেণ্য অভিনেতা ও নাট্যকার মান্নান হীরাকে স্মরণ করতে গিয়ে এমনটাই বললেন দেশের বিশিষ্ট সংস্কৃতিজনেরা।

রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এই স্মরণসভার আয়োজন করে বাংলাদেশ পথনাটক পরিষদ।

মূল মিলনায়তনের বাইরে সন্ধ্যায় আয়োজনের শুরুতেই মান্নান হীরার লেখা গান ও নাটকের অংশ বিশেষ পরিবেশনের মাধ্যমে শুরু হয় স্মরণসভার কার্যক্রম। এরপর প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ও মান্নান হীরার জীবন ও কর্মের ওপর প্রদর্শন করা হয় ভিডিওচিত্র।

পরে মিলনায়তনের স্মরণানুষ্ঠানে গুণী এই নাট্যজনকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন নাট্যকার, নির্দেশক ও অভিনেতা মামুনুর রশীদ, আতাউর রহমান, শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী, নাট্যজন লাকী ইনাম, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ,  নাট্যকার ও নির্দেশক মাসুম রেজা, ঝুনা চৌধুরী, পথনাটক পরিষদের সহ-সভাপতি মিজানুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক আহম্মেদ গিয়াস, নাট্যকার রতন সিদ্দিকী, শাহ আলম দুলাল প্রমুখ। এসময় উপস্থিত ছিলেন আরও অনেকে।

মান্নান হীরাকে স্মরণ করে মামুনুর রশীদ বলেন, মান্নান হীরার কাজের মধ্যেই মানুষের জন্য ভালোবাসা ছিল। তার নাটকে মানুষের জন্য কত সংলাপ ছিল, অথচ তিনি এখন আর সেই সংলাপগুলো লিখবেন না। বড় বেশি ক্ষতি হয়ে গেল! আমরা দুই বাংলাতে যারা থিয়েটার করি, তাদের সকলের কণ্ঠ ম্রিয়মান। এই ম্রিয়মান কণ্ঠের ভেতর মান্নান হীরা যে আলো ফেলেছিল, সেটি তার চলে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে নিভে গেল। প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে তার পথনাটকের হাল এখন কে ধরবে, তাও অনিশ্চিত। আশা করি তরুণরা এগিয়ে আসবে। আর আপনাদের মতো আমারও তাকে না বলা অনেক কথা রয়ে গেছে, থেকে যাবে।

নাট্যজন আতাউর রহমান বলেন, প্রচারবিমুখ মানুষ ছিলেন মান্নান হীরা। আমার একটা প্রত্যয় জন্মেছে- নাটকের মানুষগুলোর মধ্যে সম্ভবত আমিই এখন সবচেয়ে বয়োবৃদ্ধ। আমি অনুভব করেছি মান্নান হীরা আমাদের জন্য ‘নিত্য’ হয়ে থাকবেন। শেক্সপিয়রকে মানুষ যেমন চারশ বছর পরেও স্মরণ করছে, মান্নান হীরাকেও তেমনি বাঙালি চিরদিন মনে রাখতে বাধ্য হবে। বিশ্বসাহিত্যেও তার জ্ঞান ছিল অনন্য। সে তার কর্মের মধ্য দিয়ে আমাদের মধ্যে প্রতিদিন ফিরে আসবে।

লিয়াকত আলী লাকী বলেন, এই শিল্পী যেসব সৃষ্টি দিয়ে আমাদের ও আমাদের দেশকে উপকৃত করেছেন, তা অনন্য। তিনি যেসব সৃষ্টি রেখে গেছেন। সেসব নিয়ে আমরা আরও উপকৃত হতে পারি। সাদাসিধে এই মানুষটার প্রত্যেকের সঙ্গে ছিল ভালো সম্পর্ক। তাকে বাইরে থেকে দেখে বোঝা যেত না তিনি এমন শিল্পবোধ সম্পন্ন একজন মানুষ।

লাকী ইনাম বলেন, সবাই চলে যাবে, তবে কিছু কিছু মানুষের চলে যাওয়া সমাজের জন্য অত্যন্ত কষ্টকর। মান্নান হীরাও তাই। আমরা মেধাহীন হয়েও মেধার প্রচারের জন্য উন্মাদ হয়ে যাই। মান্নান হীরা সত্যিকারের মেধাবী হয়েও ছিলেন নিভৃতচারী।

গোলাম কুদ্দুছ বলেন, আমাদের চেতনার বাতিঘর ও অন্যতম কাণ্ডারি ছিল মান্নান হীরা। সমাজের প্রতি তিনি একজন দায়বদ্ধ মানুষ ছিলেন। জীবনের এমন কোন প্রেক্ষিত নেই যেখানে তিনি শিল্পের আলো ফেলে কাজ করেননি। তিনি লড়াই করেছেন তার চেতনা ও বুদ্ধিবৃত্তি দিয়ে।

ঝুনা চৌধুরী বলেন, তাকে নিয়ে আরও বেশি আলোচনা করতে হবে। যারা মনের ভেতর শক্তি যোগায় তাদের মধ্যে মান্নান হীরা অন্যতম। সে একদিকে যেমন বন্ধু, ঠিক তেমনি শিক্ষক ও অনুপ্রেরণার জায়গা।

কথামালার বিরতিতে আবৃত্তি পরিবেশন করেন বাচিক শিল্পী রফিকুল ইসলাম, শাহাদাৎ হোসেন নিপু, মাহফুজা আক্তার মিরা। অনুষ্ঠানে শোকসঙ্গীত পরিবেশন করেন চেতনা রহমান ভাষা ও কাজী মানাফ।

গত ২৩ ডিসেম্বর বুধবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন এই নাট্যব্যক্তিত্ব। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর।

নাটক রচিয়তা হিসেবে মান্নান হীরা বাংলাদেশে নাট্য ইতিহাসে এক বিশিষ্ট নাম। তিনি পথ নাটকের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন দীর্ঘ দিন ধরে। মান্নান হীরা প্রায় ১৫টি নাটক লিখেছেন। তার উল্লেখযোগ্য নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে- লাল জমিন, ভাগের মানুষ, ময়ূর সিংহাসন, সাদা-কালো ইত্যাদি। এছাড়া ‘মূর্খ লোকের মূর্খ কথা’ মান্নান হীরা রচিত ও নির্দেশিত অন্যতম পথনাটক।

নাটক রচনার পাশাপাশি তিনি গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি নাটক পরিচালনাও করেন। ২০১৪ সালে তিনি সরকারের অনুদানে শিশুতোষ চলচ্চিত্র একাত্তরের ক্ষুদিরাম তৈরি করেন। এটি তার পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র। এ ছাড়া ‘গরম ভাতের গল্প’ ও ‘৭১-এর রংপেন্সিল’ নামে দুটি স্বল্পদৈর্ঘ্যও পরিচালনা করেন। নাটক রচনার জন্য তিনি ২০০৬ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার অর্জন করেন।

বাংলাদেশ সময়: ২১১০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৮, ২০২১
এইচএমএস/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।