ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

আলম শাইন ও জন্মদিন সংস্কৃতি প্রসঙ্গে...

নাসির আহমেদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬১১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৭, ২০২২
আলম শাইন ও জন্মদিন সংস্কৃতি প্রসঙ্গে... রম্যলেখক আলম শাইন

যেকোনো জন্মদিনই আনন্দের। তা সাধারণের হোক আর বিখ্যাত জনেরই হোক।

তবে যারা শিল্প-সাহিত্যের চর্চা করেন, প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সৃষ্টির মধ্য দিয়ে তারা আসলে নিজেকেই নিরন্তর পুনর্জন্ম দিয়ে চলেন। এখানেই সৃষ্টিশীল আর সাধারণ মানুষের জন্মদিনের পার্থক্য।  

আমাদের দেশে জন্মদিন পালনের বিষয়টি আগে সাধারণের মধ্যে ছিল না বললেই চলে। যারা বিত্তবান বা নগর-সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত, তাদের সন্তানের জন্মদিন ঘটা করে হলেও সাধারণ মানুষ মনেও রাখার সুযোগ পান না কবে তার সন্তানের জন্মদিন।  

বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় এ জন্মদিন পালনের রেওয়াজ সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনে একটা প্রথায় পরিণত হয়েছে, মূলত কবি শামসুর রাহমানের ৫০তম জন্মদিন পালনের ঘটনাকে কেন্দ্র করেই। এর আগে, এ অঞ্চলের কবি-সাহিত্যিকের জন্মদিন পালনের কোনো আনুষ্ঠানিকতা দেখা যায়নি। শামসুর রাহমানের মতো স্বনামধন্য কবির জন্মদিন বিশেষ করে, ৫০ বছরে পদার্পণ সঙ্গত কারণেই একটি বড় ঘটনা বলেই বিবেচনা করছেন তার বন্ধু-সুহৃদ আর পাঠকসমাজ। তো শামসুর রাহমানের জন্মদিন পালনের পথ ধরে এদেশে আরো অনেক কবি-সাহিত্যিকের ৫০তম জন্মদিন কিংবা পঞ্চাশ পূর্তিকে উৎসবে পরিণত করার একটা প্রচলন চালু হয়ে গেছে বহুদিন হলো। মজার ব্যাপার হচ্ছে, অনেক নবীন-তরুণ লেখকও তাদের জন্মদিন পালন এবং অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। কেউ কেউ ৩০-৩৫তম জন্মদিনও পালন করেন। এটা হালের একটা স্টাইল বলা যায়। এর গুণাগুণ নিয়ে কখনো কেউ ভাবেন বলে মনে হয় না। একজন লেখক যখন একটা উচ্চমানে পৌঁছে যান, খ্যাতিমান হন, তখন গণমাধ্যম আপন গরজেই তার জন্মদিনের বিশেষ আয়োজন করে থাকে। কিন্তু যারা তেমন খ্যাতিমান নন তারা নিজেরাই আয়োজন করেন। পার্থক্যটা এখানেই।

আমার মনে হয় জন্মদিনের আনুষ্ঠানিকতা বা একটা মানসম্মত অবস্থান সম্পর্কে লেখকদের সচেতন থাকা উচিত। যা-ই হোক কথাগুলো মনে এলো আমার দীর্ঘদিনের পরিচিত প্রীতিভাজন রম্যলেখক আলম শাইনের জন্মদিন নিয়ে দু-চার কথা লেখার জন্য। আলম শাইনের আত্মপ্রকাশ বলা যায় দৈনিক জনকণ্ঠের তরুণ লেখক সংখ্যার মধ্য দিয়ে। বহু রম্যরচনা ছাপা হয়েছে তার শক্রবারের সাময়িকীতে। আমাদের দেশে রম্যসাহিত্যের স্রোতটি একেবারেই ক্ষীণতর। যেমন- তরুণরা প্রবন্ধ লেখার ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ করেন, তেমনি রম্যরচনার ক্ষেত্রেও। এর কারণ কী জানি না। হতে পারে মানুষকে আনন্দ দেয়ার কাজটি কঠিন। কারণ জীবন নিরন্তর দুঃখ-যন্ত্রণা-স্রোতের উজান ঠেলে এগোয়। সে অবস্থায় তির্যক ভাষার চাবুক মেরে হাস্য-কৌতুকের অন্তরালে সমাজের অসঙ্গতিগুলো তুলে ধরেই রম্যলেখক পাঠকদের আনন্দের উপকরণ জোগান।  

কাজটা খুব কঠিন মনে হয়। কারণ ভাষার ওপর যেমন দখল থাকতে হয় তেমনি বহুবিচিত্র মানবচরিত্রকে গভীরভাবে দেখার ক্ষমতা থাকতে হয়। আর সবচেয়ে বেশি যা প্রয়োজন তা হলো তীব্র রসবোধ। বিদ্রুপ আর কৌতুককে সিরিয়াস বিষয়ের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে হয়। সুতরাং সাহিত্যের এ রকম একটি শাখায় আজ থেকে ২৭-২৮ বছর আগে একজন তরুণ যখন নিয়মিতই লেখালেখি শুরু করেন, সঙ্গত কারণে তাকে উৎসাহিত করার প্রয়োজন বোধ করি। অনেকগুলো লেখা ছাপা হওয়ার পর সেদিনের ওই তরুণের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হয়েছিল। তাকে সেদিন পরামর্শ দিয়েছিলাম সাহিত্যের অন্যান্য শাখায়ও লিখতে। আলম শাইন সেই পরামর্শ সানন্দে গ্রহণ করে একের পর এক গল্প-উপন্যাসও লিখতে থাকেন এবং অবাক হয়ে লক্ষ্য করি যে, লেখার ব্যাপারে তার উৎসাহ অপরিসীম।

প্রতিবছর বেরুচ্ছে তার উপন্যাস, রম্যরচনা, প্রবন্ধ-নিবন্ধের সংকলন। দেখতে দেখতে আলম শাইনের গ্রন্থসংখ্যা ১৭ হয়েছে। বন্যপ্রাণী, জলবায়ু, পরিবেশ ও সমসাময়িক বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন ১ হাজার ২০০টি। ১৯৭১ সালে জন্মগ্রহণকারী আলম শাইন এ বছর ১৮ জানুয়ারি ৫২ বছরে পদার্পণ করবেন। এ লেখার মধ্য দিয়ে তাকে আমি আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই। আগেই উল্লেখ করেছি, একজন লেখকের জন্মদিন তার প্রতিটি নতুন লেখার সঙ্গে নবায়ন হয়। সে বিবেচনায় নিয়মিত লিখে যাওয়া শাইন নিজেকে পুর্নজন্ম দিয়ে চলছে। মূলত তাকে সেজন্যই অভিনন্দন ও আন্তরিক শুভেচ্ছা।  

সৈয়দ মুজতবা আলী, তারপদ রায়, শিবরাম চক্রবর্তী, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়সহ অনেক বরণ্য লেখক বাংলা ভাষায় রম্যসাহিত্যকে যে মানে উন্নীত করে দিয়েছেন, তাদের পরে রম্যরচনা লিখতে হলে অবশ্যই সমকালীনতার সঙ্গে চিরকালীনতায় পৌঁছানোর অদম্য আকাঙ্ক্ষা আর তীব্র সাধনা পঠনপাঠন অনিবার্য। ‘মাইট্যা ব্যাংকের গভর্নর’, ‘ঘুষ নিয়ে ঘুষাঘুষি’, ‘আমি খাই জুতা’ এসব রম্যরচনা গ্রন্থের লেখক আলম শাইনকে সেই সাধনার অনিবার্যতার কথা আবারো স্মরণ করিয়ে দিতে চাই তার জন্মদিনের এই শুভক্ষণে।

আমি চাই ৫২-তে পা দেয়া তরুণ এ লেখক কখনো যেন প্রবীণ না হন। তার একটি উপন্যাস ‘ওস্তা’। এর পাণ্ডুলিপি পড়ে আমি ভূমিকা লিখে দিয়েছিলাম এবং উপন্যাসের প্রথম পরিচ্ছেদ জনকণ্ঠ পত্রিকার সাহিত্য পাতায় ছাপা হয়েছিল। উপন্যাসটির রিভিউ লিখেছিলাম আমি অধুনালুপ্ত আজকের কাগজ পত্রিকার সাহিত্য পাতায়।  

গ্রামবাংলার বিলুপ্তপ্রায় হাজাম সম্প্রদায়ের অন্তর্গত ছবি এ উপন্যাস। আমি অত্যন্ত খুশি হয়ে ছিলাম আলম শাইনের এ প্রয়াস দেখে। চরিত্র-চিত্রনও সুন্দর ছিল। মনে হয় ‘আমি যা দেখেছি চিনেছি, জেনেছি’- তাই হওয়া উচিত একজন লেখকের প্রিয় বিষয়। আলম শাইন ‘ওস্তা’ নামে পরিচিত গ্রামবাংলার হাজাম সম্প্রদায়কে ভালোভাবে জেনেই উপন্যাসটি লিখেছেন। তবে সাহিত্যের ভাষার সৌন্দর্য আর বিশুদ্ধতা বিষয়ের চেয়ে কোনো অংশ ছোট নয়। এর বিকাশ নিরন্তর চলতে থাকে সৃষ্টিশীল লেখকের। নিজেকে অতিক্রমেরও সাধনা থাকতে হয় প্রতিদিন।  

‘নিষিদ্ধ বাড়ি’ নিশিকন্যা’-এর মতো উপন্যাসও আবার এ লেখকই লিখলেন! কেন লিখলেন? জনপ্রিয়তার মোহে হয়তো। কিন্তু ‘নীলকুঠি হ্রদ’-এর মতো কিশোর উপন্যাস লিখুন ক্ষতি নেই, জনপ্রিয়তাও আছে এর। ‘লাল বালির দ্বীপ’, ‘ঘুণে খাওয়া বাঁশি’, ‘বনবিহারী’, ৬৩ ডিগ্রি ‘সেলসিয়াস’, ‘লাল সংকেতে জলবায়ু’র, মতো লেখা হোক আরো। লেখা হোক ‘ওস্তা’র মতো মাটিবর্তী বিষয়ের নিজের চেনা-জানা বিষয়ের জীবনঘনিষ্ঠ উপন্যাস। আলম শাইন গল্প-উপন্যাস রম্যরচনার বাইরে গত প্রায় এক দশকেরও অধিক কাল ধরে প্রকৃতি-পরিবেশ জীবজগৎ নিয়ে যে লেখাগুলো লিখছেন আমি মনে করি সেই লেখাগুলো অত্যন্ত তাৎপর্য পূর্ণ। বিশেষ করে ক্রমাগত ভারসাম্য হারানো আমাদের আবহাওয়া জলবায়ুর বিপর্যয় রোধে জনমত গঠনে সহায়ক হবে। তবে মনে রাখতে হবে বাংলা রম্যসাহিত্যের গৌরবময় স্রষ্টাদের কীর্তির কথা। পড়তে হবে তাদের রচনা তন্নতন্ন করে। তাতে আরো সমৃদ্ধ হবে রম্যরচনাগুলো।  

জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে কী মাস্টার মশাইয়ের মতো উপদেশ হয়ে গেল? নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত মানতেই হবে। কারণ তার সম্বোধনে আমি ‘গুরু’। সে হিসেবে উপদেশ দেয়ার অধিকারও রাখি।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৭, ২০২২
এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।