১.
হাওয়া যেদিন প্রথম উদাস হল, সাইকেলে ব্রেক। সিটে বসেই রাস্তায় পা দিয়ে গন্ধ শুঁকলাম।
২.
-তোর তো সময় নেই
-হুঁ
-ওই যে নার্সারির রাস্তাটা, আমবাগানের পাশ দিয়ে সেক্টর ফোর ক্রস করে থ্রি’র দিকে গিয়েছে, কী ফুলই না ফোটে এই সময়, যাবি?
-হুঁ
উদাসীনতা হুঁ-এর উচ্চারিত সামান্যয় ঘাই মারে উইথ ‘সাইকিক অটোমেটিজিম’, বোঝো! সে হয়ত এভাবেই ‘ইকরার-এ-মোহব্বত’ করছে আর তুই শালা ‘হুঁ’ কোচ্ছিস? আমায় বলল আমারই বলা। মুখ তুলে দেখি পাশের সালোয়ার, কামিজের কী-এক আনমোল সুবাস এগিয়ে গেছে অনেকটাই। আমি কী করবো? গিয়ে বলবো ওকে, চলো সজনা যাহাঁ তক ঘটা চলে?
ও চলে যায়। আমি উদাসীনতা নিয়ে, ক্ষুধার্ত বিকার নিয়ে দেখি দীপক সিনেমা’র চামড়ায় ঘাম জমছে। পোস্টারে ফেটে বেরোচ্ছে ‘উদ্ধত যত শাখার শিখরে রডোডেনড্রন গুচ্ছ’ টাইপের জমজ দুটো বুক, এক নায়িকার। আর নায়ক সানগ্লাস নামিয়ে পুরো বোকাচো... আমি নায়কটাকে খিস্তি দিলাম। সব ছেলেদেরও দিলাম, কারণ সেই সুবাসিত সালোয়ার, কামিজ আমবাগানের ট্রাফিক-আইল্যান্ডে দাঁড়িয়ে কথা বলছে একটা পাঞ্জাবি ছেলের সঙ্গে। হেসে, হেসে।
ছেলেটার বাইক আছে।
আমার নেই।
৩.
নৈনীতাল।
কোথায় যেন বাজছে, বাহোঁ মে চলি আও..
-আসবো?
খেপে গেল। লতা’র ওই মিঠা-আবহ, তবু।
তো, বেরিয়েই এলাম। মল-রোড। পেরোলেই চারদিকে পাহাড়ঘেরা সবুজপালিকা লেক। নৈনী দেবীর মন্দিরে যাবে ও। তার আগে ‘বাহোঁ মে আনা’ বা ‘চুম্মা লেনা’ পাপই প্রায়। আমি ‘পবিত্র পাপী’টি হয়ে ওর পাশে হাঁটি। নৈনী দেবীর মন্দির ঘনিয়ে আসে। ও ভেতরে যায়। আমি লেকের দিকে তাকিয়ে।
-অন্দর নহি যাওগে?
-আপ?
-ম্যায় নৈনী হুঁ
-নৈনী দেবী?
এই সকাল, সকাল দেবী দর্শন! ভেতরটা গেয়ে উঠল, ইয়ে কাহাঁ আ গয়ে হম, ইঁউহি সাথ চলতে চলতে.. বললাম, দেবীজি, আপতো হর জগহ বিরাজমান, অন্দর হো ইয়া বাহার, আপকা দর্শন হো গয়া, আউর কেয়া চাহিয়ে?
দেবীজি হাসছেন। বললেন, শায়র হো কেয়া?
কথা হয়, কথা গড়ায়। জলে ভাসে। জলীক হয়। চিক-চিক জলাণু’র ওপরে ওড়ে দ্যুতিময় কুচোহিরের ফড়িং, একঝাঁক। কথায় বাষ্প জমে। প্যাডেল-বোটের ফেনায় আকাশ নামে নীলচে পাখির স্বভাব হয়ে।
-স্বভাব যায় না ম’লে!
পিঠে টোকা। মুখ ফিরিয়ে দেখলাম তিনি, পুজো শেষ। কপালে সিঁদুরে ফোঁটা। বলল, জীবনে শুধরোবে না তুমি, কে ওই মহিলা পার্থ?
বলতে যাচ্ছিলাম, নৈনী দেবী। চেপে গেলাম। বল্লে কেস খেয়ে যেতাম। অথচ সেই দেবীই বা কোথায় অন্তর্হিত হলেন?
বললাম, কে বল তো?
-আমি কীভাবে বলবো, হাঁ করে তো তাকিয়েছিলে তুমি!
যাক, বাঁচা গেল। বললাম, তাকিয়েই তো তোমায় পেলাম!
হাসল। মেঘ কেটে গেছে।
লেকের পাশেই তিব্বত মার্কেট। জমজমাট। আমরা ঘুরছি। ক্যাসেট প্লেয়ারে গান বাজছে, দিদি তেরা দেওর দিওয়ানা / হায় রাম, কুড়িয়োঁ কো মারে দানা...
৪.
গান পড়ে আছে, দেখেছিলাম। ‘চিলমন’ বা চিক সরিয়ে এক বিমূর্ত শরীর। ‘ম্যায় নাদান থা/জো ওয়াফা কো তলাশ করতা রহা গালিব / ইহ না সোচা একদিন আপনি শ্বাঁস ভি বেওয়াফা হো জয়েগী’...
চরে বেড়াতাম। জামশেদপুরের তুলকালাম বিষ্টুপুর-বাজার বা সাঁকচির দিকে যেতে যেতে জুবিলি পার্কের দিকে চলে যাওয়াই ছিল যেন আমার নিয়তি।
মনে আছে, একটা গান ভাসছিল, ‘ইয়ে মুলাকাত এক বাহানা হ্যায় / প্যার কা সিলসিলা পুরানা হ্যায়..’ জুবিলি পার্কের বিহঙ্গাদৃতা সন্ধ্যার ঠিক আগে, আমি যখন একটু হেলান, পিঠ ঠেকানো রেলিং-এ, সে এল। আমায় দেখল কিছুক্ষণ। আরও একটু এগিয়ে এসে বলল, প্যান্ট কা ‘জিপ’ খুলা হুয়া হ্যায়, উসে ভি দেখা করো! চরম অপ্রস্তুত আমি একবার নিচে দেখি, একবার চাপাহাসির লচকদার চোখের মালকিনকে! ‘উও আয়ে ঘর পে হমারে / খুদা কি কুদরত হ্যায় / কভি হম উনকো, কভি আপনে ঘরকো দেখতে হ্যাঁয়’ (মির্জা গালিব), আর আমার অবস্থা হল, কভি হম আপনে পাৎলুনকে ‘জিপ’ কো / কভি উনকো দেখতে হ্যাঁয়...
পরে লক্ষ্ণৌ-এর রুক্সানার সঙ্গে আমার বেশ একটা ইয়েমত হয়ে গেল। বন্ধুত্ব? হতে পারে। প্রেম? হবে, হবে এরকম একটা সময়ে একদিন রুক্সানা বলল, ও আগামীকাল লক্ষ্ণৌ যাচ্ছে, বড়ি ফুফি কি লড়কা কা শাদি কানপুরে, সেখানেও যাবে। রিগ্যাল ময়দানে বসেছিলাম। হাতে ফকিরা’র চানাচুর। রুক্সানা ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্রী। লক্ষ্ণৌ থেকে জামাশেদপুরের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজিতে পড়তে এসেছে। আমি মামুলি একজন সাধারণ ছাত্র, কমার্সের। রুক্সানার মতো মেধাবী নয়। লক্ষ্ণৌ হলো ‘তেহজিব-পসন্দ’ শহর। রুচি আর সৌজন্যের শহর। রুক্সানার মধ্যেও রয়েছে সেসব। জামশেদপুর বা টাটা’র ছেলেদের ‘তেহজিব’ হল বেআদবি। আদব-কায়দা অত লব্জে নেই আমাদের। যখন রুক্সানা বলত, ‘এক নফরত হি নহি দুনিয়া মে দর্দ কা সবব ফরাজ / মোহব্বত ভি সকুঁ ওয়ালোঁকো বড়ি তকলিফ দেতি হ্যায়’, বলে মৃদু হাসত, আমি মাইরি না বুঝেই হাসতাম। এখন জানি দেশজুড়ে ঘৃণার আবহে দাঁড়িয়ে কতটা আদবিয়ানা থেকে বলা যায়, শুধু ঘৃণাই এই দুনিয়ায় কষ্টের কারণ নয়, ফরাজ / ভালোবাসাও শান্ত মানুষদের কষ্ট দিয়ে যায়... ফরাজ, এখন জানি, আহমেদ ফরাজ। বিখ্যাত শায়র। সেদিন সেই অপার্থিব সন্ধ্যেয় আমি রুক্সানাকে মুসলিম লাইব্রেরির লাগোয়া রাস্তায় বলি, তুম কাল যাওগি, সচমুচ?
-জী, হাঁ। ফির আয়ুঙ্গি না, শাদি কা মামলা, মুঝে ডিগ্রি ভি তো লেনা হ্যায়। আমি ছায়ান্ধকারের রাস্তায় দেখি এক অনতিক্রম্য দূরত্বের ভেতরে হারিয়ে যাচ্ছে রুক্সানার মুখ। আমি মরীয়া তখন। কাছে টানি হঠাৎ, চুমু খাই। ও ঠোঁট না সরিয়ে বলে, ইয়ে কেয়া কর রহে হো? গান ভেসে আসে, উনসে মিলি নজর তো মেরে হোঁশ উড় গই...
রুক্সানা চলে যায়। আমি অপেক্ষা করি। ল্যান্ডলাইন ফোনের যুগ। মোবাইল তখনো আসে নি। ফেরার দিন পার হয়। ফেরে না ও। আমি রুক্সানার হোস্টেলে যাই, যেতে যেতে ভাবি সামান্য সময়েই আমরা দলমা ফুট, ডিমনা লেক, জুবিলি পার্ক, টেলকোর খাড়াংগাঝাড় বাজার চষে বেরিয়েছি। আলু টিকিয়া খেয়েছি ‘বম্বে সুইট মার্ট’-এ। ‘সোডা-ফাউন্টেন’-এ আইসক্রিম। জুবিলি পার্কের ঘাসে শুয়ে তাকিয়ে থেকেছি আকাশের দিকে। তারা গুনতে গুনতে গেয়ে উঠেছি, ও মেরে হম রাহি, মেরি বাহ থামে চলনা, বদলে দুনিয়া সারি, তুম না বদল না...
-রুক্সানা? আপ কৌন লাগতে হো রুক্সানা কি?
-ফ্যামিলি ফ্রেন্ড। কিসি কা শাদি মে গয়ি থি, ওয়াপস নহি আয়া অবতক?
মেয়েটি অবাক হয়। বলে, আপনি বাঙালি?
-হ্যাঁ
-আপনি জানেন না কিছু? রুক্সানা ইজ নো মোর, শি লেফট আস... দু’মাস হলো।
আমি হেসে ফেলি। বলি, মৃত্যু নিয়েও মজা?
-কীসের মজা? শি ওয়াজ মাই বেস্ট ফ্রেন্ড। রুক্সানা লক্ষ্ণৌ যায় প্রথমে, তারপর কানপুর। বিয়েতে। ওখানেই কমিউনাল ভায়োলেন্সে ও...
ফিরে এসেছিলাম। কে ছিল ওই মেয়েটি, রুক্সানা? ভেবেছি। আত্মা? দুত্তোর। একমাস ধরে একটা জলজ্যান্ত মেয়ে আমার সঙ্গে ঘুরে বেড়াল, আমরা তো এখানে, ওখানে, সবখানেই। এমনকি চুমুও... ভেতরে কিছু একটা হলো আমার। রুক্সানা তাহলে কে? সরকারি গোয়েন্দা? পালিয়ে বেড়ানো উগ্রপন্থী? তার-ছেঁড়া পাব্লিক? কে রুক্সানা?
আজ এত বছর ধরে আমি আর রুক্সানা, রুক্সানা আর আমি একটা বাঁচায় আছি। আছি হে! রুক্সানা জলখাবার বানায় তো আমি লাঞ্চ। ও কলেজে যায়, আমি ব্যাংকে। আমি ফুল আনি। ও নেয়। ও পারফিউম আনে। আমি হাসি। আমরা গানও গাই। আকাশে চাঁদ, তারা। রাতের পরতে পরতে আমরা ঘি ঢেলে আগুন লাগাই। নেবুলায় জন্ম নেয় তারার বাচ্চারা। রুক্সানা আর আমি তারপর ঘুমিয়ে পড়ি।
আজ ঠিক করেছি আর আমরা ঘুম থেকে উঠব না। মরে যাবো। আমি হিন্দু, ও মুসলমান। আমরা মরে যাবো। আজই।
‘তুম না জানে কিস জাহাঁ মে খো গয়ে / হম ভরি দুনিয়া মে তনহা হো গয়ে..’ এই গানটাও কিন্তু এখন আমরা শুনছি না।
এমনিই জানালাম তোমাদের।
আর কাল একটাই মৃতদেহ পাবে তোমরা। জানালাম, এমনিই...
স্বপন রায়
জন্ম: জামশেদপুর (ঝাড়খণ্ড)।
বেড়ে ওঠা: রাউরকেলা (ওড়িশা)।
বাসাবাড়ি: খড়গপুর, পশ্চিমবাংলা।
সখ: লেখালিখি, ঘোরাঘুরি।
বই: কিছু কবিতার এবং কয়েকটি গদ্যের বই প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১২১৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২২
এমজেএফ