কুষ্টিয়ার ছেউরিয়ায় লালন তীর্থে ভক্তকুলের ভিড়। আছেন বাইরের পর্যটকও।
লালন আখড়ায় যাওয়ার ইচ্ছাটা দীর্ঘদিনের। কিন্তু সময়-সুযোগের মিলন ঘটছিলো না।
অনেক দিন পর গত ঈদুল আযহায় লম্বা ছুটি ভোগ করলাম। তিনদিনের ছুটির সঙ্গে বাড়তি আরও পাঁচদিন। তাই গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জে ঈদ করে ১৯ অক্টোবর পৌঁছলাম ঢাকায়।
ওইদিন বিকেলেই কল্যাণপুর থেকে কুষ্টিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম এসবি পরিবহনে। উদ্দেশ্য বেড়ানো। কারণ ছেউড়িয়ায় লালন মেলা চলছে। এ সুযোগটাতো হাতছাড়া করা যাবে না।
দীর্ঘ সাড়ে ৬ ঘণ্টার জার্নি শেষে পৌঁছলাম গন্তব্যে। কুষ্টিয়া শহরতলীতে আত্মীয় বাড়িতে উঠলাম। পরদিন কেটে গেলো নানা কাজে। এদিকে মেলাও শেষের দিকে। শেষদিন ২১ আগস্ট। যেতেই হবে লালন মেলায়। দুপুরের খাবার শেষে কানাবিলের মোড় থেকে ইজিবাইকে চড়ে আসলাম কোর্টপাড়া। চিন্তা হচ্ছিল যাবো কি করে? নামতেই দেখলাম সারি সারি ইজিবাইক। ডাকছে-লালন মেলা, লালন মেলা।
একটি ইজি বাইকে চড়ে বসলাম। শুরু হলো যাত্রা।
প্রায় ১০ মিনিটের পথ। ইজিবাইক গিয়ে থামলো ছেউরিয়ায় লালন আখড়া থেকে বেশ কিছু দূরে। চালক জানালো আর যাওয়া যাচ্ছে না। নামতে হবে। ভাড়া চুকিয়ে নেমে গেলাম।
হেঁটেই ঢুকলাম মেলা প্রান্তরে। মূল গেইট থেকে মাঠ পর্যন্ত পাকা রাস্তা। রাস্তার দুই পাশে দোকানীরা বসেছে পণ্যের পসরা সাজিয়ে। বেশির ভাগই খাবারের দোকান। গজা, মিষ্টি, চটপটি। রয়েছে ফার্নিচারের দোকানও। ক্যাসেট-সিডির দোকানে বিক্রি হচ্ছে লালনের গানের সিডি। আছে বইয়ের স্টলও।
মাঠের বাম দিকে লালনের মাজার। মাজারের পথটা অনেক সুন্দর। পথের দুই পাশে বাদ্যযন্ত্রের স্থায়ী দোকান। দোকানগুলোতে সাজানো আছে নানা ধরনের বাদ্য যন্ত্র। বেশির ভাগ দোকানেই একতারা, দোতারা, বাঁশি, লালনের স্ট্যাচু, শো-পিস আর আর সব নাম না জানা বাদ্যযন্ত্র। সবই দেশিও ঐতিহ্যাবাহী যন্ত্র।
আছে কিছু খাবারের দোকানও। এরপর আছে আরেকটি গেট। এটি মাজারের মূল গেট। মূল গেটের ভেতরে ঢুকে অল্প একটু এগুলেই মূল মাজার ভবন। এর ভেতর লালন সমাধী।
লালন সমাধীর পাশে তার পালক মাতার কবর। বাইরে রয়েছে লালন সাইর পালক পিতা মওলানা মলম শাহ ও অন্য শিষ্যদের সমাধী।
মাজারের পর লালন কমপ্লেক্স’র ভবন। এখানে রয়েছে পাঠাগার, রিসোর্স সেন্টার আর অডিটোরিয়াম। বামদিকে নীচতলায় লালন যাদুঘর। দুই টাকার টিকিট নিয়ে যাদুঘরে ঢোকা যায়। লালনের ব্যবহৃত অনেক কিছু রয়েছে সেখানে। রয়েছে তার একতারাও।
অডিটোরিয়ামের নিচে হারমোনিয়াম, তবলা, দোতারা নিয়ে দলে দলে সাধুরা গান গাইছেন।
যাদুঘরের একটু দূরে দেখলাম দুই সাধু বসে আছেন। সাদা পোশাক, সাদা দাড়ি। তাদের দেখতেই মনে হলো পূত-পবিত্র। এগিয়ে গিয়ে পাশে বসলাম। বেশ কিছুক্ষণ কথা বললাম তাদের সঙ্গে। কথা প্রসঙ্গে তাদের একজন জানালেন-লালন ভক্তরা অডিটোরিয়ামে ওঠেন না।
কেন ওঠেন না? এ প্রশ্নের উত্তরে বললেন, আমার গুরু নিচে চিরশায়িত আর আমি তার উপরে উঠব, এটা কী হয়? বিমোহিত হলাম তার গুরু ভক্তি দেখে।
এরপর সাধু গান ধরলেন, ‘এমন মানব জনম আর কি হবে, মন যা করে ত্বরাই করো এই ভবে...’ কিছুক্ষণ তার গান শুনে এগিয়ে যাই মাঠের দিকে। দেখলাম দেশ-বিদেশ থেকে আগত হাজারো ভক্তের আগমনে মুখরিত লালন আখড়া।
মাজার এলাকা থেকে বেরিয়ে গেলাম মাঠের দিকে। মাঠে মূল অনুষ্ঠানের জন্য করা হয়েছে প্যান্ডেল। ডিজিটাল সাউন্ড সিস্টেম আধুনিক স্টেজ।
অনুষ্ঠানের স্পন্সর করেছে বাংলালিংক। সেখানে গিয়ে দেখলাম লালন সাইয়ের উপর আলোচনা চলছে। স্টেজের পেছনে কালী নদীর পাড় ঘেষে কলকি ও গাঁজার পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানীরা।
আলোচনা পর্বের শেষে শুরু হলো সাইজীর গান। ‘বাড়ির পাশে আরশী নগর, সেথা এক পড়শি বসত করে...’। ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে, লালন বলে জাতের কি রূপ দেখলাম না এই নজরে...’।
আধ্যাত্মিক সাধক লালন শাহর কুষ্টিয়া শহর থেকে সামান্য দুরে কুমারখালীর ছেঁউড়িয়াতে আশ্রয় লাভ করেন। ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর শুক্রবার ভোর পাঁচটার সময় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বাংলা ১২৯৭ সাল। মৃত্যুর পর তাঁর সমাধি স্থলেই আখড়া গড়ে ওঠে। ১৯৬৩ সালে সেখানে তার বর্তমান মাজারটি নির্মাণ করা হয় এবং তা উদ্বোধন করেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান। ২০০৪ সালে সেখানেই আধুনিক মানের অডিটোরিয়ামসহ একাডেমি ভবন নির্মাণ করা হয়। ফকির লালন শাহের শিষ্য এবং দেশ বিদেশের অগনিত বাউলকুল এই আখড়াতেই বিশেষ তিথিতে সমবেত হয়ে উৎসবে মেতে উঠেন। এই মরমী লোককবি নিরক্ষর হয়েও অসংখ্য লোক সংগীত রচনা করেছেন। বাউল দর্শন এখন কেবল দেশে নয়, বিদেশের ভাবুকদেরও কৌতুহলের উদ্রেক করেছে। লালন নেই, আছে তার স্মৃতিচিহ্ন। কিন্তু লালন কি আসলেই নেই? ইহজগতে না থাকুক, লালন আছে সবার হƒদয়ে, সব বাঙালির মানসপটে। যিনি স্বীয় গুণেই আজ সবার স্মরণীয়। জাতপাতে তোয়াক্কা না করে সব জাতের মানুষের হƒদয়ে বিরাজ করছেন ফকির লালন শাহ।
কিভাবে যাবেন, কোথায় থাকবেন:
ঢাকা থেকে শ্যামলী, এসবি ও হানিফ পরিবহনে কুষ্টিয়া যাওয়া যায়। কুষ্টিয়া শহরে বেশ কয়েকটি আবাসিক হোটেল আছে। এরমধ্যে অন্যতম হলো-হোটেল গোল্ডস্টার (আবাসিক), হোটেল শাপলা আবাসিক, হোটেল আজমিরী আবাসিক, হোটেল পদ্মা আবাসিক, হোটেল যমুনা আবাসিক, হোটেল শাহীন আবাসিক, হোটেল সানমুন আবাসিক, হোটেল সানমুন আবাসিক, হোটেল ডায়মন্ড আবাসিক, হোটেল প্রীতম আবাসিক। এছাড়াও রয়েছে সরকারি বিভিন্ন রেস্টহাউস। সবচেয়ে বড় কথা কুষ্টিয়া অতিথি পরায়ন শহর। গেলেই বাকি সব ব্যবস্থা এমনিতেই হয়ে যাবে।
ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে। আর মাস শেষে ‘ট্রাভেলার্স নোটবুক’র সেরা লেখকের জন্য তো থাকছেই বিশেষ আকর্ষণ..
আর একটা কথা লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে ভুলবেন না।
আপনার ভ্রমণ আনন্দ বিশ্বজুড়ে বাঙালির কাছে ছড়িয়ে দিতে আমাদের ই-মেইল করুন- bntravellers.notebook@gmail.com এই ঠিকানায়।
লেখক: ইকবাল হাসান ফরিদ, সাংবাদিক
Email : ihfarid.bd@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০১৪
সম্পাদনা: মীর সানজিদা আলম, নিউজরুম এডিটর