বিলেতের ফটোগ্রাফার এলান এসেছিলেন ছবি তুলতে, তার ভাষায় ‘গ্রিন বাংলাদেশের’ ছবি। তুলেছেনও লাখ খানেক।
যাওয়ার ঠিক দু’দিন আগে জানালেন- এতো জায়গায় গেলাম, সুন্দরবনতো গেলাম না। আমিও সুযোগে ফোড়ন কাটলাম। বাংলাদেশের সব ‘গ্রিন’ই তো ওখানে আর তুমি গেলে না! এলান ক্ষেপে উঠলো- মেমুড... চলো না ভাই, দেশে ফিরে যাওয়ার আগে একবার ঢু মেরে আসি।
এমন রিকোয়েস্ট ফেলা যায় না, তাই দৌড়ালাম সোহাগ বাস কাউন্টারে। সেদিন রাত সাড়ে ১০টার বাসের টিকিট কাটলাম।
খুব ভোরে খুলনা পৌঁছলাম। নাস্তা করে মংলার লোকাল বাস ধরে ঘণ্টাখানেক পরই মংলা। মংলা পর্যটন মোটেল পশুর’র ম্যানেজার সদা হাস্যময়ী ফেরদৌস ভাইয়ের সহায়তায় একটা বোট ঠিক করে নিলাম। যতটা ভেতরে যাওয়া যায় ততটাই যাবার প্ল্যান করি।
বেলা সাড়ে ১১টার দিকে যাত্রা শুরু হলো। টুইটুম্বুর নদী পশুরের বুক চিরে মিজানের বোট চলতে লাগলো পূর্ব-দক্ষিণ কোণে। ভাব জমালাম মিজানের সাথে।
বাঘ দেখেছেন কখনো?
কতো... মিজানের নিরুত্তাপ উত্তর।
সুন্দরবনে অনেকে নাকি বাঘ দেখতে চায় না। কারণ বাঘ যে দেখেছে সেটা নাকি গল্প করার সুযোগ পায় না। সেটা জানাই মিজানকে। মিজানও বলে আমরা তো ভ্রমণকারী। অনেক সাবধানে দূর থেকে বাঘ দেখি। বাঘের হাতে যারা মারা যায় তাদের বেশিরভাগই জেলে বা বাওয়ালী।
মংলা বন্দর পার হওয়ার পরই পাল্টে গেলো দৃশ্যপট। নদীর দু’পাশে ঘন গাছপালা, নদীতে একটু পরপরই গোলপাতা বোঝাই নৌকা। এসব দৃশ্যই বলে দেয় সুন্দরবন আসন্ন। ভাটার সময় বলে নদীর পানি অনেকটা কমে বের হয়ে এসেছে নদী লাগোয়া কিছু গাছের শেকড়।
ঘণ্টা খানেক লাগলো করমজল পয়েন্টে পৌঁছতে। মিজান গেলো ফরেস্ট অফিসে পারমিশন নিতে। যদিও তার খুব একটা প্রয়োজন ছিলো না, কারণ আমরা সুন্দরবনের ভেতরে যাবার মতো সময় পাবো না। তবু যতোটা এসেছি এর জন্যই হয়তো ফি দিতে হবে। সেখানে নির্ধারিত ফি দিয়ে স্লিপ নিয়ে আর একজন বনরী সাথে নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করলাম।
এই করমজলই মূলত সুন্দরবনের এন্ট্রি পয়েন্ট। আমরা বোট থেকে নেমে সামনে হাঁটতে লাগলাম। এখানে গড়ে তোলা হয়েছে একটি প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র। ট্যুরিস্টদের হাঁটার সুবিধার জন্য নদীর তীর থেকে ভেতরের দিকে কাঠের ব্রিজের মতো করে রাস্তা। দু’পাশে ঘন বন।
এখানকার গাছগুলো বেশ বড় বড়। গোল, সুন্দরী ছাড়াও আছে চাম্বল, মেহগিনি জাতীয় গাছ। এসব গাছে নানারকম পাখি। পাখি খুব একটি চিনি না এক কাঠঠোকরা ছাড়া। একটু পরই একপাল হরিণকে ঘুরে বেড়াতে দেখলাম। মানুষ দেখে এরা হয়তো অভ্যস্ত তাই ছুটে পালালো না। এখানে একটি ছোট চিড়িয়াখানাও করা হয়েছে।
এখানকার হাঁটাপর্ব শেষ করে আবার বোট এ। এবার মিজান বললো চলেন একটু অন্যরকম সুন্দরবন দেখাই। এই বলে সে আবার একটু পেছন ফিরে চললো মানে মংলার দিকে।
কিছুদূর যাবার পরই ছোট একটা খালের মতো নদীতে ঢোকালো নৌকা। আমি আগেও দুয়েকবার এসেছি সুন্দরবন কিন্তু এ খালটায় ঢোকা হয়নি। ছোট খাল, দুধারে ঘন বন। অনেক গাছের পাতা খালের পানিতে এসে মিতালী করেছে।
এনাকোন্ডা মুভিতে দেখা আমাজন ফরেস্টের সেই খালটার সাথে কোথায় যেন মিল আছে। অনভ্যস্ত আমি কিছুটা নির্জনতা আর কিছুটা বাঘের ভয়ে তটস্থ।
বিশাল গোফওয়ালা বনরী তার সাথের গাদা বন্দুকটা দেখিয়ে চোখের ইশারায় অভয় দেয় যদিও জানি কাজের সময় দেখা যাবে বন্দুক থেকে গুলি বের হয় না। তবু তার অভয়কানীতে আশ্বস্ত হই। মন দেই প্রকৃতি দর্শনে।
বন ক্রমে ঘন হতে থাকে। একটু পরই লোকালয়ের মতো। খালের একপাশে সুন্দর এক কাঠের বাংলোর পাশে বোট থামালো মিজান। বাংলোর সামনের সাইন বোর্ড এ লেখা ‘লাউডোব টহল ফাঁড়ি, চাদপাই রেঞ্জ’।
আমরা সে ফাঁড়ির বারান্দায় রাখা চেয়ারে বসি কারো কোনো অনুমতি ছাড়াই। ফাঁড়ির সদস্যদের একজন বের হয়ে এলো আমাদের দেখে। তার অনুমতি না নিয়ে বসাতে রাগতো হলোই না বরং কিছুটা খুশি হলো নির্জন এ অরণ্যে মানুষের পদচারনা দেখে।
বিকেল গড়িয়ে তখন প্রায় সন্ধ্যা। প্রকৃতি আরও নির্জন হয়ে এসেছে। শুধু জোয়ারের পানির কলকল শব্দ আর দুয়েকটা পাখির ডাক ছাড়া কিছু শোনা যায় না। এখানে কোনো কথা বলাও যেন অপরাধ। ফাক্সে করে আনা চা নিয়ে আমি আর এলান তাই নির্জন সেই বারান্দায় চুপ করে বসে রইলাম। আহা! এ বারান্দায় এভাবেই যদি বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারতাম! তা বুঝি হবার নয় কারণ বনরী তাড়া দেয়-চলেন সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
আমরা আবার ছোট সেই খালে নামি। ততোক্ষণে সন্ধ্যা নেমে এসেছে লাউডোবায়...
ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে। আর মাস শেষে ‘ট্রাভেলার্স নোটবুক’র সেরা লেখকের জন্য তো থাকছেই বিশেষ আকর্ষণ..
আর একটা কথা লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে ভুলবেন না।
আপনার ভ্রমণ আনন্দ বিশ্বজুড়ে বাঙালির কাছে ছড়িয়ে দিতে আমাদের ই-মেইল করুন- bntravellers.notebook@gmail.com এই ঠিকানায়।
বাংলাদেশ সময়: ১০৪৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০১৩
সম্পাদনা: মীর সানজিদা আলম, নিউজরুম এডিটর