জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের ৩৯ ও ৩৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা মিলে সুন্দরবন ঘুরে এল। ৩৯ ও ৩৭তম ব্যাচের স্নাতক চূড়ান্ত এবং স্নাতকোত্তর পর্বের খুলনা অঞ্চলের মাঠকর্ম বিষয়ক প্রতিবেদনের নিমিত্তে আয়োজন করা হয়েছিলো এ ভ্রমণের।
তিনরাত দুই দিনের এ সফরে শিক্ষকসহ একশ’ ২৫ জন তরুণ-তরুণীর এক মিলন মেলা নিয়ে চলেছে লঞ্চ এমভি খেয়াপার। এই মাঠ কর্মর নিমিত্তে পুরো আয়োজন জুড়ে ছিল নানা কার্যক্রম। সেই কার্যক্রম আর ভ্রমণ নিয়ে আজকের গল্প।
বন পরিভ্রমণ
২ ফেব্রুয়ারি সকাল ৭টা। রোববার। ক্যাম্পাস থেকে খুলনা যাওয়ার নির্ধারিত ব্যাচের বাসে উঠে বসেছে যে যার মতো। ৮ ঘণ্টার বিরতিহীন ভ্রমণ শেষে বিকেল নাগাদ পৌঁছলাম খুলনার রুপসা ঘাটে। এবার এই রুপসা ঘাট থেকে যাত্রা শুরু করেছে সুন্দবনের উদ্দেশ্যে লঞ্চ এমভি খেয়াপার।
লঞ্চে উঠেই ছেলে-মেয়েরা ইচ্ছে মতো লাফাচ্ছে, ঝাফাচ্ছে, আনন্দ করছে। তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে ভেসে যাচ্ছে লঞ্চ। লঞ্চের মধ্যে চলছে কোলাহল। কেউবা আবার লঞ্চের ছাদে উঠে বিস্তৃত জলরাশি দেখে অভিভূত। সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত নামলো। ভ্রমণের জন্য কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ করে রাত ৮টার কিছু সময় পর আমাদের লঞ্চটি সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের কটকা এলাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।
আমাদের লঞ্চটি যখন রুপসা ঘাট অতিক্রম করে মংলা বন্দরে আসলো ততক্ষণে রাত পৌনে ১০টা। রাতের খাবার খাওয়ার জন্য সবাই লঞ্চের ডেকে চলে গেলাম। অতঃপর খেয়ে আবার চলে আসলাম লঞ্চের ছাদে। এখান থেকে খুলনা জেলা সংলগ্ন বিডিআর বন্দর ছাড়াও অনেক কিছুই দেখা যায়।
কুয়াশা না থাকায় আকাশে মিটমিট করে জ্বলা তারাগুলো অসাধারণ লাগছিলো। আরও কিছু সময় চললো আমাদের লঞ্চ। হঠাৎ লঞ্চের মাস্টার লিয়াকত (ওস্তাদ) কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলছিলো সহকারী সারেংয়ের সঙ্গে। আমি তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে। তিনি জানালেন, আমরা সুন্দরবনের প্রবেশ করতে যাচ্ছি। এখন আমরা করমজলে। এখান থেকে আমাদের নিরাপত্তার জন্য দু’জন গানম্যান নেওয়া হবে।
গানম্যান নিয়ে আবারও রওনা হলাম গন্তব্যস্থল কটকার উদ্দেশ্যে। কটকা সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের আওতাধীন বন্যপ্রাণীর অভয়াশ্রম। পর্যটকদের জন্য এটি অন্যতম ভ্রমণ স্থান হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
খুব ভোর নাগাদ আমারা কটকায় এসে পৌঁছলাম। লঞ্চের সঙ্গে থাকা ছোট ট্রলারে করে আমরা কটকা অভয়াশ্রমে গেলাম, সেখানে সুন্দরবনের হরিণ ও বন্য শুকরের দেখা পেলাম। তবে যে মূল আকর্ষণের বিষয় ছিলো সে বাঘের দেখা পাওয়া হলো না। সামনে-পেছনে বন্দুকধারী দু’জন বনরক্ষীর পাহারায় বায়নোকুলার, ক্যামেরা, টর্চ নিয়ে বাঘ দেখার দুর্নিবার আকাঙ্খাই আমরা পিনপতন নীরবতায় গভীর রাতেও জঙ্গলে নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি।
টর্চের আলোয় হরিণের জলজলে চোখ। শুকরের অবাধ বিচরণ। পানিতে মাছের লাফিয়ে লাফিয়ে চলা দেখার অনুভূতিই ছিল অন্য রকম। আমাদের সবার মধ্যেই বাঘ কিংবা তার পায়ের চিহ্ন দেখার জন্য ছিলো একরকম ব্যস্ততা। আমাদের সঙ্গে থাকা ভ্রমণ প্রধান অধ্যাপক ড. শাহেদুর রশিদ স্যার আমাদের কটকা অভয়াশ্রম এলাকার বিভিন্ন দিক ঘুরিয়ে নিয়ে আসলেন।
আবারও খানিক সময় ঘুরে ট্রলারে নদী পাড়ি দিয়ে এবার আসলাম কটকার আরেকটি ট্র্যুরিস্ট স্পট জামতলা কটকা বিচে। জেটিতে নোঙর করার পর প্রায় ত্রিশ মিনিট হাঁটার পর ফের দেখা পেলাম সেই কাঙ্খিত জামতলা বা কটকা বিচের। তবে এখানে এসে যা দেখলাম জলবায়ু পরিবর্তন জনিত প্রভাবে সিডর ও আইলায় এখনার বেশির ভাগ বন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগে যেখানে এ বন ছিলো গ্রোয়িং এখন এটি হয়ে পড়েছে ডিগ্রেডেড বন।
বিচের চারদিকে গাছের ভাঙা অংশগুলো পড়ে আছে। আমরা এখানে এসে আমাদের চতুর্থ বষের ট্যুরের প্রতিবেদনের কিছু প্রয়োজনীয় কাজ বা মাঠ কর্ম সম্পাদন করলাম। যার মধ্যে ছিলো এখানকার সেডিমেন্টের স্যাম্পল সংগ্রহ। পানির সেলাইনিটি পরিমাপ। কিছু নমুনা সংগ্রহ। ছবি তোলা ইত্যাদি।
এসব করার পর আমরা আবার ফের লঞ্চে ফিরে আসলাম। ওখান থেকে প্রায় চার ঘণ্টার পথ পেরিয়ে আমরা এবার আসলাম দুবলার চর সংলগ্ন বা আলোর কোল দ্বীপে। এটি একটি জেলে পল্লী। প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এ জেলে পল্লী গড়ে উঠেছে।
এখানে প্রায় হাজার সংখ্যাক লোক তৎসংলগ্ন এলাকায় লোনা পানির মাছ ধরার কাজ করে। এজন্য তাদের এ জেলে পল্লীতে বছরের অর্ধেকের বেশি সময় নিজ পরিবার পরিজন ছেড়ে জীবিকার তাগিদে অস্থায়ী আবাস গড়তে হয়।
ফের যখন কটকায় পৌঁছলাম তখন খুব সকাল। সময় নষ্ট না করে লঞ্চে থেকে গ্রুপ ধরে মাঝ নদী থেকে ট্রলার করে বনের মাঝে ঢুকে পড়লো সকলে। দেখলাম ছোট্ট হরিণ সাবক। গোলপাতা। নানা প্রজাতির গাছ। কষ্ট লাগলো সিডরের আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়া বন দেখে।
নয়নাভিরাম হরিণ শাবকের অপলক দৃষ্টি, কেওড়া গাছের ডালে লুকিয়ে থাকা মুখপোড়া বানর, মাথার ওপর দিয়ে খাল পাড়ি দেওয়া বনমোরগ, গাছের সুউচ্চ চূড়ায় বসে থাকা শঙ্খচিল, সবুজ পাতার আড়ালে বসে থাকা বাদামি মাছরাঙা, সাদা বকের ঝাঁক, নাম না জানা পাখির অবিরত কুজন শোনা, দেখার আগ্রহ আর রোমাঞ্চে লঞ্চে ফিরে নির্ঘুম রাত কেটেছে সাগর নদী মোহনায়।
কটকা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এলাকা দেখার পর সবাই আবার অন্যপাশে জামতলা বীচ পরির্দশন। বনের মাঝে বিস্তৃত বেলাভূমি। ছনের বিশাল মাঠ পেরিয়ে আমরা পৌঁছে যাই কটকা সি বিচে। পৌঁছে দেখি বিশাল সমুদ্র। নাচছে, দৌঁড়াচ্ছে, গান গাইছে, ছবি তুলছে শিক্ষার্থীরা। অনেকে বালুতে লিখছে প্রিয় মানুষের নাম। বাঘ মামার ভয়ে কটকা সি-বিচ থেকে ওয়াচ টাওয়ার পর্যন্ত আসতে সবার হাতে দেখা গেছে বড়, ছোট আর মাঝারি সাইজের লাঠি।
সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক উৎসব
আমাদের লঞ্চটি যখন হিরণ পয়েন্ট থেকে যাত্রা শুরু যখন আমরা চাঁদপাই রেঞ্জের হারবাড়িয়ার বন্যপ্রাণি অভয়ারণ্য এলাকা পরির্দশন শেষে যখন লঞ্চে ফিরি সন্ধ্যার পর শুরু হলো সাংস্কৃতিক উৎসব। ৩৯ আর ৩৭তম ব্যাচ মিলেমিশে চলে ঘণ্টা আড়াইয়ের গান, গেম শো আর দেশীয় নৃত্য।
রুমে ফিরে ঘুমুতে যাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। চারদিক থেকে ভেসে আসছে আনন্দের ধ্বনি। শিক্ষক আর শিক্ষার্থী এত সহজে এক হয়ে যেতে পারে ভাবাই যায় না। জাহাঙ্গীরগনর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর শিক্ষার্থীদের না দেখলে তা বিশ্বাস করা যাবে না।
নানা কথা
সুন্দরবন ভ্রমণ কমিটির আহ্বায়ক ও বিভাগের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক ড. মো. শাহেদুর রশিদ বলেন, এ আয়োজন অনেক কষ্টের হলেও তাতে আছে অনেক আনন্দ। প্রতিবারই খাবারের সময় আমাদের সঙ্গে থাকা নুরুল ইসলাম স্যার জানতে চেয়েছেন, খাবারের কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা। আমি বারবার তাকে বলেছি, না স্যার, সব ঠিক আছে।
মেহেদী স্যার, তানজিনুল হক মোল্লা, ইমন স্যার এই পুরো ভ্রমণের আদ্যপান্ত ছবি তুলে চলেছেন। সঙ্গে আমিও। মেগাফোন বা হর্ন মাইক নিয়ে ছেলে-মেয়েদের সামলাতে সব সময় ব্যস্ত ছিলেন শাহেদ স্যার।
একটু বাহিরে আবার কেবিনে প্রবেশ। এভাবেই তিনরাত দুই দিন পার করেছেন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা। তিনি সুন্দরবন ভ্রমণে সারাদিনই সুইসুতা দিয়ে ওলের কিছু একটা বানাতে ব্যস্ত ছিলেন।
নিজের সময়টুকু সবার মাঝে সমান ভাগে ভাগ করে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়ে সবাইকে অবাক করেছেন ইমন স্যার ও আর মেহিদী স্যার। তাদের নানান ঢঙের আয়োজন মুগ্ধ করেছে সবাইকে। সফল হয়েছে একটি ভ্রমণ।
ফিরতি পথে
ক্লান্তি নেই, ঘুম নেই। বাড়ি না ফেরার ইচ্ছা নিয়ে লঞ্চ চলতে থাকে উল্টো দিকে। গন্তব্য সেই আবার রূপসা ঘাট। সারারাত লঞ্চে আড্ডা, গানের আসর বসল। কিভাবে যে রাত পার হয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না।
শেষ রাতে ঠাণ্ডা বাতাস বইছিল। আমাদের ভ্রমণের শেষ রাতকে ঠাণ্ডায় জমিয়ে দিতে এসে, ব্যর্থ হয়েছে বাতাস, বলছিল বন্ধু আসাদ ও মুস্তাফিজ। ঠাণ্ডা বাতাসের জন্য কেবিনের এ বারান্দায় একবার, ও বারান্দায় একবার করে বেড়িয়েছিল অনেকে। এভাবেই শেষ হয় পাঁচ দিনের সুন্দরবন ভ্রমণ।
সকালে সবার সাথে বিদায় বেলায় বলেছিলাম,
দেখা হবে বন্ধু, কারণে আর অকারণে...
আহমেদ রিয়াদ
৩৯ তম আবর্তন
ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
প্রিয় পাঠক, ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে। আর মাস শেষে ‘ট্রাভেলার্স নোটবুক’র সেরা লেখকের জন্য তো থাকছেই বিশেষ আকর্ষণ..
আর একটা কথা লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে ভুলবেনই না, সেই সঙ্গে বাতলে দিন সেখানে যাওয়ার পথঘাটের বিবরণও।
আপনার ভ্রমণ আনন্দ বিশ্বজুড়ে বাঙালির কাছে ছড়িয়ে দিতে আমাদের ই-মেইল করুন- bntravellers.notebook@gmail.com এই ঠিকানায়।
বাংলাদেশ সময়: ১২০০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৪