ঢাকা: বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে ব্রিটিশ ব্যবস্থাপনা পরিচালক কেভিন স্টিলের আকস্মিক পদত্যাগে তোলপাড় চলছে। বিমানের ভেতরকার সূত্রগুলো বলছে, কেভিনের পরিণতি এমনটাই হবে তা নাকি প্রত্যাশিত ছিলো।
বিমানের প্রধান কার্যালয়ে কাজ করেন এমন কর্মকর্তাদের ভাষ্য, এয়ার মার্শাল জামালউদ্দিন আহমেদের মতো ‘স্বেচ্ছাচারী’ চেয়ারম্যানের অধীনে কেভিন কিভাবে এক বছর দায়িত্বপালন করলেন সেটাই এখন টক অব দ্য বিমান।
কেভিনকে কেনো এত দ্রুত সরে যেতে হলো সে নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণও চলছে বিমানে। আর তাতেই বেরিয়ে আসছে জামাল বনাম কেভিনের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের নেপথ্যের নানা কাহিনী।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিমানের জনসংযোগ শাখার একজন কর্মকর্তা বাংলানিউজকে জানান, কেভিনকে মূলত অনেক আগে থেকেই পদত্যাগের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে ধারণা দেওয়া হয়েছিল। সম্প্রতি কেভিনের নেওয়া কিছু সিদ্ধান্তে চরম নাখোশ ছিলেন বিমান চেয়ারম্যান। এরই প্রেক্ষিতে এই নির্দেশনা।
সূত্রটি জানায়, দ্বন্দ্বের শুরু হজ মৌসুমে লিজে নিয়ে আসা বিতর্কিত ‘কাবো’ থেকেই। গত হজের সময় বিমান চেয়ারম্যান কাবোর বোয়িং ৭৪৭ লিজ নেওয়ার জন্য এক তরফা সিদ্ধান্ত নিলে কেভিন তা সঠিক হয়নি বলে পর্ষদ সভায় প্রকাশ্যে মন্তব্য করেছিলেন। এতে কয়েকজন সদস্য তাৎক্ষণিকভাবে চেয়ারম্যানের পক্ষ নিয়ে কেভিনের প্রতি তিরস্কারমূলক পাল্টা জবাব দেন। এবং কাবোর পক্ষে মতামত দেন। এ সময় কেভিন এটাও তুলে ধরেন-বার বার এত বির্তকের পর যদি আবার কাবোর জাহাজ নেয়া হয়- তাহলে মিডিয়ায় ফের ঝড় ওঠবে। তখন চেয়ারম্যান ক্ষিপ্ত হয়ে কেভিনের এ যুক্তি খন্ডন করে বলেন- মিডিয়া দেখার দায়িত্ব আমার। এটা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবেনা।
সূত্রগুলোর মতে, লিজ নিয়ে চেয়ারম্যান-এমডি দ্বন্দ্ব শুরুর পরই নিজের অনুগত মুজিব মাসুদ নামে এক ব্যক্তিকে বাসায় ডেকে নেন জামাল উদ্দিন। এবং কাবো ইস্যুতে মিডিয়া ম্যানেজের দায়িত্বটিও তার ওপর ছেড়ে দেন। চেয়ারম্যান মুজিব মাসুদকে কাবোর লোকাল এজেন্ট ইফতেখারুল আলম মলয়ের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করিয়ে ‘সব ব্যবস্থা’ নিতে পরামর্শ দেন। এরপর থেকে মুজিব মাসুদের একটি নিয়মিত কাজ হয়ে যায় রাজধানীর নিকুঞ্জে কাবোর অফিসে নিয়মিত যোগাযোগ করা। আর বেসামারিক বিমান চলাচল বিটের কতিপয় সাংবাদিকের মাধ্যমে তদবির করা।
এক পর্যায়ে হজ শেষ হবার পরও চেয়ারম্যান প্রকাশ্যে না এসে পর্দার আড়ালে থেকে মুজিবের মাধ্যমে আবারও কাবোর সঙ্গে আরও দুমাসের চুক্তি বৃদ্ধি করার চেষ্টা চালান।
তখন শুরু হয় আসল খেলা, বলেন সূত্রটি। তিনি জানান, এসময় রহস্যজনকভাবে বিমানের একটি এয়ারবাসকে অচল বলে ঘোষণা করা হয়। এরপর ফ্লাইটের অভাবে সিডিউল বিপর্যয় ঠেকাতে কাবোর জাহাজ নেয়ার যৌক্তিকতা তুলে ধরে এমডির ওপর পরোক্ষভাবে চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন চেয়ারম্যান।
আর চেয়ারম্যানের পক্ষে অবস্থান নিয়ে মুজিব মাসুদ কয়েকটি পত্রিকায় কাবোর উড়োজাহাজ লিজ নেওয়ার যৌক্তিকতা তুলে ধরে ধারাবাহিকভাবে রিপোর্ট করতে থাকেন। এদিকে, কেভিন স্টিল ছিলেন তার অবস্থানে কঠোর। কিছুতেই কাবোর জাহাজ নিতে রাজী হচ্ছিলেন না।
সূত্রমতে, মূলত তারপর থেকেই কেভিনের প্রতি চরম নাখোশ হন চেয়ারম্যান। তারই ধারাবাহিকতায় চেয়ারম্যান ও কেভিনের সম্পর্ক দা-কুমড়োয় পরিণত হয়।
সূত্র জানায়, সম্পর্ক খারাপ হলেও চেয়ারম্যান কেভিনকে সরাসরি পদত্যাগের নির্দেশ দেয়ার সাহস করেননি। কারণ তার ভয়-মিডিয়ায় তখন সমালোচনার উঠবে-চেয়ারম্যানের কারণেই কেভিন টিকতে পারলেন না।
আর যাতে কেভিনও চলে যান এবং তার কোনো বদনাম না হয় সে প্রচেষ্টায় এবার ভিন্ন কৌশল নিলেন বিমান চেয়ারম্যান। তিনি একের পর এক জিএসএ নিয়োগে কেভিনের স্বেচ্ছাচারিতা ও বিপুল অর্থ অপচয়ের অভিযোগ তুলে বেনামে উড়ো চিঠি পাঠান প্রধানমন্ত্রীর দফতর, বিভিন্ন সংস্থা ও গণমাধ্যম অফিসে। এ নিয়ে কয়েকটি মিডিয়ায় প্রতিবেদনও হয়। বেনামে চিঠি দেওয়ার পর সেটাও গোয়েন্দা সংস্থায় তদন্ত হয় এবং সে প্রতিবেদনও প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন চেয়ারম্যান।
এছাড়াও মাস তিনেক আগে মিশর থেকে দুটো বোয়িং লীজ নেয়া ও ডিসি-১০ এর বার্মিংহাম ফ্লাইটের (ট্রিপ) বিষয় নিয়ে চেয়ারম্যানের সঙ্গে প্রকাশ্যে বিরোধ দেখা দেয় কেভিন স্টিলের। এ নিয়ে চেয়ারম্যানের অফিসে কেভিনের বাক-বিতণ্ডা হয়। তখন চেয়ারম্যান তাকে সরাসরি পদ ছাড়ার নির্দেশ দেন। বিষয়টি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি কেভিন। সেদিনই রাগের বশে তিন মাসের নোটিশ দিয়ে চেয়ারম্যানের হাতে পদত্যাগপত্র জমা দেন কেভিন স্টিল। আর চেয়ারম্যানও তাক্ষণিকভাবে তা বিনা বাক্যব্যয়ে গ্রহণ করে আরও তিনমাস কাজ চালিয়ে যাবার নির্দেশ দেন। সে নির্দেশই মেনে চলছেন কেভিন।
গত তিনমাস ধরে চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন বিষয়টি দক্ষতার সঙ্গে গোপন করে রাখেন। তবে এতেও চেয়ারম্যানের ক্ষোভের নিরসন ঘটেনি। গত মাসে একজন জেনারেল ম্যানেজার ও একজন পরিচালক কেভিনের অফিসে বসে বিমানের একটি কঠিন সিদ্ধান্তের ব্যাপারে চেয়ারম্যানের রেফারেন্স দিলে কেভিন চরম বিরক্ত হয়ে মন্তব্য করেন- ‘ডোন্ট গিভ মি চেয়ারম্যান্স রেফারেন্স। ইফ ইউ গো টু চেয়ারম্যান-ডোন্ট কাম টু মি। কেভিনের এ মন্তব্য একজন কর্মকর্তা মোবাইল ফোনে রেকর্ড করে চেয়ারম্যানকে শোনান। এতে চেয়ারম্যান আরও ক্ষিপ্ত হন।
সূত্রটি আরো জানায়, এ ঘটনার কয়েকদিন পর গত সপ্তাহে বিমানের সর্বশেষ বোর্ড মিটিংয়ে কেভিনকে নাজেহাল করেন চেয়ারম্যান। সন্ধ্যে ছয়টায়-বোর্ড মিটিং শুরু হয়ে রাত এগারটা পর্যন্ত চলে। এ পাঁচ ঘণ্টায় শুধু কেভিনকে নানা কর্মের জবাবদিহিতার অযুহাতে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করা হয়। এক পর্যায়ে কেভিন তা সহ্য করে সেখানেই চেয়ারে বসে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ বিষয়ে একজন বোর্ড মেম্বার বলেন- জামাল উদ্দিনের জমানায় এর আগে বিমানের বোর্ড মিটিং কখনোই এত সময় ধরে চলেনি। সেদিন কেভিন অসুস্থ না হলে বোর্ড মিটিং আরও দীর্ঘায়িত হতো। কেভিন এক পর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে পড়লে তাড়াহুড়ো করে মিটিং মুলতবি ঘোষণা করা হয়।
এদিকে কেভিন পদত্যাগপত্রে স্বাস্থ্যগত কারণ উল্লেখ করলেও বিমানের জনসংযোগ থেকে প্রচার করা হয়-কেভিন যক্ষা রোগে আক্রান্ত। হৃদরোগ ধরা পড়েছে। তার পক্ষে আর কাজ করা সম্ভব নয়।
এ সব ব্যাপারে একজন সাংবাদিক কেভিনের কাছে জানতে তিনি হাসতে হাসতে বলেন- আমি যদি যক্ষারোগে আক্রান্ত হবো, তাহলে কিভাবে গত এক বছর চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে টানা ১৮ ঘণ্টা অফিসে বসে কাজ করেছি। অসুস্থতার অযুহাতে তো একদিনও অফিস কামাই করিনি।
কেভিন বলেন, আমি এখান থেকে চলে গেলেও তো বসে থাকবো না। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাজে ডুবে থাকবো কাজেই সময় হলে- সবই জানানো হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১০৫০ ঘণ্টা, মার্চ ২৭, ২০১৪