পুত্রজায়া থেকে সড়ক পথে প্রায় পাঁচ ঘণ্টার যাত্রা শেষে যখন জর্জটাউন পৌঁছি সূর্য তখন বিদায়ের অপেক্ষায়। গাইড আমীর হামজা গাড়ি রাখলেন একেবারে মালাক্কা প্রণালীর তীর ঘেষে।
নীলাভ জলরাশির অপার সৌন্দর্য মুহূর্তেই ঘুচিয়ে দিল দীর্ঘ ভ্রমণ ক্লান্তি। হঠাৎ আসা বাতাসের ঝাপটা পরিবেশকে আরো রোমাঞ্চকর করে দেয়। একই সাথে ক্লিক ক্লিক করে ওঠে দলের সবার ক্যামেরা।
পোশাক পরিচ্ছদে পরদেশি বুঝতে পেরে এগিয়ে এলেন আহমেদ বাকের নামে একজন। কুঁড়ি বছর নিউজিল্যান্ডে কাটানো এই মালয় পুত্র এখন জর্জটাউনের স্থায়ী বাসিন্দা। নিজস্ব মাইক্রো করে অষ্টাদশী কন্যাকে নিয়ে এসেছেন বৈকালিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগে। জর্জটাউনের আদ্যপান্ত তার মুখস্ত জানিয়ে প্রস্তাব দেন রাজি থাকলে পুরো শহর আমাদের দেখাতে পারেন। বিনিময়ে যা দেব তাতেই খুশি।
কুয়ালালামপুর থেকে গাইড সাথে আসায় বাকেরের প্রস্তাব রাখা হয়নি। তবে হোটেলে পৌঁছে নওশের এ নিয়ে বেশ আফসোস করল।
আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তার ঠিক বিপরীতে তাকাতেই চোখে পড়ে ফোর্ট কর্নওয়ালিশ লেখা সাইনবোর্ড। প্রণালী দেখা বাদ দিয়ে নওশের ও জসিম স্যারকে নিয়ে সে পথ ধরলাম। জৌলুস হারানো উঁচু প্রাচীর ঘেরা দুর্গের বাইরে রাখা প্রতীকী কামান। পাশেই দুর্গের নাম খচিত বিশাল সাইনবোর্ড। ১৭৮৬ সালে জর্জটাউন আবিষ্কারের পরপরই ক্যাপ্টেন ফ্রান্সিস লাইট দুর্গটি নির্মাণ করেন। এক সময়কার পেনাংয়ের প্রধান প্রশাসনিক কেন্দ্র ও সুপ্রিম কোর্ট ভবনটি বর্তমানে জর্জটাউনের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। নির্ধারিত ফি দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে যে কেউ দেখতে পারেন দুর্গটি।
আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা পৌঁছার আগেই দুর্গে প্রবেশের সময়সীমা শেষ হয়ে গেছে, তাই আর ভেতরে যাবার সুযোগ হয়নি। পাশেই ক্লক টাওয়ার। ৬০ ফুট উঁচু মিনার আকৃতির টাওয়ারটি রানী ভিক্টোরিয়ার ক্ষমতা আরহণের ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে ১৮৯৭ সালে নির্মিত।
ক্লক টাওয়ারের সামান্য উত্তরে ‘ওয়ার মেমোরিয়াল’। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পেনাং পোতাশ্রয়ে জার্মান নৌবাহিনীর আক্রমণে নিহত সৈনিকদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতি ফলকটি জর্জটাউনের উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান।
রাত ঘনিয়ে আসায় গাইড আমীর হামজার তাড়ায় আমাদের হোটেলের উদ্দেশ্যে ছুটতে হলো। আগে থেকে বুক করে রাখা হোটেল রীগল মালয়েশিয়ায় দেখা দিল নতুন বিড়ম্বনা। বয়স্ক দুই রুম সহায়ক মালয় ভাষা ছাড়া কিছুই বোঝে না। দুর্বলতা টের পেয়ে তাদের নিয়ে রসিকতায় মেতে উঠে নওশের। তবে হোটেল রীগল মালয়েশিয়ার অবস্থান এক কথায় চমৎকার।
আমাদের রুমের পেছনের জানালা দিয়ে দেখা মেলে মালাক্কা প্রণালীর। সামনে তাকালে রাস্তার ওপারে বাংলাদেশের বিলুপ্তপ্রায় কোনো জমিদার বাড়ির ন্যায় পুরাতন ভগ্ন ভবন। পাশেই গুল্ম লতায় বেষ্টিত বিরাটাকার বট গাছ। ঠিক যেন ভূতুরে বাড়ি।
ঘণ্টাখানেক পর আমাদের নিয়ে নৈশভোজে বের হন আমীর হামজা। ভারতীয় মালিকানাধীন রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার সারতে হলো। অর্ডার নিতে এসে বাঙালি বলে চলে গেল ওয়েটার। মিনিটখানেক পর দেখা মেলে নতুন ওয়েটারের। কাছে এসেই বলেন আমি বাংলাদেশি। কোন কোন খাবার আমাদের জন্য মানানসই নিজ থেকেই বলে গেলেন। তার পরামর্শ অনুযায়ী খাবার সরবরাহের অর্ডার হলো। কিন্তু একি! সবই যে, বিস্বাদ। দামও কুয়ালালামপুরের তুলনায় বেশি।
খাওয়া শেষে আমীর আমাদের নিয়ে যান নৈশকালীন শহর পরিভ্রমণে। ধীর গতিতে চলমান গাড়িতে বসেই দেখা হলো টাউন হল, পেনাং রাজ্য জাদুঘর, সেন্ট জর্জ চার্চ, গডেস অব মেরি টেম্পল, কিং স্ট্রিট টেম্পল, খ্রিস্টান সমাধীক্ষেত্র। এরপর লাভলেন ঘুরে দেখতে গেলাম রাতের মালাক্কা প্রণালী। রাত প্রায় দশটা কিন্তু মানুষজনের কমতি নেই। সন্ধ্যার চেয়ে বেশিই মনে হলো। পরের দু’দিন সাপ্তাহিক ছুটির কারণে পর্যটক বেশি বলে জানান আমীর।
আধঘণ্টা পর ফিরলাম হোটেলে। শহর দেখার তিয়াস তখনো মেটেনি। অন্যরা রুমে ফিরলে নওশেরকে সঙ্গী করে হেঁটে চললাম শহর দেখতে।
জর্জটাউন নিরাপদ, সারারাত রাস্তায় থাকলেও সমস্যা নেই, হোটেল ম্যানেজারের এমন আশ্বাসে নির্ভয়ে পথ চললাম। প্রায় এক ঘণ্টা ঘুরেছি। ততক্ষণে শান্ত হয়েছে শহর। বন্ধ দোকানপাট। মাঝে মাঝে দু’একটা প্রাইভেটকার ছোটাছুটি করছে।
পরদিনই সকালেই লংকাউইয়ের উদ্দেশে বিদায় জানাই জর্জটাউনকে। কিন্তু অনেক কিছুই রয়ে যায় অদেখা।
মালয়েশিয়া ভ্রমণ বলতে কুয়ালালামপুরের টুইন টাওয়ারস, পাখির অভয়াশ্রম, পুত্রজায়ার ক্যাপসুল টাওয়ার, জেন্টিং হাইল্যান্ড কিংবা লংকাউইকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি পরখ করতে এগুলো যথেষ্ট। কিন্তু ইতিহাস আর ঐতিহ্যের সাথে আধুনিকতার সমন্বয় বুঝতে ঘুরতে হবে জর্জটাউন।
১৭৮৬ সালে বৃটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির বণিক ফ্রান্সিস লাইট আবিষ্কার করেন আজকের জর্জটাউন। বৃটিশ রাজা জর্জ-৩ এর নামানুসারে জর্জ টাউনের নামকরণ করা হয়। সিটি এলাকা ১২১ বর্গ কিরোমিটার হলেও কোর জোনের আয়তন ১০৯.৩৮ হেক্টর।
উত্তর-পূর্বে মালাক্কা প্রণালী, উত্তর পশ্চিমে লাভ লেন এবং দক্ষিণÑ পশ্চিমে গ্যাট লিবিউ মালায়ু (Gat Lebuh Melayu) ও জালান লিম চিউ লিওং (Lim Chwee Leong) বেষ্টিত কোর জোনেই আছে এক হাজার সাতশ’রও বেশি ঐতিহাসিক ভবন। তাইতো ২০০৮ সালে ইউনেস্কো জর্জটাউনকে ঘোষণা করেছে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে।
২০১০ সালে ECA International-এর বিবেচনায় জর্জটাউন মনোনীত হয়েছে মালয়েশিয়ার সবচেয়ে বসবাসযোগ্য নগরী হিসেবে। একই সাথে এশিয়ার অষ্টম আর বিশ্বের ৬২তম বসবাসযোগ্য নগরীর স্বীকৃতি পেয়েছে জর্জটাউন।
কিভাবে যাবেন: ট্রেন, বাস এবং প্রাইভেট গাড়ি করে কুয়ালালামপুর থেকে জর্জটাউন যাওয়া যায়। প্রতিদিন বিকেল সোয়া চারটা ও রাত ৯টা ৩৫ মিনিটে পেনাংয়ের ট্রেন কুয়ালালামপুর ছেড়ে যায়। দিনের ট্রেনে ছয় ঘণ্টা ও রাতের ট্রেনে আট ঘণ্টা সময় লাগে। ভাড়া ৮০০-১৯০০ টাকা।
স্টেশন বাটারওয়ার্থ (Butter worth) থেকে ফেরি করে যেতে হয় জর্জটাউন। স্টেশন থেকে ফের ২-৩ মিনিটের হাঁটাপথ। ৩০ টাকা ফেরি চার্জ মিটিয়ে ১০-১৫ মিনিটে পৌঁছা যায় জর্জটাউন। দিন-রাত সবসময় আছে জর্জটাউনমুখী এক্সপ্রেস বাস। মাথাপিছু ভাড়া ৭২০ টাকা। সময় প্রয়োজন ছয় ঘণ্টা। এছাড়া ভাড়া করা কার বা মাইক্রোতে পাঁচ ঘণ্টায় যাওয়া যায় জর্জটাউন। কারের রেন্ট হবে প্রায় ১২ হাজার। আর মাইক্রোর জন্যে দিতে হবে প্রায় আঠারো হাজার।
থাকা-খাওয়া খুব ব্যয়বহুল নয়। সকালের নাস্তাসহ তিনজনের কক্ষের ভাড়া পড়বে ৩ হাজার ছয়শ’ টাকা, দুইজনের কক্ষ দুই হাজার নয়শ’ টাকা, একক কক্ষ ১ হাজার সাতশ’ টাকা। আটশ’ থেকে হাজার টাকার মধ্যে ভালোভাবেই মেটানো যায় জনপ্রতি দৈনন্দিন খাওয়া খরচ।
প্রিয় পাঠক, ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে।
আর একটা কথা লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে ভুলবেনই না, সেই সঙ্গে বাতলে দিন সেখানে যাওয়ার পথঘাটের বিবরণও।
প্রিয় পাঠক, আপনার ভ্রমণ আনন্দ বিশ্বজুড়ে বাঙালির কাছে ছড়িয়ে দিতে আমাদের ই-মেইল করুন-bntravellers.notebook@gmail.com এই ঠিকানায়।
মিনহাজুল ইসলাম জায়েদ: বিসিএস (ইকোনোমিক), সহকারী প্রধান, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা
বাংলাদেশ সময়: ১১০১ ঘণ্টা, মে ২৭, ২০১৪