কক্সবাজার: জাপানি পরিবেশবাদি ও বৃক্ষপ্রেমী সংগঠন ওয়েস্কা’র স্বেচ্ছাসেবিরা কক্সবাজার তথা বাংলাদেশের মাটিকে ভালোবেসেছেন নিবিড়ভাবেই। ১৯৯২ সাল থেকে প্রতিবছর তারা বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বা প্যারাবন ‘চকরিয়া সুন্দরবন’কে রক্ষায় কায়িক শ্রম, নগদ অর্থ ও সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড দিয়ে অকৃত্রিম ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে চলেছেন।
জাপানি সংস্থা ওয়েস্কার মতে, প্রায় ৪০ হাজার একর এলাকার এই প্যারাবন বা ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট ২১ প্রজাতির গাছ ও কয়েকশ’ প্রজাতির পশুপাখির বিচরণক্ষেত্র ছিল। এই বন সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাসকে কার্যকরভাবে বাধা দিয়ে শত শত বছর ধরে বৃহত্তর চকরিয়ার (চকরিয়া-পেকুয়া) মানুষের প্রাণ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতো।
কিন্তু ১৯৭৬ সাল থেকে লক্ষ্য করা যাচ্ছে এক শ্রেণির অসাধু ও লোভী মানুষ চিংড়ি চাষ ও ব্যাপকভাবে জ্বালানিকাঠ সংগ্রহের মাধ্যমে অধিকাংশ প্যারাবন উজাড় করে ফেলছে। ফলে ১৯৯১ সালের প্রলংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের সময় মাত্র কয়েক ঘণ্টার তাণ্ডবে বৃহত্তর চকরিয়া উপজেলার ১৭ হাজারেরও বেশি লোকের প্রাণহানি ঘটে।
২৫/৩০ ফুট উচুঁ জলোচ্ছ্বাসে প্যারাবনের গাছ-গাছালি দুমড়ে মুচড়ে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এমনকি ইতিহাসের পাতা থেকে চকরিয়া সুন্দবনের কেওড়া, বাইন জাতীয় গাছ গাছালির অস্তিত্ব হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়।
ওই অবস্থায় আগমন ঘটে ওয়েস্কা ইন্টারন্যাশনাল নামক জাপানি পরিবেশবাদি সংগঠনের। সংগঠনটির উদ্যোগে ১৯৯২ সাল থেকে প্রতিবছর এক বা একাধিক দলে বিভক্ত হয়ে বর্ষার শুরুতে এখানে গাছের চারা রোপন করতে আসেন জাপানি নারী-পুরুষ। দলগুলোতে থাকেন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
চকরিয়া সুন্দরবনের অসংখ্য নদী-খালে প্রতিবছর নতুন নতুন চর জেগে উঠে। এসব চরেই জাপানিরা ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের উপযোগী চারা রোপন করেন। অন্যান্য বছরের মতো এ বছরও গত ৩১ মে ও ১৫ জুন দুই দফায় ২৭ জন স্বেচ্ছ্বাসেবি এসে চকরিয়া উপজেলার রামপুর ও বদরখালী মৌজা এলাকায় কেওড়া ও বাইন প্রজাতির প্রায় ৫ হাজার গাছের চারা রোপন করে গেছেন।
ওয়েস্কা ১৯৯২ সাল থেকে চকরিয়া সুন্দরবনের অসংখ্য নদী-খালের চরে এ পর্যন্ত স্থানীয় পেশাদার কর্মী নিয়োগ করে প্রায় এক হাজার একর এলাকায় প্রায় ৪০ লাখ গাছের চারা রোপনের কাজ সম্পন্ন করেছে।
প্রতিবারের মতো এবারও ব্যতিক্রম হয়নি সচেতনতামূলক কর্মকান্ডের। জাপানি সংস্থা ওয়েস্কার বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের পরিচালক তাতসুয়ো কসুগী ও স্থানীয় প্রতিনিধি হামিদুল হক মানিক প্রকল্প এলাকা চকরিয়া উপজেলার ইলিশিয়া ও আশপাশের কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এ কাজে সম্পৃক্ত করেন জাপানিদের সাথে।
কাদা মাটিতে রোপন করা গাছের চারা বাঁশের কঞ্চিতে সুতা দিয়ে বেঁধে দেওয়ার কাজ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্ররা। দোভাষীর মাধ্যমে বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও এর প্রতিরোধে গাছের অসীম ভূমিকার বিষয়ে মতবিনিময় করেন তারা।
সংগঠনটি মনে করে, বাংলাদেশের আগামী প্রজন্ম নিজেদের প্রয়োজনে প্যারাবন রক্ষার গুরুত্ব বুঝতে পারলেই আবার চকরিয়া সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াবে।
তারা বলেন, সুন্দরবনের অসংখ্য নদী-খালের পাড়ে এবং চিংড়ি ঘেরের চারপাশে প্যারাবন গড়ে তোলা সম্ভব হলে চকরিয়া ও পেকুয়া এলাকার প্রায় ৭ লাখ মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে রক্ষা পাবে। এই উদ্যোগই হতে পারে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার জন্য একটি মডেল।
জাপানি স্বেচ্ছাসেবিদের দলনেতা সুনেও ফুকুদা বলেন, আমরা এখানকার মাটি ও মানুষকে ভালবাসি বলেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষার জন্য ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট আবার গড়ে তুলতে চাই। কিন্তু আমাদের লাগানো গাছের চারা কোনো কোনো মানুষ নষ্ট করছে শুনলে বেশ কষ্ট পাই। তাই এদেশের সরকার তথা প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ তারা যেন স্থানীয়দের যথাযথভাবে সচেতন করে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেন দেশ ও জাতির স্বার্থে।
বাংলাদেশ সময়: ১২৫১ ঘণ্টা, জুন ২৩, ২০১৪