জয়পুরহাট থেকে ফিরে: অফিসের অ্যাসাইনমেন্টে জয়পুরহাট। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জনসভার সংবাদ সংগ্রহ করতে।
জনসভার দু’দিন আগেই আমি ও মারুফ ভাই জয়পুরহাটে পৌঁছি সেখানকার টুকিটাকি সংবাদ সংগ্রহের জন্য। সেখানে আমাদের সঙ্গে যোগ দেন সবুজ। কিন্তু বিধি বাম। ঢাকা থেকে যেদিন রওয়ানা দেই সেদিন থেকেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। গাবতলী থেকে জয়পুরহাটের বাসে উঠতেই বৃষ্টির বেগ বাড়তে শুরু করলো। সেকি এমন কেমন বৃষ্টি! টানা তিনদিন।
বৃষ্টির কারণে জয়পুরহাট পৌঁছানোর পর দিন ঘর থেকে বের হওয়াই দায় হয়ে গেলো। কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না আমরা। অফিসের প্রতিনিধি হয়ে এতো দূর আসা, বৃষ্টির কারণে যদি নিউজ এবং ছবি পাঠাতে না পারি তাহলে হয়তো আমাদের ওপর অফিস দায় চাপাবে না, তারপরও নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে প্লাস্টিকের ব্যাগে ক্যামরাসহ টুকিটাকি জিনিসপত্র নিয়ে বের হলাম সংবাদ সংগ্রহের উদ্দেশে।
আমরা বের হওয়ার কিছুক্ষণ পর হঠাৎ করেই বৃষ্টি উধাও। আমার সহকর্মীরা নিউজ আর আমি ছবি পাঠিয়ে অনেকটা দায়মুক্ত হলাম। নিজেকে কিছুটা হলেও হালকা মনে হলো।
আপাতত নিউজ আর ছবি পাঠানো তো শেষ, অবসরে কি করি! হঠাৎ মনে হলো জয়পুরহাটের কাছেই তো পাহাড়পুরের ঐতিহাসিক বৌদ্ধ বিহার। যেমন চিন্তা তেমন কাজ। দুই সহকর্মী মারুফ ভাই আর সবুজকে বলতেই তারা একবাক্যে রাজি।
পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের অনেক ইতিহাস, অনেক ছবি বইয়ের পাতায় দেখেছি। আজ নিজের চোখে দেখবো ভাবতেই যেন পুলক অনুভব করছি। জয়পুরহাট স্টেশনরোড থেকে মাত্র ৭ কিলোমিটার দূরে পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার। এটা অবশ্য নওগাঁ জেলার বদলগাছী থানায়।
একটা সিএনজি ভাড়া করে তাতে চেপে বসলাম পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার দেখার উদ্দেশ্যে। রাস্তা ভালো থাকায় মাত্র ৪৫ মিনিটে পৌঁছে গেলাম সেই স্বপ্নের জায়গায়।
অনেকগুলো গাড়ি দাঁড়িয়ে বৌদ্ধবিহার জাদুঘরের সামনের মাঠে। আমাদের সিএনজিও সেখানেই থামলো। গাড়ি থেকে নেমেই জাদুঘরে ঢোকার বড় গেট। জনপ্রতি ১০ টাকার টিকিট কেটে ভেতরে ঢোকার অনুমতি মিললো।
আমরা টিকিট কাটতে গেলে আমার হাতে ক্যামেরা দেখে আমাদের পরিচয় জানতে চাইলো সংশ্লিষ্টরা। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে খুশি হয়ে ভেতরে নিয়ে গেলো যাদুঘরের এক কর্মকর্তা। ভিতরে ঢুকতে হাতের বামে একতলা একটি যাদুঘর, আর হাতের ডানে রয়েছে খুবই আরামদায়ক বালিশসহ বিছানা। তবে এতে বসা বা শোয়ার চিন্তাই করবেন না, শুধু দেখেই আপনাকে এর আরামের স্বাদ নিতে হবে। চোখে না দেখলে বিশ্বাই করবেন না যে বিছানাটি ছোটছোট গাছ দিয়ে তৈরি।
বৌদ্ধ বিহারের মূল ঢিবি বা পাহাড়ে যাওয়ার রাস্তাটিও খুবই সুন্দর, দুই পাশে রকমারী ফুলের গাছ। সামনে এগুতেই ছোটছোট গাছ কেটে-ছেটে ইংরেজিতে ‘ওয়েলকাম’ লেখা। দেখেই মনে হবে লেখাটি নয়, যেনো গাছগুলোই আপনাকে স্বাগতম জানাতেই জন্ম থেকেই এমনভাবে বেড়ে উঠেছে।
তার একটু দূরেই দেখতে পাবেন ফুলের বাগানে হাজার রকমের ফুল গাছ আর সেই ফুলগুলো পাহারা দিচ্ছে দু’টো হাতি। অবাক হলেন তো! হাতি আবার ফুল আর গাছ পাহারা দেয় নাকি!! দেয় বৈকি, হাতিও যে লতা জাতীয় গাছ কেটে-ছেটে তৈরি।
যতই মূল টিবির কাছাকাছি যাচ্ছি ততই আমার ক্যামেরা ক্লিক’র সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। সুযোগে নিজেও কয়েকটি ছবি তুলে নিলাম। বাগান পেরিয়ে ঝুলানো রয়েছে এর ইতিহাস নিয়ে লেখা বিশাল বোর্ড। যেখান থেকে বৌদ্ধ বিহার সম্পর্কে জানতে পারলাম অনেক কিছু। স্কুলে ইতিহাস বইয়ে যা পড়েছিলাম তাতো আর মনে ছিলো না, এবার পড়ে যেনো অনেকটাই মরমে গেঁথে গেলো।
চারদিকে সবুজ মাঠের মধ্যমনি বিশাল জায়গা নিয়ে পাহাড়পুর বৌদ্ধ মন্দির। প্রচুর লোকের সমাগম। যে যার মতো নিজেকে ক্যামেরাবন্দি করছে।
বৌদ্ধ বিহারের পাদদেশে বুদ্ধমূর্তি, বিভিন্ন রকমের জন্তুর কারুকার্য। পুরো বিহারটা ঘুরতে আমাদের প্রায় ২ ঘণ্টা সময় লাগলো। তার পর যেনো মনের সাধ মিটতে চাইছে না। কিন্তু আবার সেই বৃষ্টির কারণে বেশ তাড়াতাড়িই স্বপ্নের জায়গাটা ছেড়ে আসতে হলো। আর মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম, আবার কখনো সময় পেলে বন্ধুরা মিলে ঘুরে যাবো এই স্বপ্নের ঐতিহাসিক পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার।
পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের ইতিহাস
এ বিহারের প্রকৃত নাম ছিল সোমপুর মহাবিহার। এ মহাবিহার পাল বংশীয় দ্বিতীয় রাজা ধর্মপাল ৭৭০-৮১০ খিস্টাব্দের মধ্যে নির্মাণ করেছিলেন। এটি হিমালয়ের দক্ষিণে সর্ববৃহৎ বৌদ্ধ বিহার। খননে উন্মুক্ত পাহাড়পুরের ধ্বংসাবশেষ বাংলাদেশে খুবই গুরুত্বপুর্ণ।
১৯২৩ ইংরজি সাল থেকে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত সময়ের খননের ফলে এখানে গুপ্ত যুগের তাম্রশাসন (৪৭৯ খ্রিস্টাব্দ) সহ প্রস্তর লিপি, প্রস্তর ও ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য, পোড়া মাটির ফলক চিত্র, শুকনা মাটির সিল, অলংকৃত ইট ও বিভিন্ন ধাতব পদার্থ, রৌপ্য মুদ্রা, মাটির তৈরি পাত্রসহ প্রচুর প্রত্ন নিদর্শন পাওয়া যায়।
১৯৮২ সালের এবং পরবর্তী সময় পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারে কতিপয় ভিক্ষু কক্ষে গভীর খননের ফলে নিন্ম আবাসস্থলে একটি পোড়া মাটির মূর্তির মাথা, একটি তাম্র মুদ্রাসহ আরো নানা ধরনের প্রত্ন দ্রব্যাদি পাওয়া যায়।
পাহাড়পুরের উত্তর-দক্ষিণে ৯২২ ফুট এবং পূর্ব-পশ্চিমে ৯১৯ ফুট। বিহারের উত্তর বাহুর মধ্যস্থলে প্রধান ফটক ও প্রবেশ পথ। বিহারের উন্মুক্ত আঙিনায় চার বাহুতে ১১৭টি ভিক্ষু কক্ষ রয়েছে। অঙ্গনের কেন্দ্রস্থলে সুউচ্চ মন্দির অন্যান্য স্থানে ছোট নিবেদন স্তুপ, কেন্দ্রীয় মন্দিরের অনুরূপ ছোট মন্দির, ভোজনশালা, রান্নাঘর সব কিছুই সুচারুরূপে নির্মিত।
আকর্ষণীয় কেন্দ্রীয় মন্দিরটি ক্রশাকৃতি এবং ধাপে ধাপে উঁচু করে নির্মাণ করা হয়েছে। পোড়া মাটির ফলকচিত্র দিয়ে মন্দিরের বইরের দেয়াল সুশোভিত করা হয়েছে।
৯ম শতাব্দির শেষ পর্ব হতে শুরু করে বিদেশি রাজা এবং দিব্য নামে এদেশীয় এক কৈবত সামস্ত নরপতি পাল সাম্রাজ্য বার বার আক্রমণ করে। এভাবেই সোমপুর বিহারের যথেষ্ট ক্ষতি সাধিত হয়।
প্রায় একই সময়ে বাঙ্গাল সৈন্যরা এই বিহার পুড়িয়ে দেয়। ১২ শতক বাংলাদেশ সেন রাজাদের হস্তগত হয়। এভাবে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার ও মন্দির পরিত্যক্ত হয়।
বাংলাদেশ সময়: ০৪৪০ ঘণ্টা, জুলাই ২৫, ২০১৪