ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

এভিয়াট্যুর

ব্যয়বহুল এয়ারবাস-৩১০’র ব্যয় কত!

ইশতিয়াক হুসাইন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১০৯ ঘণ্টা, মার্চ ১২, ২০১৫
ব্যয়বহুল এয়ারবাস-৩১০’র ব্যয় কত! ফাইল ফটো

ঢাকা: কোটি কোটি টাকার অপ্রয়োজনীয় খরচ এড়াতেই বাতিল করা হচ্ছে দুটি ৩১০ এয়ারবাস। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স মনে করেছে বহর থেকে এদুটি ‘শ্বেতহস্তি’ বিদায় করলেই সংস্থাটির লোকসান কমবে।



বাংলানিউজের অনুসন্ধানে বিমানের বহরে দুটি এয়ারবাস-৩১০’র কারণে লোকসানের বিস্তারিত তথ্য উঠে এসেছে। সেখানে মাত্রাতিরিক্ত জ্বালানি খরচকে  এর লোকসানের পেছনের সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে।

বিমানসূত্র জানায়, নতুন একটি ৩১০ এয়ারবাস ৩ টন জ্বালানি নিয়ে এক ঘন্টা চলতে পারে। আর পুরাতন একটি এয়ারবাস এক ঘন্টা চালাতে প্রয়োজন ৪ থেকে সাড়ে ৪ টন জ্বালানি। সেই হিসাবে ঘণ্টায় টন প্রতি দেড় লাখ টাকার বেশি বাড়তি জ্বালানি খরচ হয়। এয়ারবাস ৩১০ বাংলাদেশ বিমানের জন্য এমনই এক ব্যয়বহুল উড়োজাহাজ।

একটি হিসাবে দেখানো হয়েছে, ঢাকা থেকে দুবাই পর্যন্ত ৫ ঘন্টার যাত্রাপথে পাড়ি দিতে বিমানের এই এয়ারবাস এমিরেটসের একটি ফ্লাইটের চেয়ে ৬ লাখ টাকার বেশি জ্বালানি খবরচ করে।   

এর বাইরে পুরাতন এসব উড়োজাহাজের রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ও অনেক বেশি।

তথ্যমতে, বিশ্বের কোনো এয়ারলাইন্সই এখন আর এয়ারবাস ৩১০ মডেলের উড়োজাহাজ ব্যবহার করে না। শুধুমাত্র কার্গো উড়োজাহাজ হিসেবে কেউ কেউ এয়ারবাস ৩১০ পরিচালনা করছে। এ  কারণে এই মডেলের উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশও সহজলভ্য নয়।

বিমানের সংশ্লিষ্ট বিভাগের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, যন্ত্রাংশ পাওয়াই যায় না, আর পাওয়া গেলেও মাত্র ৫০ ডলারের একটি যন্ত্রাংশ কিনতে ব্যয় করতে হযে যায় হাজার হাজার ডলার। এভাবে শত গুণ বেশি দামে কেনা যন্ত্রাংশ দিয়ে প্রতিদিন রক্ষণাবেক্ষণ করতে হচ্ছে বিমানের এয়ারবাস ৩১০ উড়োজাহাজ। এ কারণে এই উড়োজাহাজ দিয়ে লাভের বদলে লোকসানই গুনতে হচ্ছে বিমানকে।

বিমান চলাচল বিশেষজ্ঞদের মতে, বিমানের উড়োজাহাজের অপারেশনাল ব্যয় অন্যান্য উড়োজাহাজের প্রায় দ্বিগুণ। একটি নতুন উড়োজাহাজের অপারেশন ব্যয় যেখানে প্রতি ঘন্টায় ৪ হাজার মার্কিন ডলার, সেখানে বিমানের পুরনো উড়োজাহাজের খরচ কমপক্ষে ১০ হাজার ডলার।

বিশেষজ্ঞদের মতে, কোনো উড়োজাহাজের অপারেশন ব্যয় ৮ হাজার ডলারের বেশি হলে সেই এয়ারলাইন্সকে বাণিজ্যিকভাবে বাঁচিয়ে রাখা অসম্ভব।  

লোকসান জেনেও এত পুরাতন উড়োজাহাজ বিমানের বহরে কেন রাখা হচ্ছে? বিষয়টি জানতে বিমানের প্রকৌশল বিভাগের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয় বাংলানিউজের। উত্তরে তারা উল্টো প্রশ্ন করেন, বিমানের তো উড়োজাহাজই নেই। তাই যা আছে তা বাদ দেবেন কিভাবে?

এ প্রসঙ্গে কর্মকর্তাদের একজন বলেন, বিকল্প না থাকার কারণেই লোকসান জেনেও এসব উড়োজাহাজ চালাতে বাধ্য হয়েছে বিমান।
 
তবে বাংলানিউজের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তারা ফায়দা লুটছেন এসব পুরাতন উড়োজাহাজ বহরে রেখে। আর সে কারণেই বছরের পর বছর লোকসান গুনেও তা বিমানের সঙ্গী হয়ে থাকছে।

একটি উড়োজাহাজ উড্ডয়নক্ষম থাকলেই তা নিয়ে লাভ লোকসানের প্রশ্ন আসে। কিন্তু এয়ারবাস উড়োজাহাজ প্রায়ই বিভিন্ন ধরনের যান্ত্রিক ত্রুটি নিয়ে অচল হয়ে পড়ে থাকে। এতে বাড়তে থাকে লোকসানের বোঝা।

সূত্র জানায়, যখনই একটি উড়োজাহাজ অচল হয় তখনই অসাধু কর্মকর্তারা যন্ত্রাংশ পরিবর্তনের নামে বড় অংকের অর্থ হাতিয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

মেরামতের নামে চলে দীর্ঘসূত্রতাও।

সূত্র জানায়, ২০১২ সালে রক্ষণাবেক্ষণের নামে দুই মাসের বেশি একটি এয়ারবাস ৩১০ সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি বিমানবন্দরে ফেলে রাখা হয়। কথা ছিল ৩৮ দিনের মধ্যে এর মেরামত শেষ হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যন্ত্রাংশ না পাওয়ার অজুহাতে দীর্ঘদিন ফেলে কমিশন হাতিয়ে নেয় একটি চক্র। এতে বিমানের লোকসান হয় প্রায় আড়াইশ কোটি টাকা।

অনেকটা একই সময়ে বিমানের লিজে আনা আরেকটি এয়ারবাস ৩১০ উড়োজাহাজ ৭ মাস ফেলে রাখা হয় চাঙ্গিতে। শেষ পর্যন্ত ওই এয়ারবাসটি আর দেশে ফিরিয়ে আনা হয়নি।  

বর্তমানে বিমানের ২২১ আসন বিশিষ্ট দুটি এয়ারবাস ৩১০ উড়োজাহাজ রয়েছে। এ দুটি উড়োজাহাজ কেনা হয় ১৯৯০ সালে। তখন দুটিই ছিল ব্র্যান্ড নিউ উড়োজাহাজ। এর মধ্যে একটি দুবাইয়ে দুর্ঘটনায় পড়ে। কাছাকাছি সময়ে আরো একটি এয়ারবাস লিজ নেয় বিমান। পরে লিজে আনা এয়ারবাসটি কিনে নেওয়া হয়। সবমিলিয়ে বিমানের বহরে স্থান পায় তিনটি উড়োজাহাজ। এদের দুটি উড়োজাহাজ এ-মুহূর্তে উড্ডয়ন উপযোগী রয়েছে।   

বিমান সূত্র জানায়, এই দুটি উড়োজাহাজেই প্রতি ঘন্টায় উড্ডয়নব্যয় ক্রমেই বাড়ছে, আর রক্ষণাবেক্ষণ হয়ে উঠছে আরও ব্যয়বহুল। তাছাড়া বর্তমান বিশ্বে এ ধরনের উড়োজাহাজ দিয়ে যাত্রী পরিবহন এখন আর হয় না বললেই চলে। এরই মধ্যে দুটি এয়ারবাসের ডি চেক (বড় ধরনের রক্ষণাবেক্ষণ) প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। আগামী বছর এই রক্ষণাবেক্ষণ করাতে হবে। এতে ৫ কোটি টাকা ব্যয় হবে। এ দুটি এয়ারবাসের আসনগুলো জরাজীর্ণ হয়ে গেছে। যা বদলানো হলে খরচ পড়ে যাবে আরও কয়েক কোটি টাকা।

২০১৪ সালের জানুয়ারিতে একটি এয়ারবাস ৩১০-তে ফাটল ধরে। আশঙ্কা করা হচ্ছে যে কোনো সময়েই একই ধরনের পরিণতি হতে পারে অন্য দুটি এয়ারবাসেরও।  

ঠিক এমনই একটি সময়ে ডি চেকের আগেই বহর থেকে ব্যয়বহুল এই দুটি উড়োজাহাজ বিদায় করতে চায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স।   

তবে পুরনোগুলো বিদায় করে নতুন ও আধুনিক এয়ারবাস নিচ্ছে বিমান। সংস্থাটির চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল (অব:) জামাল উদ্দিন আহমেদ বাংলানিউজকে জানান, এ বছরই বিমানের বহরে যোগ হচ্ছে দুটি ব্র্যান্ড নিউ বোয়িং ৭৩৭ ও বোয়িং ৮০০ উড়োজাহাজ। এর সঙ্গে লিজ নেওয়া হচ্ছে আরো দুটি বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজ। এই চারটি উড়োজাহাজ বিমানের বহরে যুক্ত হলে তখন বিমান অনায়াসে পুরাতন এয়ারবাস ৩১০ উড়োজাহাজ দুটি বহর থেকে সরিয়ে ফেলতে পারবে।  

বাংলাদেশ সময়: ১১০৬ ঘণ্টা, মার্চ ১২, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।