২৪ এপ্রিল ঢাকা থেকে কলকাতা রওয়ানা। তার দু’দিন আগে থেকেই সারা বাংলাদেশে অঝোরে অকাল বৃষ্টি।
রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় অফিসের পাশেই হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। গাড়িতে করে গেলে সর্ব্বোচ পনেরো মিনিট। তাই একটু জিরিয়ে যাওয়াই ভালো। ঢাকা সময় ১১টা ২০ মিনিটে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের বোয়িং-৭৩৭ এ যাত্রা।
আন্তর্জাতিক শিডিউল অনুযায়ী প্লেন ছাড়ার দুই ঘণ্টা আগে পৌঁছাতে হয় বিমানবন্দরে। তা-ই করি প্রতিবার। কিন্তু সেদিন পৌঁছালাম একঘণ্টা আগে। অনেকটা আলসেমিতে।
বোর্ডিং কাউন্টার ফাঁকা। ভিড় নেই দেখে আরও খানিকটা হেলে-দুলে স্বস্তিতে পৌঁছালাম কাউন্টারে। পাসপোর্টটা বাড়িয়ে দিতে তরুণী কর্মকর্তার কণ্ঠ, সরি স্যার কাউন্টার বন্ধ হয়ে গেছে।
মানে কী?
আমাদের একঘণ্টা আগেই বন্ধ হয়। টাইম মেনে।
তাহলে উপায়?
উপায় একটাই, টিকিট কেটে পরের ফ্লাইটে...
হায় হায় কী বলে! ধরা খাওয়া কাকে বলে। সেই যে জিরিয়ে-টিরিয়ে এলাম, তার জবাবদিহি চলছে নিজের ভেতরে।
দুই মিনিট অপেক্ষা না সারতেই পেছনে দেখি আরও গোটা পনেরোটি পরিবার হন্তদন্ত হয়ে তরুণীর দিকে ধেয়ে আসছে। মুখে মিষ্টি হাসি আর বিরক্তিকর ভ্রু কুচকে তরুনী বলে চলেছেন, ‘সরি ম্যাডাম, সরি স্যার...’। বুকে বল এলো বটে, ‘ফেইলড আমি একা নই। ’
এক তরুণের কণ্ঠ, ‘আপু কী কন আপনি? বাইরে দেখেছেন কী অবস্থা? এই দুর্যোগে কেমনে সম্ভব? ৬টায় বার হয়ে এই আইলাম। এই বাচ্ছা রোগী নিয়ে যাবো চেন্নাই। কলকাতা থেকে কানেক্টিং ফ্লাইট আছে। ’
ব্যস লেগে গেলো ‘দেরির যুক্তি’ দেওয়ার লড়াই। সব সহযাত্রীর স্বরে গলা মেলালাম, ‘হ হ দেখছেন বাইরে কী অবস্থা। ’ যেন চোরের মায়ের বড় গলা। কাউন্টারের ওপারে তরুণীর পাশ থেকে এবার এক তরুণের কণ্ঠ, ‘দয়া করে শান্ত হোন, ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলছি। ’ ওয়্যারলেস কথোপকথন শেষে সবার হাতে বোর্ডিং পাশ।
এরইমধ্যে এডিটর ইন চিফের ফোন, ‘সব কমপ্লিট, ভাস্কর?’ স্বস্তির সঙ্গে বললাম, ‘হ্যা, স্যার। ’ এডিটর ইন চিফ জানালেন, ফ্লাইট ডিলে হবে। বৈরী আবহাওয়ার কারণে প্লেন নিচে নামতে পারছে না।
তখন মনে মনে ভাবতে থাকলাম, দুর্যোগের কারণে প্লেন উড়তে পারছে না, তাহলে ওপরে ভাসছে কী করে। যা হয় অভিজ্ঞতার অভাবে। বসে আছি, কিছুক্ষণ বাদে এডিটর ইন চিফের টেক্সট মেসেজ, ‘এবার ছাড়বে বোধ হয়। ’ ওমা, অ্যানাউন্স শুরু, ‘ইউএস-বাংলার যাত্রীরা চলে আসুন। ’
মনে হচ্ছিল এডিটর ইন চিফই বুঝি পাইলট। তখনও কিছুই ঠিকভাবে বুঝতে পারছিলাম না। বৃষ্টি কিন্তু একইভাবে হয়ে চলেছে। বৃষ্টিতে প্লেনে চড়ার অভিজ্ঞতা প্রথম। যথাসময় গতি বাড়িয়ে ছাড়লো ইউএস-বাংলার অভিজাত এয়ারক্রাফট। জানালার কাঁচে চোখ। বাইরে বজ্রবিদ্যুৎসহ অঝোরে বৃষ্টি।
সেসব দৃশ্য মোবাইলবন্দি করছেন পাশে বসা এক ইমাম। আর ফিস ফিস সৌন্দর্য এবং সৃষ্টিকর্তার গুনগান গাইছেন। আকাশে ওড়ার ঠিক আগে শুরু হলো ঝাঁকুনি। পাইলটের কণ্ঠ, যাত্রীদের বলছি ভয় পাওয়ার কিছু নেই। খারাপ আবহাওয়ার জন্য কয়েকবার হবে। তবে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
পরিস্থিতি খানিকবাদে স্বস্তির হয়ে এলো। এতোক্ষণে জানালার দিকে চেয়ে দেখি, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে বিমানের নিচে। বোঝা যাচ্ছে, এখন বৃষ্টি ঝরছে ঠিক পায়ের নিচে। এটাই বাস্তব আর এটাই প্রকৃতি। বৃষ্টি এখন আর এই প্লেনের যাত্রীদের মাথার ওপর নেই, বরং প্লেনটা মেঘের ওপর দিয়ে চলছে বলে যাত্রীরাই বৃষ্টির মাথার ওপর।
প্রকৃতি আর মানুষের সৃষ্টি উড়োযানের এই লীলার কথা ভাবতে ভাবতে সামনে এলো ইউএস-বাংলার নিজস্ব ক্যান্টিনের সুস্বাদু নাস্তা। শেষ হতে সময় লাগলো না। এবার চোখের সামনে ঝলমলে রোদ।
পাইলটের কণ্ঠ, ‘ঘড়ির কাঁটায় ভারতীয় সময় ১১টা ৪০ মিনিট। আর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে কলকাতা নেতাজী সুভাষ চন্দ্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করবো আমরা। এখানের তাপমাত্রা ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ’
১৮ হাজার ফুট উঁচু থেকে ১৮ মাইল বেগে কিছুটা মেঘ আর ঝলমলে আকাশের ভেদ করে প্লেন ঠিক সময়ে নামলো নেতাজী বিমানবন্দরে।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৫, ২০১৭
ভিএস/এইচএ/