ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বাহরাইন

বয়সচোরা গাছের ভাঁজে চারশ’ বছর

জাকারিয়া মন্ডল ও মোসাদ্দেক হোসেন সাইফুল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৬, ২০১৫
বয়সচোরা গাছের ভাঁজে চারশ’ বছর ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বাহরাইনের মরুভূমি ঘুরে: ভর দুপুর। রানীর প্রাসাদ অনেক আগেই পেরিয়ে আসা গেছে।

এবার পেছনে ঝাপসা হতে হতে হারিয়ে গেলো বিক্ষিপ্ত লোকালয়। তারপর ছাড়া ছাড়া খেজুর গাছের সারিও মুখ লুকালো দৃষ্টিসীমার ওপাশে। সবুজের সঙ্গ হারিয়ে এবার সাদাটে মরুভূমিতে।

গ্যাসের গন্ধ আসছে নাকে। তেল শেষ হয়ে যাওয়া কূপগুলো থেকে এখন গ্যাস তুলছে বাহরাইন। দু’পাশে সারি সারি গ্যাসক্ষেত্র রেখে মরুর বুক চিরে এগিয়ে যায় বাহরাইন রয়েল কোর্ট কর্মচারী তাজুল ইসলামের গাড়ি।

ভূমি সমতলে গড়া হলেও কম্পিউটার গেমসের রাস্তার মতো এখানকার পিচপথগুলো চকচকে। বুকের ওপর চেপে বসা রাস্তায় একটাও বালুকণা ফেলে রাখেনি বালুময় মরুভূমি। মরুবাতাসে উড়িয়ে নিজের বালুকণা ফের টেনে নিয়েছে নিজের বুকে।

ইলেকট্রিক পোলগুলোকেও বেশ বেখাপ্পা লাগলো এই বিরাণ মরুভূমিতে। সভ্যতার এই খুঁটির সারি দক্ষিণে এগিয়ে গেছে মরুভূমির আরও গভীরে। মাঝেমধ্যে দু’একটা মোবাইল টাওয়ার। এই মরুভূমিতেও বাম্পার সিগন্যাল বাহরাইনি মোবাইল অপারেটর ভিভার। সিগন্যালের কারিশমা আরও পরখ করাতেই যেন হাতে ধরা ফোনটা বেজে উঠলো হঠাৎ।

হ্যান্ডসেটের স্ক্রিনে আলমগীর হোসেন। এই সময়ে এই মরুভূমিতে এডিটর ইন চিফ’র ফোন! অসাধারণ টাইমিং। এবার কোনো ভুলের কারণে ঝাড়ি না খেলেই হয়!

কিন্তু আমার আশঙ্কার ধারেকাছেও না ঘেঁষে কোথায় আছি জেনে নিয়ে তিনি প্রশ্ন ছুঁড়লেন, খেয়েছো? এমন প্রশ্নের মুখে হড়বড়িয়ে বকতে শুরু করলেও ভেতরে ভেতরে তাজ্জব বনে যাই। মরুভূমিতে অনেক সময় থাকতে হবে। তাই না খেয়ে আসাটা অনুচিতই হয়েছে। কিন্তু সে খবর চার হাজার কিলোমিটার দূরে বসে কী করে টের পেলেন তিনি!

ধন্ধ কাটে ব্রেক কষার মৃদু ঝাঁকিতে। গন্তব্য এসে গেছে। মরুর বুকে নেমেই আধা মুঠো বালু তুলি হাতের তালুতে। আনাড়ি পর্যবেক্ষণে তাপমাত্রার তারতম্য বুঝতে পারাটাকে কঠিন কাজই মনে হলো।

মাথার ওপরে পেঁজা পেঁজা মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি খেলায় কুলিয়ে উঠতে পারছে না সূর্য। আলোটা তাই তেজহীন। মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে পারস্য উপসাগরে জেঁকে বসা শীত বুড়ির আঁচলে চেপে হু হু বাতাস আসছে। তাপমাত্রা তবু ২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বলছে আবহাওয়া বিভাগ।  

এবার চোখ তুলেই তাজ্জব! সামনে যেন দিগন্তজোড়া সাদা ক্যানভাসে ছোট্ট এক সবুজ টিপ। এখানে প্রকৃতির ‍চিহ্ন বলতে কেবল মরুর বালু কামড়ে মরুর বুকেই মাথা নোয়ানো খাবলা খাবলা মরুঘাঁস। এ বাদে দৃষ্টিসীমার সবটাই ধু ধু মরুভূমি। তার ঠিক মধ্যিখানে ছোট্ট এক বালুপাহাড়ের মাথায় ওই মহাবৃক্ষ।

ঊষর মরুর বিরাণ বুকে এ কেমন মূর্তিমান বিস্ময়! পাতায় পাতায় প্রাকৃতিক সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ের কাঁপন। শক্তশাখায় পানি ও প্রাণহীন প্রান্তরে জীবন প্রতিষ্ঠার দৃঢ়তা।

কিছু মানুষের বয়স যেমন ঠিক ঠাহর করা যায় না, এই গাছটিও তেমনি বয়সচোরা। ছোট ছোট পাতা আর সরু শাখার বেড় দেখে এর বয়স বোঝারই জো নেই। কাণ্ড আর খোড়লে স্তরে স্তরে সাজানো কোষের বিন্যাস বেশি বয়সের আভাস দিলেও তাতে যে ৪শ’ ৩০ বছরের হিসেব জমেছে তা কল্পনা করা মুশকিলই বটে।


৩০ ফুট উঁচু এ গাছ নিয়ে জৈব-পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের যেমন বিতর্কের অন্ত নেই, তেমনি গাছটিকে ঘিরে জন্ম নেওয়া মিথের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। এ গাছের জীবনের উৎস ও এতো বছর বাঁচার রহস্য তবু অজানা এখনও।

এ গাছে সুমেরীয় কৃষ্ণদেবতা এনকি’র আশীর্বাদ রয়েছে বলে বিশ্বাস যেমন প্রচলিত আছে, তেমনি এ গাছ স্বর্গের উদ্যান ইডেন থেকে এসেছে বলেও বিশ্বাস অনেক অধিবাসীর।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসির ন্যাচারাল হিস্টরি মিউজিয়ামের বিশেষজ্ঞরা গাছটির কোষবলয় পরীক্ষা করে বলছেন, এই গাছ রোপন করা হয়েছে ১৫৮৩ সালে। উত্তর আমেরিকার মেসকুইট প্রজাতির গাছের সঙ্গে এই গাছের মিল আছে বেশ।

মেসকুইট প্রজাতির গাছগুলো মাটির প্রায় শত ফুট নিচ থেকেও পানি টেনে নিতে সক্ষম। আর এর পাতাগুলো এতো ছোট যে প্রস্বেদন প্রক্রিয়ায় খুব বেশি ‍পানি বাষ্প হয়ে উড়ে যাওয়ার সুযোগ পায় না।  

গাছটির কাছেই বালির ভেতরে ডুবে যাওয়া গোটা দশেক ভবন খুঁড়ে পাওয়া গেছে আরবের নয়াপ্রস্তর যুগের নির্দশন। এখন থেকে সাড়ে ছয় হাজার বছর আগেকার এসব নিদর্শন প্রাচীন ভারতের সঙ্গে মেসোপটেমিয়া সভ্যতার বাণিজ্যরুটে বাহরাইনের গুরুত্বই তুলে ধরে।

ভারত আর চীনের প্রাচীন কিছু বাসন-কোসনও পাওয়া গেছে এখানকার বালি খুঁড়ে। মিলেছে জিপসামের প্রলেপ দেওয়া ‍চুনাপাথরের কলস, ঢাকনা। আরও পাওয়া গেছে ব্রোঞ্জ নির্মিত চাইনিজ ও স্থানীয় মুদ্রা। আরবি হরফ খোদিত সিলভার মুদ্রাও পাওয়া গেছে কিছু।

১৬০ মিটার দীর্ঘ আর ১২০ মিটার প্রস্থের বেড়ে হারিয়ে যাওয়া এসব ভবনে আরও মিলেছে ইসলামী যুগের শেষ সময়ের অনেক নিদর্শন। এগুলো ১৪৪০ থেকে ১৬৪০ সালের মধ্যবর্তী সময়ের ইতিহাসেরও সাক্ষী বটে।

বয়সী গাছে এখন ভার ভার ভাব। শাখাগুলো অনেকটাই যেনো নুয়ে পড়ে কুর্নিশ করছে মরুভূমিকে। লম্বা এক ডালের নিচে ঠেক দিয়ে রাখা।

মরুর মাটির সঙ্গে আনুভূমিকভাবে বিস্তৃত ডালে বসে যেনো গাছেরই আদর আর পরশ মাখছে শিশু আর নারীরা। এখানে বসলে অদ্ভূত সুন্দর রূপ নিয়ে চোখে ধরা দেয় মরুভূমি।

বাংলাদেশের এক সামাজিক আচরণের সঙ্গে এখানে আসা নানা দেশের মানুষের অভ্যাসগত এক মিল চোখে পড়ে হঠাৎ। লম্বা ডালের বিভিন্ন স্থানে মার্কারের লাল দাগ। গাছের গোড়ায় ছাল কেটে নাম লেখা। বিশেষত ইংরেজি আর আরবি। কোথাওবা প্লাস চিহ্ন দিয়ে দু’টি নাম। এক স্থানে তো ইংরেজিতে ‘আই লাভ ইউ’ কথাটাই লিখে দেওয়া।

বাংলায় কিছু একটা লিখে দেওয়ার লোভ সামলে ঘুরে দাঁড়াই।

ইঞ্জিনিয়ার জাহাঙ্গীর তরফদার আর ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক সরকার এনাম এলেন সপরিবারে। ইঞ্জিনিয়ার জাহাঙ্গীরের সহধর্মিনী শামীমা নাসরিন রুমা এখানকার বাংলাদেশ স্কুলে সমাজবিজ্ঞান পড়ান। তাদের ছেলে দেওয়ান জাহাঙ্গীর তামিম ও মেয়ে সারা জাহাঙ্গীর ওই স্কুলেরই চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। এনামের স্ত্রী রিনা সুলতানা গৃহিণী। তাদের ছেলে মুশফিক আহমেদ সরকার তাহসিন। মেয়ে তাবাসসুম এনাম স্কুলে যাবে এ বছরই। বাংলানিউজের বাহরাইন করেসপন্ডেন্ট মোসাদ্দেক হোসেন সাইফুলের সহধর্মিনী মাহমুদা আক্তার লাভলী। তাদের একমাত্র মেয়ে ফারাহ বিনতে সাইফুল পুষ্পিতাও এ বছর স্কুলে ভর্তি হবে।

শেষ পর্যন্ত আমরা পরিণত হলাম ৫ জন শিশু, ৩ জন নারী আর ৪ জন পুরুষের মিশ্র কাফেলায়। পরবর্তী গন্তব্য তেল জাদুঘরটাও এই মরুভূমিরই বুকে।  

বাংলাদেশ সময়: ১১৪৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৬, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বাহরাইন এর সর্বশেষ