বাহরাইন ঘুরে: বাহরাইনে নানা সমস্যায় খাবি খাচ্ছে বাংলাদেশের শ্রমিকরা। লাখ লাখ টাকা খরচ করে পারস্য উপসাগরের এই দ্বীপরাষ্ট্রে গিয়ে স্বপ্ন পুড়ছে তাদের।
কর্মক্ষেত্রে নিগৃহীত হওয়ার ঘটনা যেমন হরহামেশা ঘটছে, তেমনি বিভিন্ন অপরাধেও জড়িয়ে পড়ছেন বাংলাদেশিরা। বিপুল অঙ্কের টাকা খরচ করে বাহরাইন যাওয়ার পর সেই খরচের টাকা তুলতেই কেটে যাচ্ছে বছরের পর বছর।
সম্প্রতি এমন সব সমস্যার একটি তালিকা তৈরি করেছে বাহরাইনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস। বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল কে এম মোমিনুর রহমান ছাড়াও শ্রম কাউন্সেলর মহিদুল ইসলামের মতো চৌকস কূটনীতিকদের অব্যাহত প্রচেষ্টায় ৩০ ক্যাটাগরিতে ভাগ করে সব সমস্যাই তুলে আনা হয়েছে তালিকায়।
এখন দেশটির নীতি নীর্ধারণী মহলসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তর ও বাংলাদেশিদের কর্মক্ষেত্রের নিয়ন্ত্রকদের কাছে এই তালিকা দিয়ে সব সমস্যার আশু সমাধানের তাগিদ দিচ্ছে বাংলাদেশ দূতাবাস।
এসব সমস্যার মধ্যে রয়েছে- প্রত্যেক কর্মীকে বাহরাইনে আসার আগে ৪ থেকে ৫ হাজার ডলার (৩ থেকে ৪ লাখ টাকা) পরিশোধ করতে হচ্ছে। কিন্তু অনেক নিয়োগ কর্তা ভিসা বাতিল করায় বাহরাইন বিমানবন্দর থেকেই অনেককে ফিরে যেতে হচ্ছে। কর্মীরা ছুটিতে দেশে যাওয়ার পর ভিসা বাতিল হওয়ার ঘটনাও ঘটছে হরহামেশা।
বাহরাইনে বেআইনি হলেও অনেক নিয়োগ কর্তা বা দালাল ভিসা নিয়ে রাখছেন। বহু দালাল অভিবাসী শ্রমিকের কাগজপত্র নিয়েই বাহরাইন ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। ফলে লক্ষ টাকা খরচ করে আসা শ্রমিকের কাছে কোন কাগজপত্রই থাকছে না। কর্মী আনার দু’তিন মাসের মধ্যে অনেক নিয়োগকর্তা নিয়োগ বাতিল করে দিচ্ছেন। ফলে বৈধ শ্রমিক হয়ে পড়ছেন অবৈধ।
পাসপোর্ট আটকে রেখে টাকা করছেন অনেক নিয়োগ কর্তা। চুক্তির নিয়ম ভেঙ্গে দিচেছন না বেতন ও ওভারটাইম।
কর্মীদের পলাতক দেখানোও বাহরাইনে নিত্যকার ঘটনা। নিজের কোম্পানি লাভজনক না হলে কর্মীকে অন্যত্র কাজ করতে পাঠান নিয়োগকর্তা। একই সঙ্গে কর্মীর অজ্ঞাতসারে তাকে অবৈধ বলে রিপোর্ট করে দেন।
বৈধতার লোভ দেখিয়ে অনেক শ্রমিককেই বিনা পয়সায় খাটানো হয় মাসের পর মাস। অবৈধ হওয়ায় তারা আইনের আশ্রয়ও নিতে পারেন না। এভাবে চার পাঁচ মাসের বেতন না দিয়ে কাজ করানোর ঘটনা ক্রমাগত বাড়ছে। অনেকক্ষেত্রেই অবৈধ শ্রমিকদের বিরতিহীন ৩৬ ঘণ্টাও কাজ করানো হচ্ছে বিনা পয়সায়।
বেতনভাতা, ওভারটাইম, বাসস্থান, রান্নাঘর, টয়লেটে বাংলাদেশিদের প্রতি বৈষম্য প্রকট। নিয়ম থাকলেও কর্মীদের নিয়োগ কর্তা পরিবর্তনের সুযোগ দেওয়া হয় না। কর্মীরা যে টাকা খরচ করে বাহরাইনে আসেন তা উপার্জনের আগেই অনেককে পালিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়।
হালে শ্রমিকদের শারীরিক নির্যাতনের মাত্রাও বেশ বেড়ে গেছে। সম্প্রতি মিলেছে ৬০ বছরের কর্মীকে শারীরিক নির্যাতনের প্রমাণও।
দশ বছর কাজ করে ভিসা নবায়ন না হওয়ার ঘটনা যেমন ঘটছে, তেমনি বেতন না দিয়ে জোর করে কর্মীদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে দেশে।
অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশি কর্মীদের চিকিৎসা সহায়তা দেওয়া হচ্ছে না। চুরির মিথ্যা অভিযোগ তুলে নির্ধারিত ন্যুনতম মজুরি থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। ছোটখাট ভুলে কেটে নেওয়া হচ্ছে বেতনের ষাট ভাগ।
অনেক কারখানাতে তিন/চার বছর কাজ করার পরও প্রাপ্য ছুটি দিতে চান না মালিকরা। বাহরাইনে আসার পর তিন/চার মাসেও বেতন না পেয়ে মূল নিয়োগ কর্তাকে ছেড়ে অনেক কর্মীই চলে যান।
ভিসার মেয়াদ দেড় থেকে দু’বছর বাকি থাকতেই অনেককে জোর করে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
সব মিলিয়ে বাহরাইনে বাংলাদেশি শ্রমিকদের প্রতি অবিচার বাড়ছে। সিস্টেমের ভেতরেই বাড়ছে শ্রমিক নিগ্রহ। অবৈধরা অপরাধ, অসামাজিক ও বেআইনি কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন। এখানে অবৈধ শ্রমিকরাই সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলো করে থাকেন। কাজের চাপ ও দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর হার তাই বাংলাদেশিদেরই বেশি।
সাদাকাগজে স্বাক্ষর ও টিপসই নিয়ে শ্রমিককে বঞ্চিত করার ঘটনাও বেশ ঘটছে এখন। অধিকারের কথা তুললে হতে হচ্ছে হয়রানি ও হেনস্থার শিকার।
এমন পরিস্থিতি বাহরাইনে অবৈধ অভিবাসী যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে দেশে ফেরার অনিশ্চয়তাও। অনেক অবৈধ অভিবাসীরই অনেক বছর ধরেই পাসপোর্ট নেই। তারা বাহরাইনে আটকে পড়েছেন। এদের অনেকেই অবিভাবক, স্ত্রী, সন্ত্রান ও সম্পর্ক হারিয়েছেন। কিন্তু দেশে ফিরতে পারেননি। এমন অনিশ্চয়তায় কেউ কেউ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছেন।
এসব সমস্যার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে রাষ্ট্রদূত কেএম মমিনুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, এখানে হাজার হাজার লোক প্রতারিত হচ্ছেন। আমি গত ৫ মাসে ১৫ হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের সমস্যাগুলো জেনেছি।
দীর্ঘ প্রচেষ্টায় সমস্যাগুলো মোটামুটি চিহ্নিত করা গেছে জানিয়ে রাষ্ট্রদূত বলেন, একটা সময় ছিলো যখন প্রতিদিন কান্না শুনে আমার দিন শুরু হতো। দিন শেষও হতো কান্না দিয়ে। এখন পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করেছে।
শ্রম কাউন্সেলর মহিদুল ইসলাম বলেন, এখানে বাংলাদেশি কর্মীদের কাগজপত্র সত্যায়ন করতে হয়, যা অন্য কোনো দেশের কর্মীদের করতে হয় না। অন্য দেশের কর্মীরা ১৮ বছরে এখানে আসার সুযোগ পেলেও আমাদের দেশের বেলায় ২৫ বছরের নিচে কাউকে আসতে দেওয়া হয় না।
তিনি বলেন, ফ্রি ভিসায় আনার পর অনেককে ছেড়ে দেওয়া হয়। তাদের পাসপোর্ট ফেরত দেওয়া হয় না। ছুটিও দেওয়া হয় না। স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও পুলিশ ভেরিফিকেশনেও আমাদের দেশের কর্মীরা অনেক হয়রানির শিকার হন।
আহলি ইউনাইটেড ব্যাংকের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর সাফকাত আনোয়ার বলেন, বাংলাদেশি শ্রমিকরা এতো খরচ করে আসে, অথচো ভালো চাকরি হয় না। আসার খরচ তুলতেই ৩ থেকে ৫ বছর লেগে যায়। আর যারা অবৈধ হয়ে যায় তাদের তো দুর্দশার অন্ত থাকে না।
বাংলাদেশ সমাজ সভাপতি ফজলুর করিম বাবলু বলেন, উন্নত জীবনের সন্ধানে এসে এখানে অনেক বাংলাদেশিই সমস্যায় পড়ছেন। দীর্ঘ দিন ধরে জমতে জমতে এসব সমস্যা বাংলাদেশিদের বুকে জদদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছে।
ন্যাশনাল ফিশ ও প্যাসিফিক গ্রুপ এর এমডি মো. সফি উদ্দিন বলেন, এখানে বাংলাদেশিদের সমস্যা অনেক। দীর্ঘদিন ধরে এসব সমস্যা তৈরি জমেছে। যে স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ এখানে আসছেন সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।
বাংলাদেশ সময়: ১২৪৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৫