বাহরাইন ঘুরে: সম্প্রতি এক স্বদেশিকে খুন করে লাশ টুকরো টুকরো সরে সুটকেসে ভরে রেখেছিলেন দুই বাংলাদেশি। বছর কয় আগে রাজপরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত এক আরবির ঘাড়ে ড্রিল মেশিনের আস্ত ডগাটাই সেঁধিয়ে দিয়েছিলেন আর এক মাথাগরম বাংলাদেশি তরুণ।
আরো সব এমনতরো ঘটনায় ভাবমূর্তিটাই ধসে গেছে বাহরাইন প্রবাসী বাংলাদেশিদের। পারস্য উপসাগরের এই দ্বীপরাষ্ট্রের কোথাও কোনো অপরাধ হলেই এখন তাই সন্দেহের তীরটা আগে বাংলাদেশিদের দিকেই ছোটে।
হত্যা, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি, মাদক পাচার আর অবৈধ অনুপ্রবেশ ছাড়াও মদ খেয়ে মাতলামি, প্রকাশ্যে জুয়া খেলা ও ছিনতাইয়ের মতো ছিঁচকে অপরাধেও এখন জড়িয়ে আছে বাংলাদেশিদের নাম।
সম্প্রতি জাতীয় সংসদের এক প্রশ্নোত্তর পর্বে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রবাসী অপরাধীদের যে বিবরণ দিয়েছেন তাতে বাহরাইনের নামও আছে। তিনি জানিয়েছেন, বাহরাইনে এরইমধ্যে হত্যা মামলায় মৃতদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন এক বাংলাদেশি। হত্যা মামলা চলছে আরো এক বাংলাদেশির বিপক্ষে। অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে আটক আছেন ৪৬ বাংলাদেশি।
ঠিকঠাক হিসাব কষলে অপরাধীর এই সংখ্যাটা আরো বাড়বে বলেই মনে করে বাহরাইন প্রবাসী বাংলাদেশি কমিউনিটি।
সব মিলিয়ে তাই বাংলাদেশ দূতাবাস তো বটেই, উদ্বিগ্ন বাহরাইনের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লেফটেন্যান্ট জেনারেল শেখ রাশিদ বিন আবদুল্লা আল খলিফা। সম্প্রতি বাহরাইনে নিযুক্ত বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল কে এম মমিনুর রহমানের সঙ্গে এক বৈঠকে তার উদ্বেগের কথা প্রকাশও করেছেন তিনি।
এ সময় তিনি বাংলাদেশিদের কিছু অপরাধের চিত্র রাষ্ট্রদূতের কাছে তুলে ধরে বলেন, বাংলাদেশিরা সামান্য বিষয় নিয়ে একে অপরের সঙ্গে মারামারি, এমনকি হত্যার মতো অপরাধ করতেও দ্বিধা করে না। এই প্রবণতা বাহরাইনের নিরাপত্তা পরিস্থিতি বিনষ্ট করছে।
জবাবে অপরাধীদের চিহ্নিত করে আইনের হাতে সোর্পদ করার প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করেছেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূত।
কিন্তু অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন কাজই বটে। কেননা, বাহরাইনে যেসব বাংলাদেশি বিভিন্ন অপরাধে জড়াচ্ছেন তারা মূলত অবৈধ অভিবাসী। আর এ সংখ্যাটা কিছুতেই ৪০ হাজারের কম না।
কোনো অপরাধ করেই গা ঢাকা দেয় তারা। আর অবৈধ হওয়ায় তাদের তাদের খুঁজে পাওয়া মুশকিলই হয়।
ঠিক এই সুবিধাটুকুই কাজে লাগায় অবৈধ অভিবাসীরা। আর বাংলাদেশি অবৈধ অভিবাসীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় অপরাধকর্মে তারাই থাকে এগিয়ে। যেহেতু অবৈধদের কাজ পাওয়া কঠিন, তাই যে কোনো উপায়ে উপার্জনের জন্য মরিয়া থাকে তারা। এমনকি অপরাধের সুযোগও লুফে নেয়। আর তাদের কাজে লাগায় প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে থাকা ক্ষমতাধর অপরাধী হোতাদের সিন্ডিকেট।
এ প্রসঙ্গে বাহরাইনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্টদূত মেজর জেনারেল কেএম মমিনুর রহমান বলেন, অন্যায়কারীরা এখানে শক্তিশালী।
তবে যতোই শক্তিশালী হোক না কেনো, বাংলাদেশিদের অপরাধ কমিয়ে আনতে চেষ্টার অন্ত নেই বাহরাইনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের। তাই নিয়মিত হচ্ছে ওপেন হাউস ডিসকাসশন। কি করা যাবে আর কি করা যাবে না তা বুঝাতেও চেষ্টার কমতি নেই দূতাবাসে। তবে অনেক ক্ষেত্রেই অতিরিক্ত আবেগ অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সমাজ সভাপতি ফজলুর করিম বাবলু বাংলানিউজকে বলেন, বাংলাদেশিরা আবেগি। কর্মহীন অবস্থায় এসে তাই সহজেই অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। ভিসার দালালি করে। এক বাংলাদেশি আর এক বাংলাদেশিকে খুন করে। আমাদের রাষ্ট্রদূত চেষ্টা করছেন বাংলাদেশের ইমেজ ফেরাতে।
আহলি ইউনাইটেড ব্যাংকের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর সাফকাত আনোয়ার বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশি শান্তিপ্রিয়। পরিশ্রমী। বুদ্ধিমত্তার কারণে স্পন্সররা বাংলাদেশিদের পছন্দও করে। কিন্তু কিছু লোকের কারণে গোটা কমিউনিটি সাফার করছে।
২৫ বছর ধরে বাহরাইন বাসের অভিজ্ঞতার ঝাঁপি খুলে লিন্নাস গ্রুপের চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদিন বলেন, বাংলাদেশের কর্মীরা রাস্তায় মারামারি করে। মদ খেয়ে প্রকাশ্যে মাতলামি করে। যে কোনো জায়গায় জুয়া খেলতে বসে যায়। বাংলাদেশের মতোই এখানেও রাস্তা দখল করে করে ব্যবসা করে।
টাকা উদ্ধারের নাটক সাজিয়ে কাউকে মারপিট ও চাঁদাবাজির কথা শুনেছেন জানিয়ে জয়নাল আবেদিন আরো বলেন, দেশ থেকে কোন অপরাধী যাতে বিদেশে না আসতে পারে। কারণ, তারা এখানে এসেও অপরাধেই জড়িয়ে পড়ে।
বাহরাইনের ন্যাশনাল ফিশ ও প্যাসিফিক কোম্পানির এমডি মো. শফি উদ্দিন বলেন, এখানে ওরা আইন মানতে চায় না। তবে দুষ্টু লোক সব জায়গাতেই আছে। যে কোনো ভাবে তাদের কন্ট্রোল করতে হবে।
বাংলাদেশ স্কুল অ্যান্ড কলেজ বাহরাইনের চেয়ারম্যান কেফায়েত উল্যাহ মোল্লা বলেন, অবৈধদের মনিটরিং করা যায় না। অপরাধ করে গা ঢাকা দিলে তাদের খুঁজে পাওয়া যায় মুশকিল। তাই অবৈধদের অপরাধ বেশি।
তিনি বলেন, প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা ছাড়া কেউ এলে প্রথমে কাজ জোটে না, কিন্তু বন্ধু জোগাড় হয়। তারপর অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। অনেকে দেশে অপরাধ করে বিদেশে চলে আসে। এখানেও তারা অপরাধই করে।
অপরাধকারীরা যাতে বিদেশ আসতে না পারে সে ব্যাপারে সে ব্যাপারে সরকারকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, সবাইকে সুনির্দিষ্ট কর্মের ওপর প্রশিক্ষণ দিয়ে পাঠানো উচিত। প্রফেশনালরা এলে অপরাধ প্রবণতা কমে যাবে।
বাহরাইন বিএনপির সভাপতি প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর তরফদার বাংলানিউজকে বলেন, অবৈধরাই এখানে বেশি অপরাধে জড়ায়। আর অপরাধ ও অপকর্ম থেকে তাদের রেহাই পাইয়ে দিতে একটা দালাল শ্রেণীও কাজ করছে। তারাই সবকিছু ম্যানেজ করে।
জাহাঙ্গীর বলেন, বেকার থাকতে থাকতে অবৈধ অভিবাসীরাও অপরাধের পথে পা বাড়ায়। এতে দেশের সুনাম নষ্ট হয়।
তবে কিছুটা ভিন্নমত পোষণ করে বাহরাইন আওয়ামী লীগ সেক্রেটারি ও ফিন্যান্স কোম্পানি জেনজ এক্সচেঞ্জ এর মার্কেটিং অ্যাণ্ড ফিন্যান্স কর্মকর্তা একেএম গোলাম নূর মিলন বলেন, বাংলাদেশি অপরাধী যারা ছিলো তাদের অধিকাংশই জেলে। কিছু বাইরে আছে। তারাই অপরাধ করে।
টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ার নাসিম আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, অবৈধরা এখানে অনেক বেশি অপরাধে জড়িত। আর কালপ্রিটরাই এখানে লিড রোল প্লে করে।
নাসিম আরো বলেন, এখানে ইন্ডিয়ানরাও ড্রিঙ্ক কিরে, কিন্তু ঘরে বসে। আর আমাদের ভাইয়েরা রাস্তায় এসে মাতলামি করে। মানামার বাঙালি গলিতে এমন সব চিটিং হয় যা বিদেশের মাটিতে কখনো আশাই করা যায় না।
বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম কাউন্সেলর মহিদুল ইসলাম বলেন, ২০০৭ ও ২০০৮ সালে এখানে চারজন স্থানীয় খুন হন। তিনটিতেই জড়িত ছিলো বাংলাদেশিরা। এর মধ্যে এক কর্নেল এর মেয়ে ছিলো। আরো ছিলো রাজপরিবারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এক ব্যক্তি। তার গলায় ড্রিল মেশিন ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিলো।
তবে আগের চেয়ে অপরাধ অনেক কমে গেছে দাবি করে মহিদুল ইসলাম বলেন, আমরা মোটিভেশন চালিয়ে যাচ্ছি। ওপেন হাউস ডিসকাসশন হচ্ছে। অনবরত বলে যাচ্ছি- এটা করো না। ওটা করো না। এতে কাজও হচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৫