বাহরাইন ঘুরে: ‘যতো দোষ নন্দ ঘোষ’ বলে বাংলায় বহুল প্রচলিত প্রবাদটিরই যেনো স্বার্থক প্রয়োগ ঘটছে বাহরাইন প্রবাসী বাংলাদেশিদের কপালে। নিজেদের দোষ কিছুটা থাকলেও নিকট ও দূর প্রতিবেশীদের নানামুখী ষড়যন্ত্র, অপপ্রচার আর অপবাদে প্রতিনিয়তই বিব্রত হচ্ছেন বাংলাদেশিরা।
প্রবাসী বাংলাদেশ কমিউনিটির সঙ্গে কথা বলে পাওয়া এই অভিযোগের সত্যতা মিলেছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন ভাষার খবরের কাগজগুলোতে।
ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপাল বা ফিলিপাইনের কারো অপরাধের খবর কোনো পত্রিকায় প্রকাশ পেলে অপরাধীর পরিচয় লেখা হচ্ছে এশিয়ান। আর বাংলাদেশিদে ক্ষেত্রে সরাসরি লেখা হচ্ছে বাংলাদেশেরই নাম। এমনকি অন্য কোনো দেশের লোক অপরাধ করলেও প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশি বলে তার পরিচয় ছাপা হচ্ছে পত্রিকায়।
বাংলাদেশিদের ছোটখাটো অপরাধও প্রচার করা হচ্ছে ফলাও করে। আর চেপে যাওয়া হচ্ছে অন্যদেশের অপরাধ। ফলে মধ্যপ্রাচ্যের সরকারগুলোর কাছে বাংলাদেশি কর্মী সম্পর্কে তৈরি হচ্ছে নেতিবাচক ধারণা।
উপরন্তু, কি কারণে কে জানে পাকিস্তানিরা তাদের অপরাধের দায় বাংলাদেশিদের কাঁধে চাপাতেই ব্যস্ত থাকে। পুলিশ ও প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে এবং বাহরাইনের আইন-শৃঙ্খলার নিয়ন্ত্রক মিনিস্ট্রি অব ইন্টেরিয়রে (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) অনেক উচ্চ পদ দখলে আছে পাকিস্তানিদের। ওই সব পদের প্রভাব খাটিয়ে বাংলাদেশিদের চরিত্রহননে তক্কে তক্কে থাকে তারা।
সব কিছু মিলিয়ে তাই এমন বাংলাদেশ বিরোধী আচরণে বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচার আর ষড়যন্ত্রের ছায়াই দেখছেন ভাগ্যান্বেষী বাংলাদেশিরা।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম কাউন্সেলর মহিদুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশিরা নয়, অন্যদেশিরাই বেশি অপরাধ করে। আর এখন তো বাংলাদেশের অপরাধ অনেক কমে গেছে।
আহলি ইউনাইটেড ব্যাংকের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর সাফকাত আনোয়ার বলেন, এখানে বাংলাদেশি অপরাধী ২/৩ শতাংশের বেশি হবে না। কিন্তু বলা হয় সব অপরাধের সঙ্গেই বাংলাদেশিরা জড়িত। তারা উচ্ছৃঙ্খল, অপরাধ প্রবণ।
এমন বক্তব্যকে সুনজরের অভাব বলেই মনে করেন সাফকাত আনোয়ার।
আড়াই দশক ধরে বাহরাইনে বসবাস ও ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতার ঝাঁপি খুলে লিন্নাস গ্রুপের চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদিন বলেন, বাংলাদেশের কর্মীরা ক্রাইম করে বটে, কিন্তু যতোটা বেশি প্রচার হচ্ছে ততোটা না।
মানুষ হত্যার মতো অপরাধ পাকস্তানিরা বেশি করে জানিয়ে জয়নাল আবেদিন বলেন, তাদেরটা তেমন প্রচার পায় না। ভারতের কেউ ক্রাইম করলে বলে এশিয়ান। বাংলাদেশের কেউ করলে সেটা বাংলাদেশি নামেই যায়। এমন ঘটনা দুবাই-কুয়েতেও আছে।
বাহরাইন আওয়ামী লীগ সেক্রেটারি ও ফিন্যান্স কোম্পানি জেনজ এক্সচেঞ্জ এর মার্কেটিং অ্যাণ্ড পাবলিক রিলেশন্স অফিসার একেএম গোলাম নূর মিলন বলেন, বাংলাদেশি অপরাধী যারা ছিলো তাদের অধিকাংশই জেলে। কিন্তু বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার বেশি। এখানকার পত্রিকাতে অন্য কোনো দেশের কেউ অপরাধ করলে এশিয়ান লেখা হয়। আর বাংলাদেশেরটা বাংলাদেশের নামেই প্রকাশ হয়।
বাহরাইন বিএনপি সভাপতি জাহাঙ্গীর তরফদার বলেন, যতো দোষ করে বাংলাদেশিদের ঘাড়ে তার চেয়েও বেশি চাপানো হয়। কোথাও কোনো অপরাধ করলে আগে সন্দেহ করা হয় বাংলাদেশিদের। কিন্তু পরে প্রমাণ হয়, ঘটনার সঙ্গে আদৌ কোনো বাংলাদেশির কোনো সম্পর্ক নেই।
বাহরাইনের এক বিপণন প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় কর্মী মোহাম্মদ আইয়ুব বাংলানিউজকে বলেন, আমরা মিডিয়া সন্ত্রাসের শিকার। ভারত-পাকিস্তানের নাগরিকরা আমাদের নামে দুর্নাম রটায়। তাদের অপরাধের দায় আসে আমাদের কাঁধে।
টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ার নাসিম আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, বাহরাইনে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশিদের ওরা নোংরা ভাবে। এই অপমানটা মাথায় নিয়েই এখানে কাজ করতে হয়। এটা সামাজিকভাবে একটা বিরাট প্রবলেম।
বাহরাইন আওয়ামী যুবলীগ সভাপতি এমএ করিম বলেন, এটা বাংলাদেশিদের বিরু্দ্ধে অপপ্রচার। ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, শ্রীলংকা অপরাধ করলে বলে এশিয়ান। আর বাংলাদেশের হলে বলে বাংলাদেশি।
তিনি বলেন, ধান্ধাবাজিতে পাকিস্তানিরা সেরা। সরকারের উচ্চপর্যায়ে তাদের লোক আছে। ইন্টেরিয়র মিনিস্ট্রিতেও তাদের লোক আছে। তারা বাংলাদেশিদের ভাবমূর্তি নষ্টের জন্য তক্কে তক্কে থাকে। বিভিন্ন অপরাধে বাংলাদেশিদের নাম ঢুকিয়ে দেয়।
ল্যান্ড সার্ভেয়ার খোরশেদ আলম বলেন, এখানে মিড়িয়াগুলোতে ভারতীয় অনেক সাংবাদিক এবং প্রশাসনে, বিশেষ করে পুলিশে পাকিস্তানি লোকজন থাকায় বাংলাদেশিদের ছোট ছোট অনেক অপরাধ বিশেষভাবে প্রচার পায়। একই ধরনের অপরাধ তাদের দেশের নাগরিকরা করলে কেউ জানতেও পারে না।
বাংলাদেশ সময়: ২০৪৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৫