ঢাকা, মঙ্গলবার, ২০ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বাজেট

সাধারণের বাজেট প্রতিক্রিয়া

জিনিসপত্রের যে দাম, নতুন করে বাড়লে কী-ই বা হবে?

সুব্রত চন্দ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১০৪ ঘণ্টা, জুন ১, ২০২৩
জিনিসপত্রের যে দাম, নতুন করে বাড়লে কী-ই বা হবে?

ঢাকা: জাতীয় সংসদে বাজেট প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের আকার হচ্ছে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা।

জিডিপির মোট আকার নির্ধারণ করা হচ্ছে ৫০ লাখ ৬ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাজেটে ঘাটতি ঠিক করা হয়েছে দুই লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫ দশমিক ২ শতাংশ। এ ঘাটতি চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ৩৪ হাজার ২৭৮ কোটি এবং চলতি বছরের মূল বাজেটের চেয়ে বেশি ১৬ হাজার ৭২১ কোটি টাকা বেশি।

বাজেটে অনেক কিছুর দাম বাড়ছে, কমছেও অনেক কিছুর। কিন্তু তার আগেই নিত্য প্রয়োজনীয় প্রায় সব কিছুরই দাম দ্বিগুণ হয়েছে। গত এক বছরে এ হার অনেক বেশি। তাই এবার বাজেটে কিসের বাড়লো, কিসের কমলো সেটা নিয়ে মানুষের মাথা ব্যথা নেই। সাধারণ জনগণ নিজেদের প্রতিক্রিয়ায় বলছেন, এমনিতেই প্রতিটি জিনিসের দাম বেশি। বাজেটে আর নতুন করে বাড়লে কী-ই বা হবে? জিনিসপত্রের দাম বাড়বে না কমবে সে দিকে তাদের নজর নেই। কারণ, সবাই-ই জানে বাজেটে যাই হোক, জিনিসপত্রের দাম প্রতিনিয়ত বাড়বেই।

বৃহস্পতিবার (১ জুন) সন্ধ্যায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় রাজধানীর মগবাজার নয়াটোলা এলাকার বেশ কয়েকজন সাধারণের কাছে। এর মধ্যে মুদি দোকানদার, সরকারি চাকরিজীবী, আইনজীবী, শিক্ষার্থীও রয়েছেন।

মো. আনোয়ার হোসেন রিপন নামে নয়াটোলা বাজারের এক মুদি দোকানি বলেন, বাজেট ছাড়াই তো প্রতিটি জিনিসের দাম বেড়েছে। বাজেটে নতুন করে আর কী বাড়বে? যে চিনি ছিল ৬০ টাকা, সেটি হয়েছে ১৪০ টাকা। তেল ছিল ১১০ টাকা, সেটি ২০০ টাকা লিটার। তাহলে আর বাজেটে কি বাড়বে? বাজেট ছাড়াই তো প্রতিটি জিনিসের দাম বেশি। এই বাজেটে মানুষের কোনো লাভ নেই।

এর আগে বিকেল ৩টায় জাতীয় সংসদে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপনায় দেখা গেছে কিছু পণ্যে আয়কর, শুল্ক, ভ্যাট অথবা সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। ফলে আগামীতে বাড়তে পারে লেখার কলম থেকে শুরু করে ফেসিয়াল টিস্যু, টয়লেট টিস্যু, সিমেন্ট, কাজু বাদাম, বাসমতী চাল, চশমা, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, এলপি গ্যাস সিলিন্ডার, প্লাস্টিকের পাত্র, অ্যালুমিনিয়ামের তৈজসপত্র, সিগারেট, জর্দা-গুল, খেজুর, বিদেশি টাইলস ও মোবাইল ফোনসহ বেশকিছু নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য।

আবার জনস্বার্থে ও দেশি শিল্প সুরক্ষায় কিছু পণ্যের ভ্যাট, আমদানি শুল্ক, আগাম কর অথবা সম্পূরক শুল্কে ছাড় দেওয়া হয়েছে। ফলে কমতে পারে মাংস ও মাংসজাত পণ্য, দেশিয় বৈদ্যুতিক এলইডি বাল্ব ও সুইচ-সকেট, মিষ্টি জাতীয় পণ্য, ই-কমার্সের ডেলিভারি চার্জ, স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদিত কৃষি যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রপাতি তৈরির সরঞ্জাম, সফটওয়্যার, ফ্রিজ, রেফ্রিজারেটর, অভিজাত বিদেশি পোশাকের দাম।

বাজেট প্রস্তাবের পর জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি ও কমার বিষয়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানতে চায় বাংলানিউজ। তাদের বেশিরভাগই বলছেন, এবারের বাজেট জনবান্ধব হয়নি। যেমনটি বলেছেন নয়াটোলা বাজারের এক মুদি দোকানি রিপন।

এ ছাড়া কথা হয় আহসান উল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মঈন হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, এ বাজেট আমাদের সাধারণ মানুষ ও শিক্ষার্থীদের জন্য অবশ্যই সমালোচনা করার মতো। কারণ, আমরা যেসব শিক্ষার্থীরা ঢাকায় ব্যাচেলর থাকি তাদের জন্য ডিম দিয়ে ভাত খাওয়াও কষ্টকর। বিলাসী পণ্যের কথা বলাও ঠিক নয়, কেননা সবকিছুরই দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা যেটাকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য বলছি, পুরোটাই আমাদের সামর্থ্যের বাইরে।

গত মাসে আমি কতবার মুরগি বা অন্য কোনো মাংস খেয়েছি বলতে পারবো না। কারণ, এটা আমার বাজেটের বাইরে। আমি মনে করি, সরকারের উচিত ছিল নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের কথা চিন্তা করে একটি বাজেট তৈরি করা। মধ্যবিত্ত যদি বেঁচে থাকে তাহলে দেশও টিকে থাকবে। এটি মোটেই জনবান্ধব বাজেট হয়নি।

সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের গাড়ি চালক আবুল হোসেনও বললেন, বাজেট জনগণের জন্য হয়নি। বর্তমানে বাজারে নিত্যপণ্যের যে ঊর্ধ্বগতি, আমরা সাধারণ মানুষ কুলিয়ে উঠতে পারছি না। বাজেটে এসব ব্যাপারে নজর দেওয়া হয়নি। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমার দিকে যদি সরকার নজর দেয় তাহলে আমাদের জন্য ভালো হয়।

জজ কোর্টের আইনজীবী মিতুল ভৌমিক বলেন, গ্যাস সিলিন্ডার তৈরির উপকরণের দাম বাড়লে ভোক্তা পর্যায়েও গ্যাসের দাম বাড়বে। তখন মাংসের দাম কমলে আসলে লাভ কতটা হবে? মানুষ মাংস কিনতে পারলেও রান্না কি করতে পারবে? এমনিতেই আমাদের সাধারণ মানুষের টিকে থাকতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। একটু ভালো থাকতে কিছু করার সুযোগ নেই। সেখানে এমন বাজেট নিয়ে আমি হতাশ। এটি জনবান্ধব বাজেট হয়নি।

বেসরকারি চাকরিজীবী আকাশ দেওয়ান বলেন, বাজেটটি জনবান্ধব নয়। এটি পাস হলে জনগণের পকেট থেকেই বেশি যাবে। যেটা আমাদের জন্য ক্ষতি। এমনিতেই বর্তমানে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের যে অবস্থা, তাতেই আমাদের চলতে কষ্ট হয়ে যায়। বাজেটে যদি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমার বিষয়ে প্রস্তাবনা থাকতো তাহলে সেটি সাধারণ মানুষের জন্য ভালো হতো।

রিক্সা চালক চাঁন মিয়া বলেন, আলু-পেঁয়াজসহ সব কিসুর দাম বাড়তি। এইডা তো আমাগো লাইগা খারাপ। ৫০০ টাকা আয় করলে ৩০০-৪০০ টাকা খরচ যায়গা। আমরা চলুম কেমনে? বাজেট দিয়াই বা কি করমু যদি পকেটে ট্যাকাই না থাকে? বাজেট যাই হোক, চাইলের দাম ৫০ আলুর দাম ২০ ট্যাকা থাকা উচিত।

অনলাইনভিত্তিক খাবার সরবরাহকারী একটি প্রতিষ্ঠানের ডেলিভারি পারসন মারুফ সরকার বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এটা ভালো বাজেট হয়নি। কারণ, বাজেটে সাধারণ শ্রমজীবীদের দিকে নজর দেওয়া হয়নি। শুধু দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ানো হচ্ছে। এতে নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা বিপাকে পড়ছে। বাজেটে বিভিন্ন জিনিসের দাম বাড়ার যে শঙ্কা দেখা দিয়েছে, এটি খারাপ হয়েছে।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট স্বাধীন বাংলাদেশের ৫২তম বাজেট। বর্তমান সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদ ও  অর্থমন্ত্রী হিসেবে আ হ ম মুস্তফা কামালের পঞ্চম বাজেট। জাতীয় সংসদে তিনি প্রস্তাবের সময় বলেছিলেন, এবারের বাজেটের মূল দর্শন হলো ২০৪১ সালের মধ্যে সুখী-সমৃদ্ধ উন্নত স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ। যুদ্ধ ও মহামারি আক্রান্ত অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়ন, নির্বাচনী বছরের চাপ, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখা, রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি, বাজেট ঘাটতির অর্থায়ন, উন্নয়ন কর্মসূচি চলমান রাখাসহ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার মতো নানামুখী চাপের মধ্যে এই স্মার্ট ইকোনমির বাজেট প্রণয়ন করতে যাচ্ছে সরকার।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট হবে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে প্রথম বাজেট। এবারের বাজেটে সঙ্গত কারণেই স্বাস্থ্য, কৃষি, খাদ্য উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। অর্থবছরের পুরো সময়জুড়েই থাকবে সরকারের নানা ধরনের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি এবং বাড়ানো হয়েছে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা।

কিন্তু তারপরও জনগণ বাজেট গ্রহণ করছেন না বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। তারা বলছেন, জনগণ যেখানে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে এ বাজেট খাপ খাওয়ার মতো নয়। সরকারকে মানুষের ভালোটাই আগে ভাবতে হবে।

বাংলাদেশ সময়: ২১০৫ ঘণ্টা, জুন ১, ২০২৩
এসসি/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।