অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা যায়, সঞ্চয়পত্রে বর্ধিত উৎসে কর প্রত্যাহার, বিদ্যুৎ সংযোগে টিআইএন বাধ্যতামূলক না করা, পুঁজিবাজারের রিটেইন আর্নিংস ও রিজার্ভের ওপর কর প্রত্যাহার, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ভার্চুয়াল বিজনেস বা ই-কমার্সের ভ্যাট প্রত্যাহার, গুঁড়াদুধে আরোপিত ৫ শতাংশ রেয়াতি আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার এবং সিমেন্ট ও রডে অগ্রিম আয়কর প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে শনিবার (২৯ জুন) অর্থবিল-২০১৯ এবং পরের দিন রোববার (৩০ জুন) সংসদে বাজেট পাস হবে।
জানা যায়, সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বিশেষত নিম্ন ও মধ্যবিত্ত, ব্যবসায়ী ও পুঁজিবাজারের কথা চিন্তা করে এসব পরিবর্তন আনা হচ্ছে।
জাতীয় সংসদে ১৬ দিনের দীর্ঘ বাজেট আলোচনা শেষে কর ও শুল্ক আদায়ের ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যরা বেশকিছু প্রস্তাব ও মতামত দেবেন। প্রস্তাবিত বাজেট পাসের দিনই ঋণের বিপরীতে ব্যাংক সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালও এ বিষয়ে সরকারের অবস্থানের কথা জানাবেন।
সূত্র জানায়, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ, পুঁজিবাজারে প্রণোদনা, রেমিটেন্স ও রফতানিতে প্রণোদনা প্রদান, ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন, বিনিয়োগে ওয়ানস্টপ সার্ভিস নিশ্চিত করার ঘোষণাসহ বেশকিছু পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করে এবারের বাজেট পাস হচ্ছে। বাজেট পাসের আগের দিন পাস হবে অর্থবিল। অর্থবিল ও বাজেট পাসের দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিবর্তনের কারণ সম্পর্কে জাতীয় সংসদে বিস্তারিত বলতে পারেন। এবার কোনো পরিবর্তন আসছে না আয়-ব্যয়ের কাঠামোতে। কর কাঠামোর মধ্যে আয়কর অপরিবর্তিত রেখে চূড়ান্ত অর্থবিল প্রস্তুত করেছে এনবিআর।
এদিকে বাজেটের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে সাবেক কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী সঞ্চয়পত্রের উৎসে কর বাড়ানোর তীব্র বিরোধিতা করে সংসদে বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেন, সামাজিক সুরক্ষা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রকল্প। এখানে কেন হাত দিলেন অর্থমন্ত্রী? শুধু মতিয়া চৌধুরীই নয়, সঞ্চয়পত্রের উৎসে কর নিয়ে উদ্বিগ্ন সাধারণ সঞ্চয়কারীরাও।
গত ১৩ জুন ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট ও অর্থবিল- ২০১৯ জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এরপর প্রস্তাবিত বাজেটের বেশকিছু বিষয় নিয়ে সংসদের ভেতরে ও বাইরে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়।
মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে অগ্রিম কর উঠে যাচ্ছে
নতুন ভ্যাট আইনে এবার অগ্রিম ব্যবসায় ভ্যাটের (এটিভি) পরিবর্তে ৫ শতাংশ আগাম কর (এটি) বসানো হয়েছে। অর্থাৎ মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে ঢালাওভাবে ৫ শতাংশ অগ্রিম কর দিতে হবে। এতে দেখা গেছে, প্রায় সাড়ে ছয় হাজার পণ্যে এ আগাম কর বসেছে। ভ্যাট রিটার্ন দিয়ে এ আগাম করের টাকা ফেরত নিতে হবে। এ টাকা ফেরত পাওয়ার মধ্যবর্তী সময়ে ব্যাংকের সুদ গুনতে হবে ওই ব্যবসায়ীকে। ফলে আমদানি পর্যায়ে এসব যন্ত্রপাতি ও পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। এর সরাসরি প্রভাব পড়বে ভোক্তাদের ওপর। বিষয়টি বিশেষ বিবেচনায় নিয়ে আগামী অর্থবছরের বাজেট পাসের সময় তা পরিবর্তন করা হচ্ছে।
নতুন করে করারোপ হচ্ছে না সঞ্চয়পত্রে
২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সকল ধরনের সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর উৎসে কর ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়। বর্ধিত এ কর আরোপের প্রস্তাব নিয়ে ইতোমধ্যে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়েছে। এ কর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত সমাজের মধ্যবিত্ত, অবসরভোগী ও ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীদের আয়ের ওপর সরাসারি আঘাত করবে। সংসদেও হয়েছে এ সিদ্ধান্তের সমালোচনা। এর প্রেক্ষাপটে সরকার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর বর্ধিত উৎসে কর প্রত্যাহার করতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।
পুঁজিবাজারের রিটেইন আর্নিংস ও রিজার্ভের ওপর কর প্রত্যাহার
প্রস্তাবিত বাজেটে পুঁজিবাজার বিকাশে একগুচ্ছ প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। পুঁজিবাজার বিকাশের স্বার্থে তালিকাভুক্ত কোম্পানির রিজার্ভ তহবিল যদি তাদের পরিশোধিত মূলধনের বেশি হয়, তবে বাড়তি অংশের ওপর ১৫ শতাংশ কর আরোপ করা হয়। ফলে বাড়তি রিজার্ভ থাকলে ওই হারে কর দিতে হবে। এতে বহুজাতিক কোম্পানির রিজার্ভের অর্থ নগদ আকারে লভ্যাংশ দিয়ে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়। ফলে বিনিয়োগ কমে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। যার কারণে এ কর প্রত্যাহার করা হচ্ছে।
বিদ্যুৎ সংযোগে বাধ্যতামূলক থাকছে না টিআইএন সার্টিফিকেট
প্রস্তাবিত বাজেটে বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) সার্টিফিকেট বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী। তবে বিষয়টিতে ঘোর আপত্তি জানিয়েছেন খোদ বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি বলেন, এটি বাস্তবায়িত হলে দেশের দরিদ্র মানুষের হয়রানি বাড়বে। একই সঙ্গে কর্মসময়ের অপচয়ের পাশাপাশি আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ কারণে প্রস্তাবটি প্রত্যাহার করা হবে বলে জানা গেছে।
সিমেন্ট-রডে অগ্রিম আয়কর তুলে দেওয়া হতে পারে
প্রস্তাবিত বাজেটে সিমেন্টের কাঁচামাল আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট ১৫ শতাংশ ধরা হয়েছে। পাশাপাশি অগ্রিম আয়কর (এটি) ধরা হয়েছে অতিরিক্ত ৫ শতাংশ। ফলে এখন এ খাতে মোট ২০ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। পাশাপাশি বাজেটে রড শিল্পের ওপর ৬৫০ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। ফলে সিমেন্ট ও রডের দাম বাড়লে সরাসরি প্রভাব পড়বে সরকারের উন্নয়নমূলক মেগা প্রকল্প ও আবাসন খাতে। মধ্যবিত্তের গৃহনির্মাণে খরচ বাড়বে। এ দুটি নেতিবাচক প্রভাব এবং ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে শেষ পর্যন্ত অগ্রিম আয়কর বা এটি তুলে দেওয়া হচ্ছে।
আগামী ৩০ জুন রবিবার রাত ৮টায় ঢাকার শেরে বাংলা নগরের বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বাজেটোত্তর নৈশভোজের আয়োজন করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন।
বাংলাদেশ সময়: ২০০২ ঘণ্টা, জুন ২৯, ২০১৯
জিসিজি/এইচএডি/এমএমইউ