হেমি হোসেন মূলত মানুষের মনস্তাত্ত্বিক দিক নিয়ে বেশি কাজ করেন। সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় জীবন সহজকারক প্রক্রিয়া এনএলপি নিয়ে কথা হয়েছিল তার সাথে।
বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়া দুই দেশেই আপনি জনশক্তি নিয়ে কাজ করেছেন, এই দুই দেশের মানুষের মেধা ও দক্ষতার পার্থক্যগুলো কোথায়?
হেমি হোসেন: বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়াতে মেধার পার্থক্য খুব বেশি না। বাংলাদেশীরা খুব মেধাবী তবে সঠিক সময়ে সঠিক মেধা প্রয়োগ করা হয় না। অস্ট্রেলিয়াতে আবার খুব অল্প বয়স থেকেই সঠিক শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে একটা মানুষকে গড়ে তোলা হয়। যার ফলে প্রায় কাছাকাছি মেধা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এগোতে পারছে না।
তবে দক্ষতার পার্থক্য আছে। আর এই পার্থক্যটা গড়ে দিচ্ছে মেধা। বাংলাদেশের মানুষ এখনো আন্তর্জাতিক মার্কেটে খুব বেশি পরিচিত না। আমরা স্কিল মাইগ্রেশন করি, তবে সেটা শ্রমিক পর্যায়ের। কিন্তু এখনো আমরা যথাযথভাবে মেধা রপ্তানি করতে পারছি না।
কোন প্রফেশনে গেলে ভালো হবে, এটা একজন ক্যারিয়ারের শুরুতে কিভাবে বুঝবে?
হেমি হোসেন: ক্যারিয়ারের শুরুতেই যদি এটা বুঝতে হয়, তাহলে ক্যারিয়ার নিয়ে একটু আগে থেকে ভাবতে হবে। আমি কোন কাজ করতে পছন্দ করি, ওই কাজ করে আমি আয় করতে পারবো কিনা, যে টাকা আয় করবো তা দিয়ে আমি আমার নিজেকে এবং পরিবারকে চালাতে পারবো কিনা- এইসব চিন্তা করতে অনেকটা সময় চলে যায়। আমাদের দেশে একজন ছাত্র গ্র্যাজুয়েশন বা পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে অথবা শেষের কাছাকাছি গিয়ে ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবতে শুরু করে। সেক্ষেত্রে কাজ করে পছন্দের প্রফেশন নির্বাচন করতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়।
তবে আমি মনে করি, এই সময়টা নষ্ট করা আসলে উচিত না। বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ দুইবছরে নিজেকে এক্সপ্লোর করতে হবে। ওই সময় যদি কেউ নিজেকে বুঝতে পারে, নিজে কি করতে চাচ্ছে বা কি হতে চাচ্ছে এটা বুঝতে পারবে, তাহলে তার জন্যে প্রফেশন নির্বাচন করা খুব কঠিন কিছু হবে না।
আরেকটা জিনিস যেটা মাথায় রাখা লাগবে তা হলো ক্যারিয়ারটা বাংলাদেশেই করতে চাচ্ছে নাকি বাইরে কোনো দেশে। নিজের অনুপ্রেরণা কোথা থেকে আসছে সেটা বুঝতে হবে। আপনি যেসব মানুষকে দেখে অনুপ্রাণিত হন, তাদের সম্পূর্ণ কর্পোরেট জার্নি জানতে হবে, বুঝতে হবে। শুধু সাফল্য দেখে যদি অনুপ্রাণিত হয়ে ওই প্রফেশনকে বেছে নিতে চান তাহলে সেটা খুব বড় ধরনের বোকামি হবে। বাংলাদেশে রিসার্চ খুব কম হয়, ক্যারিয়ার নিয়ে রিসার্চ করা খুব জরুরি। কোনো রিসার্চ ছাড়া যেকোনো প্রফেশনে কাজ শুরু করলে সেখানে অনুপ্রেরণা কাজ করে না।
আমরা অনুপ্রেরনা ধরে রাখতে পারি না কেন?
হেমি হোসেন: অনুপ্রেরণা আসলে ধরে রাখার জিনিস না, এটা একটি চলমান প্রক্রিয়া, একটি জার্নি বলতে পারেন। শুধু বাংলাদেশই না, বিশ্বের অনেক দেশেই এখন একটি প্রধান সমস্যা হচ্ছে ইয়ং জেনারেশন এর মানসিকতা এবং অনুপ্রেরণাগুলো ধরে রাখা। আজকাল মানুষ সবকিছুতেই শর্টকাট খুঁজে। আজ একজনকে দেখে অনুপ্রাণিত হচ্ছে তো কাল আরেকজনকে দেখে। আমাদের মন শান্ত না। আমরা সবকিছুই একসাথে চাই। আমরা সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে খুব বেশি চিন্তা করি না আবার যেটা নিয়ে চিন্তা করা উচিত না, সেটা নিয়ে খুব চিন্তা করি। এই জিনিসগুলোই আসলে আমাদের অনুপ্রেরণাগুলো বাড়তে দিচ্ছে না।
এনএলপির কোন দিকটি আপনাকে এনএলপি ট্রেনিংটি করতে অনুপ্রাণিত করেছিলো?
হেমি হোসেন: এনএলপি আসলে একটি জার্নি। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পরে আমার মাথায় কিছু প্রশ্ন এসেছিলো। জীবনের মানে কি? স্কিল কিভাবে গড়ে উঠছে? আমার স্কিল কিভাবে অন্যকে দিতে পারবো? কেন একই পরিবারে জন্মানোর পরেও ভাই-বোনদের চিন্তাধারায় পার্থক্য থাকে? আমরা কিভাবে তথ্য নিচ্ছি? এই তথ্য কিভাবে আমরা প্রসেস করি? কেন একেকজন একই তথ্যকে বিভিন্নভাবে নিচ্ছে? আর এই তথ্যগুলো কোথা থেকে আসছে? এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমি জানতে পারি এনএলপি ল্যাংগুয়েজ সম্পর্কে। তখন থেকে এই এনএলপি নিয়ে কাজ শুরু করে দেই। কিন্তু বলাবাহুল্য এনএলপি নিয়ে নানান ধরনের সমালোচনা এবং ভিন্নমত রয়েছে। তবে সবকিছুই নির্ভর করছে আপনি দৈনন্দিন জীবনে এনএলপির থিওরি গুলোকে কীভাবে কাজে লাগাচ্ছেন সেটার উপরে।
এনএলপির ট্রেনিং কত দিনের? এটি কিভাবে পরিচালিত হয়?
হেমি হোসেন: এনএলপি তিন ধরণের হতে পারে।
১. এনএলপি প্র্যাকটিসনার
২. অ্যাডভান্স এনএলপি প্র্যাকটিসনার
৩. এনএলপি ট্রেইনার
এনএলপি প্র্যাকটিসনারের জন্য ৭ দিনের, অ্যাডভান্স এনএলপি প্র্যাকটিসনারের জন্য ৮ দিনের এবং এনএলপি ট্রেইনারের জন্য ৮ দিনের কর্মশালা পরিচালিত হয়।
পুরো কর্মশালাটি ই ক্লাসরুম ভিক্তিক। ট্রেইনারকে অবশ্যই এনএলপি ট্রেইনার সার্টিফাইড হতে হবে।
এনএলপির নিয়ম কাজে লাগিয়ে আমরা কিভাবে নিজেদের চেঞ্জ করতে পারি?
হেমি হোসেন: যেহেতু এনএলপি একটি নতুন নিউরো-পথ তৈরী করছে, সেহেতু এটা আমাদের যেকোনো তথ্য বা উপাত্ত বিশ্লেষণ করার দক্ষতা বাড়িয়ে দেয়। পাশাপাশি আমাদের ভিন্নভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়।
এনএলপি হচ্ছে এক প্রকার কমিউনিকেশন মেথড। এনএলপি আমাদের মধ্যে অতি ক্ষুদ্র কিছু নিউরো পথ তৈরী করে যা আমাদের বিশ্লেষণ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়।
এনএলপি জব মার্কেটে একজন ব্যক্তিকে কিভাবে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে রাখতে পারে?
হেমি হোসেন: আমি আগেই বলেছি এনএলপি সম্পূর্ণভাবে কমিউনিকেশন মেথড। এটা মানুষকে নতুন কমিউনিকেশন মেথড শিখতে সাহায্য করে। এখন যে মানুষটি সর্বাধুনিক পদ্ধতিতে ইন্টারভিউ দিবে, খুব স্বাভাবিকভাবে তার জব পাওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে যায়।
বাংলাদেশে এনএলপির সম্ভাবনা কতটুকু?
হেমি হোসেন: বাংলাদেশে এনএলপির সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। আমরা বর্তমানে একটি পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি এবং বর্তমান সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। সরকারের লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে এনএলপি বিশেষভাবে সহায়ক হতে পারে। আমাদের উচিত নিজেদের চিন্তাভাবনা পরিবর্তন করা এবং উন্নত দেশ গড়তে সহায়ক ভূমিকা পালন করা।
কিভাবে আমরা এদেশে এনএলপির বিস্তার ঘটাতে পারি?
হেমি হোসেন: বাংলাদেশে এনএলপির সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে যত বেশি এনএলপি প্রয়োগকারী থাকবে এদেশের মানুষ ততো উন্নত চিন্তাভাবনার অধিকারী হতে পারবে। তাই প্রয়োগকারীর সংখ্যা বাড়ানোর জন্যে আগে আন্তর্জাতিক মানের ট্রেইনার প্রস্তুত করতে হবে।
সাক্ষাতকার নিয়েছেন
নিয়াজ আহমেদ, সিইও এবং রিজুমে ডেভলপমেন্ট স্পেশালিষ্ট, কর্পোরেট আস্ক।