ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ক্যারিয়ার

নতুন কিছু শেখা, নতুন কিছু শেখানোই সফলতা

ক্যারিয়ার ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪৫৮ ঘণ্টা, মার্চ ১০, ২০১৮
নতুন কিছু শেখা, নতুন কিছু শেখানোই সফলতা নতুন কিছু শেখা, নতুন কিছু শেখানোই সফলতা

তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে এদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা যুগান্তকারী উদ্যোগ "টেন মিনিট স্কুল"। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে উদ্যোগটি। টেন মিনিট স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা আয়মান সাদিক। আইবিএ থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষে তিনি এগিয়ে নিচ্ছেন তার স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানকে। নতুন করে ভাবার, সৃজনশীল কিছু করার পথ দেখাচ্ছেন দেশের তরুণ প্রজন্মকে। টেন মিনিট স্কুল নিয়ে আয়মান সাদিকের পথচলার গল্প তুলে ধরেছেন কর্পোরেট আস্কের সিইও এবং রেজুমে ডেভলপমেন্ট স্পেশালিস্ট নিয়াজ আহমেদ

টেন মিনিট স্কুলের যাত্রা শুরুর গল্প শুনতে চাই-

আয়মান সাদিক: বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র থাকাকালীন অবস্থায়ই টেন মিনিট স্কুলের ভাবনা মাথায় আসে। বিভিন্ন ওয়েবসাইট নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তখন থেকেই যোগাযোগ চলতে থাকে এবং একটি কোম্পানিকে আমরা টেন মিনিট স্কুলের নির্মাণ বাবদ অগ্রিম পঞ্চাশ হাজার টাকা দেই।

দীর্ঘ ছয় মাস চেষ্টা করার পর যখন কোন ফলাফল পাওয়া গেল না, তখন কিছুটা মন ভেঙ্গে যায়। কিন্তু দমে যাইনি, আবার নতুন করে ওয়েব নির্মাতা কোম্পানির সন্ধান শুরু করি। এবার অবশ্য আগেরবারের মত পুরো টাকা অগ্রিম না দিয়ে অর্ধেক দিয়ে কাজ শুরু করা হলো। পর্যায়ক্রমে ওয়েব নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের পিছনে প্রায় দেড় লাখ টাকা বিনিয়োগ করি। এভাবে দেখতে দেখতে দেড় বছর সময় পার হয়ে যায়। এরপর একদিন সন্ধায় এক ছোট ভাইকে আমার স্বপ্নের টেন মিনিট স্কুলের কথা জানাচ্ছিলাম। সে সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র। ‘আরেকটা বার চেষ্টা করে দেখি, স্বপ্নটা সত্যি হয় নাকি’- এই চিন্তা ভাবনা থেকে তার সাথে আবার ওয়েবসাইট নির্মাণের কাজ শুরু করি। প্রতিটা মুহূর্তে একটু একটু করে তৈরী হচ্ছিল টেন মিনিট স্কুলের ওয়েবসাইট। ইতিমধ্যে বিভিন্ন পত্রপত্রিকার লেখালেখির সুবাদে এবং ফেসবুকের কল্যাণে হাতেগোনা কিছু মানুষ আমাদের টেন মিনিট স্কুলের কথা জানতে পারে। ২০১৫ সালের ১০ মে ওয়েবসাইট উদ্বোধন করার দিন ঠিক করি, কিন্তু হঠাৎ করে ওয়েবসাইট উদ্বোধনের ঠিক সাতদিন আগে আমাদের সব কোডিংগুলো কিভাবে যেন মুছে যায় এবং ওয়েবসাইটটি তার কার্যক্ষমতা হারায়। এর মাঝে আমি ব্রুনেইতে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন শীর্ষক একটি সেমিনারে বাংলাদেশকে রিপ্রেজেন্ট করার সুযোগ পাই। ব্রুনেইতে সবার সামনে টেন মিনিট স্কুলের ওয়েবসাইট দেখাবো, এরকম একটি উত্তেজনা কাজ করছিলো। ঠিক সেই মুহূর্তে নির্মম বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের ওয়েবসাইট আর কাজ করছিল না। ১৭ মে আমরা আবার উদ্বোধনের দিন নির্ধারণ করি। সাতদিনের মাথায় আমরা সবাই দিন রাত পরিশ্রম করে পুনরায় টেন মিনিট স্কুলের ওয়েবসাইটটি দাড় করাই। আমার স্বপ্নের টেন মিনিট স্কুল ১৭ মে যাত্রা শুরু করে এবং উদ্বোধনের কার্যক্রম শেষ করে ওইদিন রাতেই আমি ব্রুনেইয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি। আমি যখন ট্রাঞ্জিশনের জন্য বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছিলাম, তখন জানতে পারলাম আমাদের সার্ভার ক্র্যাশ করেছে। অথচ ঘন্টাখানেক পরেই আমি টেন মিনিট স্কুলকে রিপ্রেজেন্ট করতে হবে পুরো বিশ্বের সামনে। তখন আমার ক্রেডিট কার্ড ছিল না। এয়ারপোর্টে বসে এক বড় ভাইয়ের ক্রেডিট কার্ড দিয়ে নতুন সার্ভার কিনা হল এবং সারারাত কাজ করার পরে সকালবেলা আবার টেন মিনিট স্কুল চালু হলো। আমিও ব্রুনেইতে গিয়ে পুরো বিশ্বকে দেখিয়ে আসলাম টেন মিনিট স্কুল। এরপর থাকে আজ পর্যন্ত আর কোনদিন আমাদের সার্ভার ডাউন হয় নি।

টেন মিনিট স্কুলের বর্তমান কার্যক্রমগুলো কি কি-

আয়মান সাদিক: প্রতিদিন প্রায় দুই লক্ষেরও বেশি শিক্ষার্থী টেন মিনিট স্কুলের মাধ্যমে পড়াশুনা করছে। প্রথম শ্রেণি থেকে শুরু করে দ্বাদশ শ্রেণি প্রযন্ত প্রত্যেকটি বিষয়ের প্রত্যেক চ্যাপ্টারের উপর মোট সাড়ে ছয় হাজারের উপর ভিডিও রয়েছে। একুশটি প্রফেশনাল কোর্স রয়েছে টেন মিনিট স্কুলের সাইটে। মাইক্রোসফট অফিস এবং এডোবির প্রতিটি সফটওয়্যারের উপরে সম্পূর্ণ কোর্স রয়েছে। আছে ২১৭ টি স্মার্ট বুক ও ৩৫০টির বেশি ব্লগ। ৪৮ হাজারের অধিক কুইজ আপলোড করা আছে আমাদের এই সাইটটিতে। লাইভ ক্লাস আছে ৩৫ টির বেশি। ইউটিউবে আছে ২ লক্ষের অধিক সাবস্ক্রাইবার। ফেসবুকে লক্ষাধিক মেম্বারের কয়েকটি গ্রুপ রয়েছে যার মাধ্যমে আমরা শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার জন্য প্রয়োজনীয় সাপোর্ট দিয়ে থাকি। ৫৩ জন নিবেদিত টিম মেম্বার এবং ৬০ জনের অধিক শিক্ষকের নিরলস পরিশ্রমের ফলাফল আজকের এই টেন মিনিট স্কুল।

আয়মান সাদিকের পুরস্কার ও তিরস্কার-

আয়মান সাদিক: ২০১৮ তে আমরা পেলাম কুইন্স ইয়াং লিডার এ্যাওয়ার্ড। ২০১৬ সালে পেয়েছি লন্ডনে ফিউচার লিডারস লিগ চ্যম্পিয়ানস এ্যাওয়ার্ড। শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার জন্য টেন মিনিট স্কুল সুইস এমব্যাসি এ্যাওয়ার্ড, গ্লোমো এ্যাওয়ার্ডয়ে ভূষিত হয়েছে। আমরা পেয়েছি এপিকটা এ্যাওয়ার্ড যাকে আইসিটি'র অস্কার বলা হয়। এছাড়া আমরা জাতীয় পর্যায়ে আইসিটি পুরস্কার, ইয়ুথ এ্যাওয়ার্ড ছাড়াও অর্ধশতাধিক বিভিন্ন ধরনের সম্মাননা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছি।

এবারে আসা যাক একটু তিরস্কারের গল্পে, টেন মিনিট স্কুলের শুরুর দিকে আমরা সারা রাত জেগে একটা স্টুডিওতে ভিডিও বানাতাম। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর পাড়া-প্রতিবেশীরা আমার মাকে জিজ্ঞাসা করতো, ‘ভাবি, আয়মান কি করে?’ আমার মা উত্তর দিতো- ‘সে ভিডিও বানায়। ’

আন্টিরা জিজ্ঞাসা করতো, ‘ভাবি, কিসের ভিডিও বানায়?’ 

আমার মা উত্তর দিতো, ‘তা তো জানিনা। ’

প্রতিবেশিরা দেখতো আমি প্রতিদিন রাতে ভিডিও বানানোর জন্য যাই আর প্রতিদিন সকালে ফিরি। এতে করে তাদের মনে বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক প্রশ্নের জন্ম দিত, আমার মা প্রথমদিকে এর জন্য কিছুটা কষ্ট পেতেন।

প্রথমদিকে আমি যখন বিভিন্ন ইভেন্টে বক্তা হিসেবে যেতাম, আমি টেন মিনিট স্কুলের টিশার্ট পরতাম। একবার একটি ইভেন্টে কথা বলতে যাই এবং সেখানকার দারোয়ান আমাকে আটকে দেয়। তাকে যখন জানালাম আমি একজন এই সেমিনারের বক্তা, তখন সে মিনমিনিয়ে বলে উঠল এই ছোকরা বক্তা হয় কিভাবে? অতপর সে আয়োজককে ফোন দিয়ে জানালো এক পোলা তাকে এসে বলছে সে নাকি স্পিকার। এরকম স্পিকার থেকে ছোকরা আর ছোকরা থেকে পোলা আবার পোলা থেকে স্পিকার, এই ঘটনাগুলোর কথা ভাবলে এখন হাসিই পায়।

আপনার কাছে সফলতার মানে কি-

আয়মান সাদিক: সফলতার মানে হচ্ছে প্রতিদিন নতুন কিছু শেখা, মানুষকে নতুন কিছু শেখানো। মানুষকে হাসানো এবং মানুষের জীবনে ভ্যালু সংযোজন করা।

টেন মিনিট স্কুলের সফলতার প্রধান তিনটি কারণ-

আয়মান সাদিক: আমাদের চারপাশে আমরা প্রায়ই দেখি কেউ নতুন কিছু করতে চাইলে সবাই তার বিরোধিতা করে এবং সে যাতে বেশিদূর এগোতে না পারে সেজন্য সবাই পেছন থেকে আকড়ে ধরে। আমার ক্ষেত্রে হয়েছে ঠিক তার উল্টোটা। আমি যখনি যাকে যা রিকোয়েষ্ট করেছি তার কাছ থেকে তাই পেয়েছি। মানুষের মাঝে আমি বিশ্বাস দেখতে পাই। সরকারের আইসিটি মন্ত্রনালয় আমাকে বিশ্বাস করেছে, রবি  আমাকে বিশ্বাস করেছে। আমার টিম মেম্বাররা আমাকে বিশ্বাস করেছে। টেন মিনিট স্কুল বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান যা শুধুমাত্র বিভিন্ন স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা চালাচ্ছে। আর টেন মিনিট স্কুলের সফলতার সবচেয়ে বড় অংশীদার হচ্ছে এর শিক্ষার্থীরা। আমার শিক্ষার্থীদের কে আমি যখন যেটা করার জন্য অনুরোধ করেছি তখন তারা সেটাই করেছে।

শিক্ষাব্যবস্থা ডিজিটাল তো হল, তবুও দেশে এতো বেকার কেন?

আয়মান সাদিক: শিক্ষাব্যবস্থা এখনও ডিজিটাল হচ্ছে। আগামীতে এটা আরো উন্নত হবে এবং সহজতর হবে। এখন পর্যন্ত দেশে এক লাখ সত্তর হাজার স্কুল আছে, আমরা পৌঁছেছি দুই হাজার স্কুলে। দেশে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪ কোটি ২৮ লাখ আর আমরা পড়াই ২ লাখ শিক্ষার্থীদের। সুতরাং এখনও আরো অনেক কাজ করা বাকি। এই মুহূর্তে একুশ শতাব্দীর দক্ষতাগুলো নিয়ে নতুন কোর্স এবং কন্টেন্ট সাজানোর কাজ চলছে। এই কাজ সম্পূর্ণ হলে তা বেকার সমস্যা নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখবে বলে আমি মনে করি।

মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষক, তৃণমুল পর্যায়ে শিক্ষকদের পাঠদান পদ্ধতি উন্নয়নে টেন মিনিট স্কুলের কোন পদক্ষেপ আছে কি?

আয়মান সাদিক: আমরা খুব শীঘ্রই শিক্ষকদের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণগুলো অনলাইনে আনছি। কিভাবে ডিজিটাল মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করে ইন্টারেক্টিভ কন্টেন্ট দিয়ে ক্লাসে পাঠদান করানো সম্ভব তা নিয়ে সরকারের বড়সড় পরিকল্পনা আছে। তবে সর্বোপরি আমাদের টেন মিনিট স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য একটি সহায়ক। আর এই সহায়তা যে কেউ পেতে পারে, তাও আবার একদম ফ্রি।  

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে স্বপ্ন-

আয়মান সাদিক: আমরা অনেকে না জেনে না বুঝে মুখস্ত করি। আমি এমন শিক্ষা ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখি যেখানে সবাই বুঝে বুঝে পড়বে। পড়াশুনাটা কোন ভীতি না, আনন্দের সাথে হবে। যেখানে সবাই সিলেবাসের বাইরেও নতুন কিছু শিখতে আগ্রহী হবে। একজন ছাত্রকে সিজিপিএ না বরং মেধা দিয়ে মূল্যায়ন করা হবে। সবাই নিজেদের পছন্দের মতো বিষয় পড়বে, শিখবে।

প্রিয় পাঠক, আপনার প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, ক্যারিয়ার বিষয়ক যেকোন প্রশ্নের উত্তর জানতে, আপনার মতামত জানাতে বা লেখা পাঠাতে চাইলে আমাদের ইমেইল করুন career.banglanews@gmail.com ঠিকানায়। বাংলানিউজের সাথেই থাকুন..

বাংলাদেশ সময়: ১০৫৭ ঘণ্টা, মার্চ ১০, ২০১৮

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।