ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জলবায়ু ও পরিবেশ

মাছেদেরও মুক্তির আনন্দ!

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন, এনভায়রনমেন্ট স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৪৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০১৫
মাছেদেরও মুক্তির আনন্দ! ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) : দু’দিন আগেও হাসি ছিল না জেলেদের মুখে। রোদেপোড়া মুখগুলোতে কেবল হতাশা আর উৎকণ্ঠার ছাপ।

কারণ, তারা তাদের জীবিকার উৎসস্থল হাইল হাওরে মাছ ধরতে পারছিলেন না। মাছ না ধরা এবং বিক্রি না করতে পারায় তাদের অনেকেরই পরিবার-পরিজন থেকেছেন অনাহারে।

কিছু স্বার্থান্বেষী সংঘবদ্ধ মানুষ হাইল হাওরটি সম্পূর্ণভাবে দখলে রেখেছিলেন। জলমহাল ইজারার নামে তারা কয়েকজন যতোটুকু জলাশয় নিয়েছিলেন তার থেকে দ্বিগুণ বা তিনগুণ-চারগুণ কখনো আবার আটগুণ পরিমাণ জায়গায় জোরপূর্বক নেটজাল দিয়ে দখল করে রেখেছিলেন। কিছুতেই ওই জায়গায় সাধারণ জেলেদের মাছ মারতে দিচ্ছিলেন না।

এর ফলে শ্রীমঙ্গল উপজেলার পশ্চিম ভাড়াউড়া গ্রামের প্রায় দু’ শতাধিক জেলে চরম দুর্দশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলেন।

হাইল হাওরের বেশ কিছু জায়গা অবৈধভাবে তারা দখল করে শতাধিক সাধারণ গরিব জেলের পেটে লাথি মেরে যাচ্ছিলেন। আর কিছুদিন পরই তারা বিল শুকিয়ে কোটি কোটি টাকার মাছ মেরে নিজেরা লুটপাট করে নেওয়ার ফন্দি আঁটছিলেনও। প্রতি বছরই তারা এভাবেই করে আসছেন।
 
দুই মেয়ে এবং স্ত্রীসহ আবদুল মুমিনের চার সদস্যের পরিবার। তিনি হাইল হাওরের মৎস্যজীবী। শৈশব থেকে আজ পর্যন্ত এ পেশায়ই আছেন। গত আট/দশ দিন ধরে তিনি বড় আকারের একটি মাছও ধরতে পারেননি।

নৌকার দাঁড় বাইতে বাইতে আবদুল মুমিন বলেন, ‘মাছ না ধরতে পারলে আমরা বাঁচতাম কিলা (কিভাবে)? দু’হপ্তা ধরিয়া উপাস আছি রেবা। ...’

এ উচ্চারণ কেবল তারই নয়! শত শত জেলের। আবদুল মুমিনের এ কণ্ঠস্বরই যেন সব জেলেরই ক্ষোভ আর হতাশার বর্হিপ্রকাশ।

শাহবুদ্দিন, শাহীন আলী, মঙ্গল মিয়া- তাদের কণ্ঠেও আবদুল মুমিনের একই সুর। তারা সবাই ছিলেন একেকটি নৌকার মাঝি। স্বতঃস্ফুর্তভাবে নিজ নিজ নৌকা নিয়ে এসেছেন ভ্রাম্যমান আদালতকে সাহায্য করতে।    

আমাদের নৌকা তখন বাষট্টি বিলে। এ বিলটি বিশাল আকারের। একদিক থেকে অপরদিকে ভালো করে দেখা যায় না। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। বাষট্টিটি বিলের সমষ্টিতেই এ নামকরণ। আনসার সদস্যদের সঙ্গে সাধারণ জেলেরাও একত্রিত হয়েছেন হাওরে দেওয়া অবৈধ জালগুলোকে কাটতে।

হাতে দা-কাচি, মুখে প্রাণের হাসি! জাল মুঠোয় নিয়ে কাটার কাজে তখন তুমুল ব্যস্ত জেলেরা।

এতোদিন জালগুলোই সাধারণ জেলেদের রুটি-রুজিকে নষ্ট করে রেখেছিল। আজ নিজ হাতে সেই প্রতিবন্ধকতাকে কাটতে পারাই যেন প্রাণের মহানন্দ!

মাঝে মাঝে থেমে থেমে কানে ভেসে আসছিল সাধারণ জেলেদের সম্মিলিত জাল কাটার সেই উল্লাসধ্বনি।

আটকে থাকা মাছগুলো ছড়িয়ে পড়লো পুরো হাইল হাওরে। মাঝারি আকারের একটা মাছ হঠাৎ ঝলাৎ করে উঁকি দিয়ে উঠলো! এ যেন মাছেদের মুক্তির আনন্দ!

মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসন এবং শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রশাসনে যৌথ উদ্যোগে শনিবার (১৪ নভেম্বর) সকাল দশটা থেকে প্রায় চার ঘন্টাব্যাপী একটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হলো। এর ফলেই হাইল হাওর থেকে অবৈধ জালগুলো তুলে ফেলা হলো। ৩ লাখ টাকার অবৈধ জাল আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয় পরে।

এর ফলে মাত্র দু’দিনের ব্যবধানে হাইল হাওরে প্রকৃত জেলেদের মৎস্য শিকার এবং তার মাধ্যমে জীবন-জীবিকার সব প্রতিবন্ধকতা দূর হয়েছে।

জেলা ডেপুটি রেভিনিউ কালেক্টার (আরডিসি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কে এম সালাহউদ্দিনের নেতৃত্বে এ ভ্রাম্যমাণ আদালতটি পরিচালনা করা হয়। এছাড়া উপস্থিত ছিলেন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. নুরুল হুদা, ৫ আনসার ব্যাটালিয়নের গ্রুপ কমান্ডার এপিসি আবু দাউদ খান, শ্রীমঙ্গল থানার সাব-ইন্সপেক্টর (এসআই) লিটন ঘোষ প্রমুখ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সাধারণ জেলে বললেন, তারকা সমবায় সমিতির নামে মাত্র কয়েকজন অমৎস্যজীবী নেটের জাল দিয়ে পুরো হাওর দখল করে রাখেন। কিছুতেই সাধারণ জেলেদের মাছ ধরতে দেন না। প্রতি বছর এভাবেই অবৈধভাবে হাওরটি দখল করে রাখেন।

তিনি আরো বলেন, ইউপি চেয়ারম্যান ভানু, বোরহান, আকাশ, পিয়ার ও আবুল ওই কুচক্রিমহলের প্রভাবশালী সদস্য। তারাই মূল সিন্ডিকেট। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তারা জলমহালের লিজ (ইজারা) আনেন। একটি বিলের ডাক আনলে তারা ছয়টি বিলের জায়গা দখল করে জাল দিয়ে মাছগুলো আটকে দেন।

লিজের ব্যাপারে তিনি বলেন, আরো মজার ব্যাপার হলো-তারকা সমিতি নামে ওই সংঘবদ্ধ চক্র লিজ এনে পরে তারা অন্য প্রভাবশালীদের সাব-লিজ দেন। জাল দিয়ে মাছ আটকে রাখা এবং সাব-লিজ দেওয়া ইজারা আইনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী বলে জানান এই প্রবীণ মৎস্যজীবী।

মাছরাঙা মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি রোকাম উদ্দিন বলেন, আমাদের সমবায়ের সদস্য ১১০ জন। তারা সবাই সরাসরি মৎস্য শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করেন। প্রায় একমাস ধরে তারা বিলে মাছ মারতে পারছেন না। সংঘবদ্ধ চক্রটি পুরো হাওর জাল ফেলে দখল করে রেখেছিল।  

মাছরাঙা মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সম্পাদক সেলিম আহমেদ বলেন, আমরা এক হয়ে সমিতির মাধ্যমে প্রশাসন বরাবরে দরখাস্ত দেই। পরে কর্মকর্তাদের কাছে আমাদের দুর্দশার কথা তুলে ধরি।

রোদের তীব্রতা আমাদের সম্মিলিত আনন্দ আর সফলতার মাঝে এতোটুকু ক্লান্তি ঢেলে দিতে পারেনি। হঠাৎ চোখে পড়লো একটি ফলি মাছের মৃতদেহ। হাওরের পানিতে ভেসে রয়েছে। মাঝি আমার উৎকণ্ঠার চোখ দেখে নিজ থেকেই বলে উঠেলেন- ‘এই মাছটি নেট জালের মধ্যে পড়ে মারা গেছে’।

বাংলাদেশ সময়: ১১৪৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০১৫
বিবিবি/এএসআর

** ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে হাইল হাওর দখলমুক্ত

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।