ঢাকা: পরিবেশ দূষণ আর গ্রিনহাউজ গ্যাসের ক্রমবর্ধমান নিঃসরণে সৃষ্ট প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ভয়াবহতা দিন দিন বাড়ছেই। ক্ষরা, অতিবৃষ্টি, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে জনজীবন।
‘প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস (পিএনএএস)’- এর সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, আগামী কয়েক দশকেই ৩ দশমিক ৩ ফুট পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা। কোথাও কোথাও পানির উচ্চতা বেড়ে যেতে পারে ১৪ থেকে ৩৩ ফুট পর্যন্ত।
মুম্বাই
এ আশঙ্কা সত্যি হলে ঢাকা-কলকাতার মতো গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো তলিয়ে যেতে পারে। সাগর গর্ভে হারিয়ে যেতে পারে মালদ্বীপসহ দক্ষিণ গোলার্ধের অনেক দ্বীপদেশই।
গবেষণা পরিচালনাকারী যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও এশিয়ার বিজ্ঞানীরা এ ব্যাপারে একমত যে, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির বর্তমান হার বজায় থাকলে ২১০০ সালের মধ্যে নিশ্চিতভাবেই বিশ্বের অনেক শহর পানির নিচে তলিয়ে যাবে।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উচ্চতা ২৯ দশমিক ৫৩ ফুট। আর রাজধানী ঢাকার গড় উচ্চতা ১৩ দশমিক ১২ ফুট। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা অনুযায়ী, এ শতকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১৪ ফুট বাড়লেও দেড় কোটির বেশি মানুষের আবাস এই শহর পানির নিচে তলিয়ে যাবে। ঢাকা ছাড়াও তলিয়ে যাবে বন্দরনগরী চট্টগ্রামও। এখানে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৩ দশকিক ১২ ফুট উঁচুতে।
শাংহাই
বাংলাদেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম ছাড়াও তলিয়ে যাবে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার অনেকাংশও। এখানকার নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উচ্চতা ২২ দশমিক ৯৭ ফুট। এছাড়া তলিয়ে যাবে মালদ্বীপের পুরোটাই। দেশটির রাজধানী মালেতে অবস্থিত ইব্রাহিম নাসির আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উচ্চতা মাত্র ৬ দশমিক ৫৬ ফুট।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, বৈশ্বিক তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লেই জল ছুঁইছুঁই করবে ভারতের মুম্বাই, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক, যুক্তরাজ্যের লন্ডন, দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবান, চীনের শাংহাই, অস্ট্রেলিয়ার সিডনি ও ব্রাজিলের রিওতে। আর যদি তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি পর্যন্ত বাড়ে, তাহলে এসব শহরের বেশিরভাগই ডুবে যেতে পারে। লন্ডনেও পানি প্রবেশ করবে।
লন্ডন
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মুম্বাই ৪৬ ফুট, নিউইয়র্ক ৩৩, লন্ডন ১১৫ ফুট, ডারবান ৬৯ ফুট, শাংহাই ১৩ ফুট, রিও ১৬ দশমিক ৪০ ফুট উঁচুতে। আর অস্ট্রেলিয়ার সিডনির উচ্চতা একেক জায়গায় একেক রকম। এ শহরের সর্বনিম্ন উচ্চতা মাইনাস ৩ দশমিক ২৮ ফুট। অর্থাৎ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩ দশমিক ২৮ ফুট নিচে। আর সর্বোচ্চ উচ্চতা ৩২৪ দশমিক ৮ ফুট।
বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, শুধু আমেরিকাতেই তলিয়ে যাবে ২০টির বেশি শহর। বিশ্বব্যাপী এ সংখ্যা আরও অনেক বেশি হবে। মালদ্বীপের মতো নিচু দেশগুলো পুরোপুরি ডুবে যাবে। পানিবন্দি হয়ে পড়বেন শত কোটি মানুষ। জলবায়ু উদ্বাস্তুর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাবে।
ডারবান
বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণায় দেখেছেন, ২৩ হাজার বছর আগে মধ্য-মায়োসিন যুগে একবার বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে গিয়েছিল। তখনকার তাপমাত্রা বর্তমানের চেয়ে অনেক কম হওয়া সত্ত্বেও গ্রিনল্যান্ড ও অ্যান্টার্কটিকার বরফগুলো গলতে শুরু করে। আর এখন তো কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ প্রতি দশ লাখে কমপক্ষে ৪০০। তাপমাত্রাও ঢের বেশি।
গবেষণাপত্রের সহ-লেখক ও যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সিতে অবস্থিত রটগার্স ইউনিভার্সিটির গবেষক বেন হর্টন বলেছেন, আমাদের পূর্ববর্তী সময়েও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি নিয়ে গবেষণা হয়েছে। নিজেদের অনুসন্ধান ও পূর্ববর্তী ওই গবেষণাগুলো ঘেঁটে আমরাই প্রথম একটা ধারাবাহিক তথ্য প্রকাশ করলাম। উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধের বিভিন্ন দেশে আমরা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পরিমাপের ব্যবস্থা করেছিলাম। লবণাক্ত জলাভূমির পরিসর বৃদ্ধির হার, ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের আয়তন, কোরাল, জীববৈজ্ঞানিক ও পুরাতত্ত্ব সংক্রান্ত তথ্যও আমাদের এ গবেষণায় সংযুক্ত করেছি।
রিও
অলাভজনক জলবায়ু বিশ্লেষক সংস্থা ক্লাইমেট সেন্ট্রালের এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বন্যার প্রাদুর্ভাব দিন দিন বাড়ছে। ১৯৫১ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত ৩৩ বছরে বিশ্বে ১৯৩ দিন বন্যা হয়েছে। কিন্তু ১৯৮৫ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৩০ বছরে এ সংখ্যা বেড়ে ৭০১ দিনে দাঁড়িয়েছে। হিসাবটা সার্বিক নয়। বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যার রেকর্ড থেকে এ হিসাবটা করা হয়েছে।
বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতার অব্যাহত বৃদ্ধির কারণেই এসব বন্যার ৭৮ শতাংশ হয়েছে।
সিডনি
ক্লাইমেট সেন্ট্রালের ভাইস প্রেসিডেন্ট বেন স্ট্রস বলেছেন, সমস্যা দিন দিন প্রকট হচ্ছে। ২১০০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বা ৩ দশমিক ৩ ফুট পর্যন্ত বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কোথাও কোথাও তো পানির উচ্চতা ১৪ থেকে ৩৩ ফুট পর্যন্তও বেড়ে যেতে পারে।
তাই বিজ্ঞানীদের ধারণা, ভবিষ্যত পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিপদটা উঠে আসবে সমুদ্র থেকেই। বিভিন্ন সূত্র ব্যবহার করে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির তথ্য সংগ্রহ করে তারা দেখিয়েছেন, কোরাল রেকর্ড ও পলি জমা পড়ার হার উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৬
আরএইচ/জেডএম