পাথরঘাটা (বরগুনা) থেকে ফিরে: ‘মোরা জীবন হাতে নিয়া পানি থেইক্যা ইলিশ উডাই, আর মোরাই খাইতে পাই না। গুড়াগুড়াডি (ছেলে-মেয়ে) ইলিশ খাইতে চায়, দিবার পারি না’।
বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার চরদুয়ানি ইউনিয়নের দক্ষিণ চরদুয়ানি গ্রামের জেলে ছগির বিশ্বাস ও মজিবর বিশ্বাসের খেদোক্তি এটি।
বিষখালী-বলেশ্বর তীরবর্তী উপকূলীয় পাথরঘাটা দেশের ইলিশ আহরণের একটি প্রধান কেন্দ্র। সিডর বিধ্বস্ত এ জনপদের দুই লাখ বাসিন্দার মধ্যে ২০ শতাংশ শূন্যভোগী (বিনিয়োগ করতে না পারা হতদরিদ্র) জেলেসহ ৮০ শতাংশই মৎস্যজীবী। তাদের জীবন-জীবিকাও তাই ইলিশনির্ভর।
অথচ যারা সাগরে-নদীতে-খালে নেমে প্রকৃতি ও পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে ইলিশ ধরছেন, তারাই তা খেতে পান না।
পদ্মা গ্রামের সিডরে বাঁধ ভাঙন এলাকার আলতাফ মাঝি, মো. জালাল, কবির নাজির, মতলেব নাজির জানান, ইলিশ মৌসুমে দাদন দিয়ে একজন মাঝির (সরদার) নেতৃত্বে তাদেরকে মাছ ধরতে পাঠান আড়তদার-মহাজন-ব্যবসায়ী ও বড় ট্রলার মালিকরা। আবার অনেক নৌকার মালিক নিজেই মাঝি। তার সঙ্গে মাছ শিকারে যেতেও দাদন নেন জেলেরা।
দাদন নেওয়ার কারণে মাঝিও আড়তদারের কাছেই বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক কম মূল্যে মাছ বিক্রি করতে বাধ্য হন। মাছ বিক্রির টাকা তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যার এক ভাগ নৌকার মালিক এবং এক ভাগ মাঝি পান। বাকিটা অন্য জেলেদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। এই টাকা থেকে জেলেরা আড়তদারদের দাদন পরিশোধ করেন। বিক্রির আড়াই শতাংশও কমিশন হিসেবে দিতে হয়। নিজেদের খাওয়ার জন্য মাছ নেওয়ার নিয়ম নেই।
দক্ষিণ চরদুয়ানি গ্রামের জেলে জাফর জমাদ্দার ও তার ছেলে রেজাউল, মো. বাদল, দুলাল, বোট মালিক-মাঝি দেলোয়ার ও তার ছেলে শাকিল টাকার অভাবে মৌসুম শুরুর অনেক পরে মাছ ধরার নৌকা, ইঞ্জিন চালিত বোট প্রস্তুত ও জাল মেরামত করছিলেন।
তারা বলেন, ‘সিজন শুরু হইয়া গ্যালেও টাহা-পয়সার অভাবে বোট হারার কামই শ্যাষ করতে পারি নাই। বোট পানিতে ভাসাইতে বাধ্য হইয়াই মাহাজন-আড়তদারগো জুলুমের শর্তে দাদন আনতে হয়। ইলিশ পাইলে তাই হ্যারাই লইয়া যায়, আমরা পামু কি কইরা?’
বড় ভাই আলতাফ কাজীর নৌকার মাছ ধরার সঙ্গী ১৪ বছরের কিশোর জেলে আরাফাত কাজী বলছিল, ‘পানিতে নামন শুরুর আগে ইলিশ খাইতে চাইতাম। বাপজান-ভাইজানে না দিতে পারলে মন খারাপ হইতো। অহন নিজেও মাছ ধরতে যাই বইলাই বুঝতে পারি, ইলিশ ধইরা আনলেও মোগো পাতেই ক্যান ওডে না’।
পাথরঘাটা সদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য মো. সিদ্দিকুর রহমান, ফজলুল হক, হরিণঘাটা গ্রামের মো. শহিদুল ইসলাম, পদ্মা গ্রামের নুরুল আলম, পৌর শহরের মো. জসিম উদ্দিন রিপন, শাহনেওয়াজ হাদি, রিয়াজ, স্টুডিও ব্যবসায়ী মো. রিয়াজ, ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল চালক মো. শাহিন, নূরুল ইসলাম ও নাসিরের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেলেদের কাছ থেকে যে দামে ইলিশ কেনেন আড়তদার-ব্যবসায়ীরা, সারাদেশে রফতানি ও স্থানীয় বাজারে বিক্রির সময় রাখেন তার দ্বিগুণ। ফলে শুধু জেলেরাই নন, ইলিশের সাম্রাজ্য পাথরঘাটার বাসিন্দাদেরও তা খাওয়ার সাধ্য থাকে না।
পৌর শহরের হোটেল-রেস্তোরাঁয় ইলিশের পিস প্রকারভেদে ৮০ টাকা থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। শাহীন হোটেলের মালিক মো. শাহজাহান বাংলানিউজকে বলেন, এখানকার বাজার থেকে যে দাম দিয়ে কিনি, তাতে এর চেয়ে কম রাখা সম্ভব না।
বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএফডিসি) পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র ও পাইকারি বাজারে ইলিশ ওঠানো-নামানো, প্রক্রিয়াজাতকরণ, হিমায়িত করা, প্যাকিং, দেশে-বিদেশে রফতানির মহা কর্মযজ্ঞের মূল কারিগর জেলে-মৎস্য শ্রমিক, ট্রলার-ট্রাক-ভ্যান শ্রমিক, অকশন শেডের শ্রমিক-কর্মচারী এবং উপজেলার সরকারি-বেসরকারি ২৩ বরফকলের শ্রমিকরা। তাদের উপলব্ধি- ‘সারা জীবন খালি অন্যের খাওনের লাইগাই খাইট্যা গেলাম। নিজেরাই ইলিশ খাইতে পারলাম না’।
বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা বলেন, আমরা এখান থেকে ঢাকা, বেনাপোল হয়ে কলকাতা, নওগাঁ-রাজশাহীসহ উত্তরাঞ্চলে ইলিশ পাঠাই। এখন নদী-সাগরে ইলিশ মেলে কম, তাই মূল্য চড়ে যায়।
বিএফডিসি’র ব্যবস্থাপক লে. কমান্ডার সোলায়মান শেখ বাংলানিউজকে বলেন, বছরে গড়ে ৫ হাজার টন ইলিশ আহরণ ও বিক্রি হয় পাথরঘাটা থেকে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় জেলেদের ন্যায্যমূল্য ও হিস্যা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করি। কিন্তু অভাব আর আড়তদারদের সিন্ডিকেটে বন্দি জেলেদের ভাগ্যে তা সব সময় জোটে না।
বাংলাদেশ সময়: ১১৪৫ ঘণ্টা, জুলাই ০৬, ২০১৬
এএসআর/
** ঋণের জালে বন্দি জেলে জীবন
** প্রজন্মের পর প্রজন্মের ঘাড়ে জালের জোয়াল
** জলদস্যুরা সর্বহারা পেশাছাড়া করছে জেলেদের
** পানির দেশে পানির আকাল!
** ইলিশ এলে জাগবে পাথরঘাটা, অপেক্ষায় মানুষ
** ‘প্যাড বাঁচাইতে বাঁচাইতে শ্যাষ, পিঠও বাঁচবো না’
** সেই কালরাতের ক্ষতচিহ্ন মোছেনি এখনও
** পানিতেই জীবন, পানিতেই মরণ!