খুবই নিরীহ একটি গান। যাতে নদী-প্রেম, নদী-চারিত্র্য, ভাঙা-গড়া বিবৃত।
গানের নদীকে আমরা তার ঠিকানা জানানোর দাবি করবো না। ভূ-বিজ্ঞানের জ্ঞানে এতো দিনে পৃথিবীর সকল নদীর উৎপত্তি ও গতিপথের প্রাকৃতিক বিবরণ মানুষ জেনে গেছে। আরো জেনেছে, অবিবেচক মানুষের বর্বর হাতে নদীসমূহের কি নিদারুণ কষ্ট ও হেনস্তা হচ্ছে, সেসব কথাও। সংবাদপত্রে ‘নদী মরে যাচ্ছে’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রায়ই পড়তে হচ্ছে। নদীকে দুষিত ও পীড়িত করার সংবাদও পাচ্ছি। আবার কোনো কোনো নদীকে মানুষের মর্যাদা দেওয়ার ইতিবাচক খবরও প্রকাশিত হয়েছে। অন্যদিকে, বার বার শুনতে হচ্ছে নতুন একটি প্রত্যয় ‘নদী শাসন’।
মূলত নদীকে আরও ভালো করে ব্যবহারের জন্যে আজকাল ‘শাসন’ করা হচ্ছে। হাল আমলের পণ্ডিতদের মুখে মুখে ‘নদী শাসন’ কথাটি শোনা যায়। শাসন কথাটি নিয়ন্ত্রণ, সংযমন, উপদেশ, নিদের্শ, আজ্ঞা, বিধি, সনদ, তিরস্কার, শাস্তিদান সম্বন্ধে প্রযোজ্য বলে জানাচ্ছে ‘সংসদ বাঙ্গালা অভিধান’। এসব সমাজ ও মানুষের উপর প্রয়োগ করা যায় এবং তা করাও হয়। তখন বলা হয় রাজ্যশাসন।
কিন্তু নদী শাসন? যে সত্তা স্বাধীন, সতত চলমান, তাকে কি শাসন করা চলে? করা যায় নিয়ন্ত্রণ? দেওয়া যায় বাধা? অথচ মানুষ তাই করছে। নদীতে বাঁধ দিয়ে তার স্বাভাবিক গতিপথকে পরিবর্তন করা হচ্ছে। তার প্রাকৃতিক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। যার দেশ নেই (আন্তর্জাতিক), তাকে দেশের সীমানায় অবরুদ্ধ করে রাখা হচ্ছে। যার পরিণতি সাগরের পানিতে মিশে যাওয়া, তাকে সাগরে যাওয়া থেকে থামিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এইসব বিঘ্ন সৃষ্টিকারী কর্মকাণ্ডের ফল ভালো হতে পারেনি; ভালো হয়নি। এ কারণে পৃথিবীর দেশে দেশে মানুষ পরিবেশগত সমস্যায় জড়িয়ে পড়ছে। ভুল-উন্নয়ন প্রকল্প বা অন্যবিধ কাজে বাঁধ, পরিখা, বেড়িবাঁধ, অবরোধ, পানি বন্ধক, খাল কেটে নদীর পানি অন্যত্র সরিয়ে যাওয়ার মতো নদীর বিরুদ্ধের অমানবিক অত্যাচার-অপরাধের প্রতিফল মানব সমাজকেও আক্রান্ত করছে।
বাংলাদেশের উদাহরণ লক্ষ্য করলে দেখতে পাই যে, ‘নদীর প্রতি অপরাধ’ এখানে হয়েছে এবং হচ্ছে। পাকিস্তান আমলে কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দিয়ে ‘কাপ্তাই ড্যাম’ করা হয়েছিল, যার পরিণাম ভালো হয়নি। বর্তমান বাংলাদেশে তিস্তা, টাঙ্গন, মনু, নবগঙ্গা ও মুহুরী নদীতে ব্যারেজ দেওয়া হয়েছে, যার ফলও শুভ হচ্ছে না।
ইতিহাসের পাতায় তাকালে দেখতে পাই যে, বিগত পাকিস্তান আমলের ২৪ বছরের শাসনে বাঙালি জাতির মতো এ জাতির নদীগুলোকেও শাসন-শোষন করা হয়েছে। ১৯৫৭ সালে বর্তমান বাংলাদেশে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার নদী শাসন সংক্রান্ত যে পরিকল্পনা হাতে নেয়, তার ভিত্তি ছিল ‘ক্রুগ মিশন রিপোর্ট’। এতেই প্রথমবারের মতো নদীতে বাঁধ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ইপিওয়াপদা স্থাপিত হয় ১৯৫৯ সালে। এ প্রতিষ্ঠানটি নদী শাসনের কাজে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিকে নিযুক্ত করে। তাদের সুপারিশে গঙ্গা-ব্রক্ষ্মপুত্র ব্যারেজ ও সেচের জন্য ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করার কথা ছিল। বলা বাহুল্য, আমাদের প্রকৌশলীদেরও এরই মাধ্যমে প্রথমবারের মতো হাতেখড়ি হলো নদীতে বাঁধ দেওয়ার এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণের নামে বহু বেড়িবাঁধ, স্লুইসগেট দিয়ে পানি নিয়ন্ত্রণ, ক্রস ড্যাম ইত্যাদি তৈরির কাজ করবার। ফলে ওয়াটার লগিং বা জলাবদ্ধতা নামে নতুন সমস্যার উদ্ভব হয়। নদী শাসনের বিপদ সম্পর্কেও তখন বলেছিলেন কেউ কেউ; কিন্তু সে কথা আমলে নেন নি পাকিস্তানের মাথা মোটা মাতব্বর বা নীতি নির্ধারকরা।
নদী শাসন থেকে প্রধাণত যে সমস্যাটির উদ্ভব হয়, তাহলো প্রতিবেশগত ভারসাম্যহীনতা। সেই সঙ্গে নেমে আসে নানা দুর্যোগ। একটি প্রাকৃতিক ধারাকে বিনষ্ট করা যে কোনভাবেই সমীচিন হয় না, তা ইতিহাসের নানা পর্যায়ে নানা দেশের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা গেছে।
পাকিস্তানের আসওয়ান বা ভারতের বিভিন্ন বাঁধের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করে বিশেষজ্ঞরা দেখেছেন যে, এজন্য লাভের চেয়ে ক্ষতি হয়েছে বেশি। নেপালের অভিজ্ঞতাও দুঃখজনক। সেখানে গঙ্গায় পতিত কোশি নদীতে বাঁধ দেওয়া হয়েছিল। বাঁধের পরিকল্পিত ফল লাভ করা যায় নি। সেখানে পলি জমে পানির ধারণ ক্ষমতা কমে যায়, বন্যা দেখা দেয়। ‘কুলেখান জলাধার’-এর জীবনকাল ধরা হয়েছিল একশ’ বছর। মাত্র তের বছরেই তা অকেজো হয়ে পড়ে।
সবচেয়ে আশ্চর্য, এতো সব জেনেও লোভী ও স্বার্থপর মানুষ নদীতে বাঁধ দিয়েই চলেছে। বিশ্বব্যাপী প্রায় প্রতিটি দেশেই নদীর বিরুদ্ধে এই অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। আমরা মানুষ, পশুপাখি, মাছ, গাছ, উদ্ভিদ, জীবজন্তু ধ্বংস এবং পরিবেশ বিনষ্ট করছি বিভিন্ন নামের নদী বিষয়ক উন্নয়ন পরিকল্পনার মাধ্যমে। বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য দাতা সংস্থা এই ধ্বংসযজ্ঞে টাকা ও কৃৎকৌশল ধার দিচ্ছে উদারহস্তে ও উদারসুদে। পরবর্তী বিপদগুলো থেকে যাচ্ছে মানুষের জন্য।
আবার বাংলাদেশের উদাহরণে আসি। বাংলাদেশের যে অংশ দিয়ে গঙ্গা বয়ে চলে এবং সাগরে গিয়ে পড়ে তার উপর বাঁধ দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার ‘গেনজেস ব্যারাজ প্রজেক্ট’ হাতে নেয়, যদিও সেটা কার্যকর করতে পারেনি, কারণ, গঙ্গায় পানিই নেই! পানির অভাবে আমাদের সবচেয়ে বড়ো সেচ প্রকল্প ‘তিস্তা ব্যারাজ’ অকেজো হয়ে পড়েছে। দেশের অভ্যন্তরে যেসব মাঝারি ও ছোট নদীতে অস্থায়ীভাবে সময় সময় যে বাঁধ দেওয়া হয়, তার ফলও ভালো হয়নি। কর্ণফুলীতে বাঁধ দিয়ে কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের ফলে কি ভয়াবহ রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা দেখা দেয়, সে তথ্য সবারই জানা। আজকের পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার অন্যতম মূল কারণ এই নদী শাসনের ভুলের মধ্যেই নিহিত।
১৯৬০ দশকে কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দিয়ে ৩৫০ বর্গমাইল কাপ্তাই লেক সৃষ্টি করা হয়। এখন সেখানে আর পরিকল্পনা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় না। অন্য দিকে যখন ১৯৬২ সালে কাপ্তাই বাঁধ কার্যকর হয়, তখন প্রায় ১০৩৬ বর্গ কিলোমিটার এলাকা ভেসে যায়। পাহাড়ি এলাকার স্বল্প কৃষি জমির মধ্যে ৪৫ ভাগই পানির তলে ডুবে যায়। প্রায় এক লক্ষ লোক তাদের পৈত্রিক ভিটে মাটি হারিয়ে গৃহহীন উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়। এদের অনেকেই যথার্থ ক্ষতিপূরণ পায়নি; পুনর্বাসিত হয়নি। এরা সব হারানোর বেদনায় ক্ষুব্ধ হয়ে সংগ্রাম করেছে। পরে অসৎ ও মতলববাজ স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব এদেরকে বিপথগামী করেছে। এজন্যই নদীতে হাত দেওয়ার আগে নানা দিক হাজার বার ভেবে দেখা দরকার।
শুধু দেশের ভেতরেই নয়, বাইরে থেকেও সমস্যার উদ্ভব হচ্ছে; শাসিত হচ্ছে নদী। যেমন, বাংলাদেশের সীমান্ত নদ-নদীর সংখ্যা ৫৪। বন্ধুত্ব ও মৈত্রীর মাধ্যমে এসব নদীকে যথাযথ ব্যবহার করতে হবে। সমস্যা ও সঙ্কট সমঝোতা ও পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে সুরাহা করতে হবে। দু’দেশের মধ্যে পানি বণ্টন চুক্তিই শুধু নয়, এমন সমঝোতাও রয়েছে যে, একদেশ এমন কিছু করবে না, যাতে অন্য দেশের অসুবিধা হয়। এসব বিষয়ে সকল পক্ষকেই মনোযোগী হতে হবে।
দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত-বাংলাদেশ, ভারত-পাকিস্তান, ভারত-নেপালের মধ্যেও পানি নিয়ে টানাপড়েন চলছে। কোন এক পণ্ডিত একদা বলেছিলেন, ‘ভবিষ্যতে পৃথিবীতে সংঘাত হবে পানির জন্য’। উপমহাদেশে তেমন কোনো সমস্যার উদ্ভব হওয়ার আগেই রাজনীতিবিদদের তরফ থেকে বিজ্ঞজনোচিত পদক্ষেপ গ্রহণ করে সমাধান সূত্র খুঁজে বের করতে হবে।
পানি ও নদী শাসনের সমস্যা আমাদের চোখে ধরা না পড়লেও একজন মার্কিন লেখকের চোখে ঠিকই ধরা পড়েছে। তার নাম জেমস নোভাক। এদেশের ভূ-প্রকৃতি, বিশেষ করে নদী, বৃষ্টি, পানি, ঋতু, তরুলতা, মানুষ, পশুপাখি, এক কথায় বাংলাদেশের পরিবেশকে তিনি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। নদী শাসন এবং পানিপ্রবাহ বন্ধ করার বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কথাও তিনি পূর্বাভাস করেছিলেন। আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে লেখা এসব প্রসঙ্গে তার গ্রন্থ ‘বাংলাদেশ: রিফ্লেকশন অন দ্য ওয়াটার’ বঙ্গানুবাদে ‘বাংলাদেশ: জলে যার প্রতিবিম্ব’ নামে প্রকাশ পায়। এই গুরুত্বপূর্ণ বইটির নাম আজকাল আর শোনা যায় না। এখন কেউ বইটি পড়েন বলেও মনে হয় না। নোভাকের কথা এবং সতর্কবানী কেউ শোনেনি। শুনলে নদী মার্তৃক বাংলাদেশের নদীগুলোর অসহায় অবস্থা হতো না। বিপণ্ন নদীগুলোর অবিরাম আহাজারি আর কান্নাও শুনতে হতো না।
ফিনল্যান্ডে অধ্যয়নরত এক বাংলাদেশি ছাত্র নদী নিয়ে গবেষণায় উল্লেখ করেছিলেন, নদীর পানি সরিয়ে নিলে আমাদের নদীগুলো মারা যাবে; শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে যাবে। হয়তো আমাদের স্বপ্নের যমুনা ব্রিজের নিচ দিয়ে হেঁটে যাবে কঙ্কালসার মানুষ; ট্রাক-লরি-গরুর গাড়ির হতাশ মিছিল। যে বাংলাদেশের ২০ মিলিয়ন কৃষক আমাদের এখনও ভাত যোগায়, পানির অভাবে আমাদের জীবনযাপন হবে চরম ভারসাম্যহীনতা ও বিপর্যয়ের শিকার। সবুজ-শ্যামলিম বাংলাদেশ হবে অসম্ভব কল্পনাবিলাস।
হাওরের অকাল বন্যা ও বিপর্যয়ের পেছনেও কেউ কেউ অপরিকল্পিত নদী শাসনের অভিযোগ করেছেন। বাংলানিউজ-এর প্রতিনিধিরা সরেজমিনে সেখানকার করুণ চিত্র উপস্থাপন করেছেন। কৃষি, কৃষক, প্রকৃতি ও পরিবেশে চরম ক্ষতির বিবরণও জানিয়েছে বাংলানিউজ। ভৈরবে পাশাপাশি ব্রিজ করার ফলে শঙ্কাগ্রস্ত হয়েছে প্রমত্তা মেঘনা। বাংলানিউজের সাংবাদিক জাকারিয়া মন্ডল সচিত্র রিপোর্টে আগাম সতর্কতা জানালেও সংশ্লিষ্টরা কতটুকু সচেতন কে জানে?
ঘোরতর আভ্যন্তরীন ও বহিস্থ নদী শাসনে বিপর্যস্ত বাংলাদেশের নদীগুলোকে কি আর জিজ্ঞেস করতে হবে: ‘ও নদীরে, একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে: নদী শাসনে তুমি কি ভালো আছো?’’ কঠিন বাস্তবে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বাঁচার প্রয়োজনেই নদী নয়, পুরো জাতিকেই দিতে হবে এ প্রশ্নের উত্তর; খুঁজতে হবে এ সমস্যার সমাধান।
ড. মাহফুজ পারভেজ: কবি ও লেখক, অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশ সময়: ১৬০০ ঘণ্টা, মে ১৭, ২০১৭
জেডএম/