ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জলবায়ু ও পরিবেশ

মাঘের শুরু: শীতার্ত চরাচর

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬১৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০১৮
মাঘের শুরু: শীতার্ত চরাচর ভয়ানক শীত আর কুয়াশার আগ্রাসনের কবলে গোটা দেশ। ফাইল ছবি

রোববার (১৪ জানুয়ারি) মাঘ মাসের শুরুর দিনটিতে সদ্য-বিগত ২০১৭ সাল থেকে নতুন ২০১৮ সালে আসার রাস্তাটুকুকে মনে হচ্ছে ‘অন্তবিহীন পথ’।

ওরহান পামুকের ‘স্নো’ উপন্যাসের পটভূমির মতো ঝাপসা কাচের মতো ভারী কুয়াশায় মোড়ানো শীতার্ত চরাচরের আবছা-বন্ধুর পথকে মনেই হয় না রবীন্দ্রনাথের সেই চিরায়ত পথের মতো: ‘পেরিয়ে এলাম অন্তবিহীন পথ/আসিতে তোমার দ্বারে/মরুতীর হতে সুধা-শ্যামলিম পারে। ’

হয়ত চলতি বছর পুরোটা শেষ হলে আলোচিত ঘটনার তালিকায় অন্য কিছু আসবে কিন্তু বছরের প্রথম প্রধান ঘটনাটি যে ‘শীত’, এ ব্যাপারে কেউই সংশয় প্রকাশ করবেন না।

বাংলাদেশেই শুধু নয়, সমগ্র বিশ্বেই শীত এক তাণ্ডব হয়ে দাঁড়িয়েছে চলতি সময়ে। পরিবেশ ও জলবায়ুর চিরায়ত চরিত্রের বাইরে এমন ঘোরতর শীতলতা চরম দাপটের সঙ্গে জনজীবনকে স্পর্শ করেনি অনেক বছর। মনে হচ্ছে, হিমালয় ফুঁড়ে রেকর্ড-ভাঙার দৌড়ে বন্য মোষের মতো তেড়ে আসছে সাইবেরিয়ান শীত।

পৌষের মাঝামাঝি একটি হালকা শৈত্য প্রবাহ বয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের ওপর দিয়ে। তাতেই তাপাঙ্কের কাঁটা অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙে নেমে যায় ২.৬ ডিগ্রিতে। রোববার (১৪ জানুয়ারি) মাঘের শুরু হলো। এবং আসল শীতের হামলাটি এখনই হবে বলে আগাম জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা। ‘মাঘের শীতে বাঘ পালায়’ শীর্ষক প্রবচনটি যদি বাস্তবে প্রকাশ পায়, তবে মানুষের কী দুর্বিষহ অবস্থা হবে, সেটা সহজেই অনুমেয়।

মাঘের শীতের অস্বাভাবিক দাপটে সব কিছু হিম হয়ে গেলে আপামর মানুষের ভোগান্তির শেষ থাকবে না। তাদের জীবন এবং জীবন-যাত্রা উভয়টিই বিপন্ন হবে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ চিরকালই উষ্ণ-ভাবাপন্ন নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডলীয় দেশ। চরম-ভাবাপন্ন গরম বা শীত এদেশের আবহাওয়ার ইতিহাসে নেই বললেই চলে। কিন্তু বৈশ্বিক আবহাওয়া যেভাবে বদলে যাচ্ছে, নানা রকমের পালাবদল যেভাবে হচ্ছে, তাতে এদেশের আবহাওয়ার ঐতিহ্যটিও আর টিকে থাকতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। বিগত বছরেই আমরা দেখেছি প্রলম্বিত বর্ষা, যা শরত পেরিয়ে হেমন্তকালকেও ছুঁয়ে গিয়েছিল। আর দেখেছি অস্বাভাবিক-অস্বস্তিকর গরম। গরম আর বর্ষার চরম ভাবটা নাগরিক জীবনে বিরাট বড় রকমের একটি নাড়া দিয়ে গিয়েছে।
আবহাওয়ার বিরূপতার সেই স্মৃতি মুছতে না মুছতেই শীত এসেছে চরম আকারে। এদেশের মানুষের স্মৃতি ও অভিজ্ঞতায় যে হাল্কা-মধুর শীতের বিবরণ এ যাবৎকাল ধরে বিরাজ করছিল, সেটা আর টিকছে না। হু হু বাতাস, কুয়াশার অলঙ্ঘনীয় আস্তরণ, সূর্যের অনুপস্থিতি শীত নামক মায়াবী ও রোমান্টিক ঋতুটিকে প্রবল আতঙ্কের বিষয়ে পরিণত করে তুলছে। সন্ধ্যা নামতেই রাস্তাঘাট ফাঁকা হচ্ছে। প্রবল আড়ষ্টতা ও শীত যেন ভয়াবহ দৈত্যের মতোই জাপটে ধরছে সবাইকে।
বাংলাদেশের গ্রাম বা শহরের আবাসন ব্যবস্থা এবং মানুষজন এমন শীতের সঙ্গে মোটেও পরিচিত নয়। উত্তরমেরুর মতো চরিত্র নিয়ে আসা শীতকে প্রতিহত করার প্রস্তুতিও নেই আমাদের বাসস্থানের নির্মাণশৈলী ও জীবন-যাপনে। ফলে শহর, বন্দর, গ্রাম, গঞ্জ, নদীতীর, চর কিংবা পাহাড়ের মানুষ শীতে কাবু, বিহ্বল ও হতচকিত।

শীত যে কেবল বাংলাদেশেই বিরূপ, এমনটি মোটেও নয়। ভারতে শীতে মানুষ মারা যাচ্ছে। ইউরোপের
শীতের দেশগুলো থেকেও ভয়াবহ সব খবর আসছে। কানাডা বা আমেরিকার শীত-প্রধান অঞ্চলের মানুষেরাও বরফের নিচে হিমাঙ্কের মাইনাস ডিগ্রিতে জিম্মি হয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। সেসব দেশের শীতও নানা রকম দুর্ভোগ তৈরি করছে। তারাও কবুল করেছেন যে, শীতের তীব্রতা এতো মারাত্মক আগে আর কখনোই হয়নি!
মনোযোগ দিলেই দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের সকলের সঙ্গে সঙ্গে আমরা একটি পরিবর্তনশীল আবহাওয়ার জগতের দিকেই ধাবিত হচ্ছি। ধীরে ধীরে বিশ্বের আবহাওয়ার যে পরিবর্তন হচ্ছিল, সেটা হাতেনাতে টেরও পাচ্ছি।
জলবায়ু ও আবহাওয়ার মধ্যে নানা বিরূপ প্রতিক্রিয়া, উষ্ণায়ন, হিমবাহের ভাঙন, মহাপর্বতে ফাটল, ওজোন স্তর হ্রাস ইত্যাদি নানা ভীতিকর পরিস্থিতির কথা বারবার বলা হচ্ছিল। পরিবেশ, জীব-জগৎ, প্রাণবৈচিত্র্য, ভূমিরূপ ইত্যাদিকে নানাভাবে নস্যাৎ করে আমরাই যে আমাদের বিপদ ডেকে আনছি, সেকথাও নানা গবেষণায় উল্লেখিত হয়েছে এবং হচ্ছে। বলা হচ্ছে, মাত্রাতিরিক্ত যান্ত্রিকীকরণ, জ্বালানি পোড়ানোর হার বৃদ্ধি ইত্যাদির মাধ্যমেও আমরা জগতের পরিবেশকে ক্ষুন্ন করছি। এই আমরা মানে, বিশ্বের সবাই। অগ্রসর-আধুনিক দেশগুলো সে দৌড়ে বরং এগিয়েই আছে।

গাছপালা কেটে সাফ করে, জীবজন্তু-কীটপতঙ্গ মেরে, নানা রকমের সার ও কীটনাশক অবাধে ব্যবহার করে পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদকে অতি-ব্যবহারে জীর্ণ করে ফেলা হচ্ছে। সবুজ এই ধরিত্রীকে করে ফেলা হয়েছে রঙহীন, খানিকটা পাণ্ডুর ও লুণ্ঠিত। এই দায় এখন এসে চেপে বসছে সবার ওপর। প্রকৃতির প্রতিশোধের মতো নানা রকমের চরমাবস্থা বৃদ্ধি পাচ্ছে এজন্যই। শীতে বৃষ্টি হচ্ছে, গরমে ছটফট অবস্থা হচ্ছে, বর্ষা পাঁজি-পঞ্জিকা মানছে না। পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই চরম পরিস্থিতি নেমে আসছে একটির পর আরেকটি। মানুষ যে পরিস্থিতির সঙ্গে অভ্যস্ত নয়; মোকাবেলার জন্যও তৈরি নয়।

বাংলাদেশের চলমান শীতের মধ্যেই আরও প্রবলতা নিয়ে বড় ধরনের শৈত্য প্রবাহ আসার ঝুঁকি রয়েছে। ফলে শীতের দানবীয় হামলা থেকে মানুষকে বাঁচানো একটি বড় রকমের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাত্র কয়েকটি শহরের নিরাপদ আবাসনের বাইরে যে কোটি কোটি মানুষ গ্রামে বা ফুটপাতে অনিরাপদ বা জরাজীর্ণ অবস্থার মধ্যে আছেন, তারাই শীতের হামলার সরাসরি শিকারে পরিণত হবেন এবং সঙ্গত প্রয়োজনেই তাদের দিকে অতিদ্রুত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। কিছু কিছু কার্যক্রম যদিও শুরু হয়েছে, তথাপি একেই যথেষ্ট মনে করার কারণ নেই। যে কোনও প্রাকৃতিক আঘাত ও বিপর্যয়ের জন্য সার্বক্ষণিক ও সার্বিকভাবে প্রস্তুত থাকারও দরকার আছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বিশ্বের পরিবেশ ও জলবাযুর পরিবর্তনের বিষয়টিকে সঠিকভাবে অনুধাবন করা প্রয়োজন। জীবনযাত্রা ও বসবাসের ব্যবস্থাতেও সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। পাশাপাশি পরিবেশকে সহনীয় রাখতে ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ সামাল দিতে অধিক হারে বৃক্ষরোপণ, জীব ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা করা, নদীর নাব্যতা বাড়ানো, পাহাড় কর্তন ও নদী দখল প্রতিহত করা এবং রাসায়নিক সার, কীটনাশক, জ্বালানি ও শক্তির পরিমিত ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোও আমরা যে ক্রমে ক্রমেই একটি চরম আবহাওয়ার আগ্রাসী তাণ্ডবের মধ্যে আবদ্ধ হচ্ছি, এ বাস্তবতাকে যথাযথ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নকে অগ্রাধিকার দিয়ে অচিরেই তাকে মোকাবেলা করার পথ বের করতে হবে। প্রকৃতিকে কতটুকু জয় করা যায়, সেটা সুনিশ্চিত নয়। কিন্তু প্রকৃতিকে যে সহনীয় করা যায়, সেটা খুবই সম্ভব। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সমুদ্র, জলোচ্ছ্বাস ও আবহাওয়াকে আয়ত্বে রেখেই বিশ্বসেরা হয়েছে।

সম্ভবত আমাদেরও আবহাওয়া ও জলবাযুর বিষয়ে অধিকতর মনোযোগী হওয়ার সময় এসেছে।
বাংলাদেশ সময়:১২০৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০১৮
এমপি/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।