ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

ভয়ঙ্কর দস্যুজীবন থেকে স্বাভাবিক জীবনে

রফিকুল ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৩০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৪, ২০১৪
ভয়ঙ্কর দস্যুজীবন থেকে স্বাভাবিক জীবনে

মুছাপুর, কোম্পানীগঞ্জ, নোয়াখালী  ঘুরে এসে: এককালে বন আর চরাঞ্চলে দাপিয়ে বেড়ানো সেই ‘ভয়ংকর’ মানুষগুলো ঘরে ফিরেছে। জীবনের বড় সময়টা দস্যুতায় কাটিয়ে এখন তারা স্বাভাবিক জীবনে।

কেউ কেউ পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে সমাজে মিশে যেতে পারলেও অনেকের ঘটেছে মস্তিষ্ক বিকৃত। অসংখ্য মামলার প্রচীর ভেদ করে এসে এই মানুষেরা এখন যেন পথ হারানো পথিক।

জীবনের একটা বড় সময় দস্যুতায় কাটানো মানুষগুলোর জীবনচিত্রের বিবরণ মেলে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের মুছাপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে। এইসব গ্রামরে কাছেই ছিল ঘন বন, বিচ্ছিন্ন জনপদ উড়িরচর। আর সেখানেই দস্যুতা চলতো প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধর। ে বাবার সঙ্গে ছেলে, চাচার সঙ্গে ভাইয়ের ছেলে, বড় ভাইয়ের সঙ্গে ছোটভাই দস্যু বাহিনীতে যোগ দিত।

দস্যুদের অনেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরলেও সেই এলাকায় এখনও আতংক বিরাজ করে। দস্যু বাহিনীর ধরা না পড়া সদস্যরা আবার নতুন বাহিনী গড়ে তোলে। আর তাই দাপুটে দস্যুদের বিচরণে সেই বিচরণক্ষেত্র কখনোই আতংকমুক্ত হয় না।

সরেজমিন ঘুরে মুছাপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের মানুষের কাছ থেকে বাংলানিউজ জানতে পারে, ইউনিয়নের ছোট ফেনী নদীর তীরে রেগুলেটর এলাকায় ছিল ঘন বন। এখান থেকে ঠিক ওপারেই দুর্গম উড়িরচর। এই গোটা এলাকায় দস্যুবাহিনীর রাজত্ব ছিল। চাষিদের গরু-মহিষ নিয়ে যাওয়া, পাকা ধান লুট, লোকজন ধরে নিয়ে যাওয়া, জেলেদের আটক করে মুক্তিপণ আদায়ের মত অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল এইসব বাহিনী।

মুছাপুর ইউনিয়নের রেগুলেটর এলাকার যে স্থানে বসে মানুষের সঙ্গে কথা বলি, সেখানে বলতে গেলে মানুষজন যাতায়াতই করতে পারতেন না। দিনের আলোতেও ভয় ছিল দস্যুদের। এমনকি এখানে রেগুলেটর প্রকল্পের কাজ শুরু করতে এসেও নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের লোকজন দস্যুদের মুখোমুখি হয়েছে। হুমকির মুখে পড়ে চাঁদা দিতে হয়েছে।

দস্যুজীবন ছেড়ে কেমন আছেন তারা, কীভাবেই বা ত্যাগ করেছেন ওই ভয়ংকর পেশা। স্বাভাবিক জীবনে ফেরা দস্যু, তাদের স্বজন কিংবা এলাকাবাসীর সঙ্গে আলাপ করে এ বিষয়ে নানান তথ্য মেলে।

জাহাঙ্গীর আলম। বয়স ত্রিশের কোঠায়। অতি অল্প বয়সে নিজের আপন চাচা আবসার বাহিনীতে যোগ দেন। তখন বয়স মাত্র ১৯-২০ বছর। বাহিনীর অধীনে চাষিদের জমিজমা দখল, ধান লুটসহ বিভিন্ন কাজে নেতৃত্ব দিতেন জাহাঙ্গীর। তার কাছে ছিল অস্ত্র।

চুরি, ডাকাতি, গরু ছিনতাই, পুলিশ ফাঁড়ি ভাংচুরসহ বিভিন্ন ঘটনায় ২০-২৫টি মামলা হয় জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে। এক সময় নিজেই বাহিনী থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করে। অবশেষে ২০০৮ সালে ফেওে স্বাভাবিক জীবনে। স্ত্রী আর এক কন্যা নিয়ে তার বসবাস মুছাপুর ইউনিয়নের ৭নম্বর ওয়ার্ডে। রেগুলেটর এলাকায় একটি ছোট্ট দোকান দিয়েছে।

তছির আহমদ। দস্যু বাহিনীর এক বড় নেতা। নিজের নামেই ছিল বাহিনীর নাম। তছির মাঝি নামে তার ছিল পরিচিতি। বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল ৩০-৩৫ জন। বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে আত্ম গোপনের জন্য চল্লিশ বছর বয়সে দস্যু বাহিনীতে যোগ দেন। নানান অপরাধের মধ্যে তার অন্যতম কাজ ছিল ট্রলারের মাছ লুটপাট। ১৪টি মামলায় হাজিরা দিতে দিতে এক পর্যায়ে স্বাভাবিকে ফিরেছেন তিনি। তবে অত্যাচার নির্যাতনে তিনি এখন অনেকটাই মস্তিষ্ক বিকৃত।

আবছার মেম্বার। ১৯৯৯ সাল থেকে দস্যু বাহিনীর দলে। নিজেই বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন বলে নিজের নামেই বাহিনী। দলে ছিল ৫০-৬০ জন সদস্য। নদীতে ডাকাতি করে এই বাহিনীর সদস্যরা রেগুলেটর এলাকার বাগান বাড়ির আস্তানায় আশ্রয় নিত। একবার দলে দু’পক্ষের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে বাহিনীপ্রধান আবছার গুরুতর আহত হয়ে মৃত্যুশয্যায় চলে যান। পুলিশ তাকে মুমূর্ষু অবস্থায় গ্রেফতার করে। তিন বছর পর জেল থেকে ছাড়া পেয়ে পাগলপ্রায় অবস্থায় স্বজনদের কাছে ফেরেন।

ভুট্টো। বাড়ি চর ফকিরা ইউনিয়নের গুচ্ছগ্রামে। নিজের নামেই ছিল বাহিনীর নাম। আস্তানা ছিল কোম্পানীগঞ্জের উড়িরচর এলাকায়। বর্তমানে দাপুটে জাসু বাহিনীর সঙ্গে তার ঘনিষ্ট যোগাযোগ ছিল। সেই উড়িরচর থেকেই যৌথবাহিনীর এক অভিযানে ধরা পড়ে ভুট্টো। মাত্র ৩০ বছর বয়সে দস্যু বাহিনীতে যোগ দেন তিনি। জেল থেকে বের হওয়ার আগেই এই পথ ছেড়ে দেয়ার অঙ্গীকার করেন। ২০১১ সাল থেকে স্বাভাবিক জীবনে।

হাশেম মাঝি। নিজের নামে গড়া তার বাহিনীতে সদস্য ছিল শতাধিক। আধিপত্য ছিল চর হাজারী এলাকায়। নিজের ট্রলার ছিল। বাহিনীর তৎপরতা ছিল নদীপথে। মহিষ-ভেড়া ও জেলেদের নৌকায় হামলা করতো। মুক্তিপণ আদায় করতো। ২০০৯ সালে যৌথবাহিনীর অভিযানে গ্রেফতারের পর তাকে ক্রশফায়ারে দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার কারণে দেওয়া হয়নি। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে নিজের সেই কলংকিত ট্রলারটি বিক্রি করে ওমরাহ হজ্জ পালন করেন। সেই থেকেই স্বাভাবিক জীবনে।

নেয়ামত। রেগুলেটর এলাকায় টিপু বাহিনীর পরে এই নেয়ামত বাহিনী মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এই বাহিনীর সদস্যরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান নিত। এলাকায় গরু-মহিষ, ধান এমনকি বাড়িঘর লুট করে ট্রলারে তুলে নিয়ে যেত। ২০১৩ সালে গোপন সূত্রের খবরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পায়ে গুলি করে নেয়ামতকে গ্রেফতার করে। কেটে ফেলতে হয়েছে তার গুলিবিদ্ধ পা। অন্যদিকে তার বাহিনীতে থাকা দস্যুরা দলছুট হয়ে গেছে।

এলাকাবাসী বলছেন, দস্যু দমনে বার বার অভিযান চলে। অনেক দস্যু গ্রেফতার হয়। অনেকে ফেরে স্বাভাবিক জীবনে। এদের সহযোগীরা অবার গড়ে তোলে নতুন বাহিনী। এভাবেই বাহিনীর অত্যাচার চলে আসছে যুগ যুগ ধরে।

বাংলাদশে সময়: ০০০২০ ঘণ্টা, ফব্রেুয়ারি ০৪, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।