ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

সমুদ্র মোহনায় দুর্যোগের ভয়

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৪৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২০, ২০১৪
সমুদ্র মোহনায় দুর্যোগের ভয় ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

রহমতপুর, সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম থেকে: গত বর্ষা মৌসুমে ঘূর্ণিঝড়ে হেলে পড়া বেড়িবাঁধের পাশের ছোট্ট ঘরটা এক বছরেও মেরামত করা সম্ভব হয়নি। চারদিকে রশি টানা দিয়ে কোনোমতে ঘরটাকে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে।

বেড়ার ওপরে পলিথিন দেওয়া হয়েছে। চালার ক্ষয়ে যাওয়া স্থানেও পলিথিন দেওয়া হয়েছে। তার ওপর ছেঁড়া জাল দেওয়া হয়েছে। এবারের বর্ষা মৌসুমে ঝড়-ঝাপটায় ঘরখানা টিকবে কীনা জানেন না ঘরে বসবাসকারী বিপন্ন মানুষেরা।

দ্বীপ সন্দ্বীপের পশ্চিমে রহমতপুর ইউনিয়নের বেড়িবাঁধ লাগোয়া এলাকার মানুষের দুর্যোগ আতঙ্ক কখনোই শেষ হয় না। কেউ ৭-৮ বার, কেউবা ৯-১০ বার বাড়ি পরিবর্তন করলেও তাদের জীবনে স্বস্তি নেই। স্বাভাবিক জীবনযাপন বা মৃত্যুর কোনো গ্যারান্টি নেই। আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে তারা না পারছেন নদীতীর থেকে দূরে কোথাও জমি কিনে ঘর বানাতে, আবার না পারছেন ঘর মেরামত করে ভালোভাবে বসবাস করতে।

সন্দ্বীপের রহমতপুর ইউনিয়নের মেঘনা তীরবর্তী এলাকাটিতে সরেজমিনে ঘুরে মানুষের দুর্ভোগ আর দুর্যোগ ঝুঁকির কথা জানতে পারে বাংলানিউজ। বেড়িবাঁধের পাশে বসবাসকারী বাসিন্দারা জানালেন, নদীতে পানি বাড়লেই তাদের আতঙ্ক বেড়ে যায়। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে এ এলাকার বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, অনেকে হয়েছেন স্বজনহারা। ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব থেকে বেঁচে যাওয়া স্বজনেরা এখনও সেই শোক ভুলতে পারেননি।

বেড়িবাঁধ তীরবর্তী মানুষেরা জানালেন, ভয়াল মেঘনার তীরবর্তী এ এলাকাটি বঙ্গোপসাগরের মোহনায় হওয়ায় এখানকার মানুষের জীবনের ঝুঁকি অনেক বেশি। একদিকে মেঘনা যুগ যুগ ধরে এখানকার মানুষদের তাড়িয়ে ফিরছে। বাপ-দাদার সম্পদ হারিয়ে মানুষগুলো নিঃস্ব হয়ে বাঁধের ধারে ঠাঁই নিয়েছেন। অন্যদিকে প্রত্যেক বর্ষায় কোনো না কোনো দুর্যোগ লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছে বাড়িঘর। মানুষের পেশা বদলে যাচ্ছে, জীবিকার ধরন বদলে যাচ্ছে, অনেকে কর্মহীন হয়ে পড়ছেন। দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাসেও পরিবর্তন আসছে।

পড়ন্ত বিকালে মেঘনার তীরের ছোট্ট চায়ের দোকানে বেশ কয়েকজন কর্মহীন মানুষের সঙ্গে দেখা মেলে বাংলানিউজের। তাদেরই একজন জানালেন, নদী ভাঙনে নি:স্ব মানুষগুলো বাঁধের ধারে ঠাঁই নিয়েও রেহাই পাচ্ছেন না। ভাঙন কিছুটা কমলেও এখানকার মানুষের সামনে এখন তিন সমস্যা। সংস্কারবিহীন বেড়িবাঁধ, পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টার না থাকা এবং কাজের অভাব এসব মানুষদের জীবনকে সবদিক থেকেই পিছিয়ে রেখেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপন্নতার প্রভাব পড়ছে জীবনের সব স্তরে।

দুর্যোগে বিপন্ন ঘরবাড়ির খোঁজ নিতে গেলে রহমতপুর ১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা শাহানা বেগম কান্নায় ভেঙে পড়েন। জানালেন, ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে স্বজন হারিয়েছেন, নিজেও মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেছেন। দুর্যোগের সিগন্যাল শুনলে এখনও তারা আতঙ্কে থাকেন বলেও জানান তিনি।

ঝুঁকির মুখে থাকা রহমতপুরের ১ নম্বর ওয়ার্ডের নদীতীরের বেড়িবাঁধ সংস্কার হয়নি। বাঁধ ঘুরে দেখা গেলো অনেক স্থান ঝুঁকিপূর্ণ। বর্ষা সামনে রেখে এখানকার মানুষের মনে আতঙ্ক। বাঁধের ভেতরে ঝুঁকির মুখে রয়েছে প্রায় ৫শ’ মানুষ। দিন আনা দিন খাওয়া এই মানুষগুলো আর্থিক সংকটের কারণে অন্য কোথাও যেতে পারছেন না। এলাকার মানুষের কাছে ‘সুদিন’ বলে পরিচিত চলতি মৌসুমেও অনেকে কর্মহীন বসে আছেন।

সফিকুল আলম, বয়স ৫৫ বছর। রহমতপুর ১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। নদী ভাঙনের কারণে চার বার বাড়ি বদল করেছেন। বেড়িবাঁধের কিনার ধরেই বসবাস। পরিবারের ৮ জনের মুখের খাবার যোগাড় করতে হয়। মাসিক খরচ প্রায় ১০ হাজার টাকা। ধারকর্জ করে কোনোমতে চালিয়ে নিচ্ছেন।

আবুল বাশার, বয়স ৬০ বছর। এখনও জীবিকার তাগিদে কঠোর পরিশ্রম করেন। নেমস্তি ইউনিয়ন থেকে বাড়ি বদল করতে করতে রহমতপুরে ঠাঁই হয়েছে তার। বাড়ি বদল করেছেন ৬ বার। সাতজনের খাবার যোগাড়ে তার ভূমিকাই প্রধান। মাসে খরচ হয় প্রায় আট হাজার টাকা। এক ছেলে তাকে সহায়তা করেন বটে, কিন্তু তার হাতেও কাজ থাকে না সব সময়।

মো. কামাল, বয়স ৪০ বছর। পাঁচবার বাড়ি বদল করে রহমতপুরে ঠাঁই হয়েছে তার। আগেও দিনমজুরি করে দিন চলতো, এখনও একই কাজ। তবে কাজ আগের চেয়ে কমে গেছে। সপ্তাহে ৩-৪ দিন কাজ থাকে, বাকি সময় বেকার। ঘরের চারজন লোকের খাবার যোগাড়, তার ওপর ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার খরচ যোগাতে হয়। অন্য সবার মতো বাঁধের ধারের এই পরিবারটিও সব সময় দুর্যোগ ঝুঁকিতে থাকে।

এলাকাটি সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, দুর্যোগের ঝাঁপটা থেকে বাঁচতে এখানকার মানুষেরা ঘরটা একটু নিচু করে তৈরি করেন। ঝড়ের তাণ্ডবে যাতে ঘর ভেঙ্গে না পড়তে পারে, সেজন্যে চারদিকে রশি দিয়ে টানা দেওয়া হয়। চালা দেওয়া হয় পলিথিন দিয়ে, এর ওপরে দেওয়া হয় ছেঁড়া জাল। বেড়ার বাইরেও পলিথিন মোড়ানো থাকে। অবস্থাপন্ন মানুষেরা শক্ত করে ঘর বানাতে পারলেও বাঁধের পাশের বিপন্ন মানুষেদের এর বেশি সামর্থ্য নেই।

বাংলাদেশ সময়: ০২৪২ ঘণ্টা, এপ্রিল ২০, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।