ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

দ্বিতীয় বছরে পা রাখছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৪১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০১৪
দ্বিতীয় বছরে পা রাখছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’

দেখতে দেখতে বছর গড়িয়ে গেলো। ২০১৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর বাংলানিউজে বিশেষ আয়োজন হিসেবে শুরু হওয়া ‘উপকূল থেকে উপকূল’ বিভাগ এবার পা রাখছে দ্বিতীয় বছরে।

এই এক বছর ধরে উপকূলের ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছেন বাংলানিউজের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট রফিকুল ইসলাম। এই এক বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে এবার তিনি লিখেছেন তিন পর্বের সিরিজ প্রতিবেদন। প্রথমেই পড়ুন ‘দ্বিতীয় বছরে পা রাখছে উপকূল থেকে উপকূল’ ।

সমুদ্র উপকূলবর্তী দুর্গম জনপদ ঘুরে: ব্যতিক্রমী ধারার সাংবাদিকতায় সাফল্যের এক বছর পার করলো বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম-এর ‘উপকূল থেকে উপকূল’। ২০১৩ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর এই বিভাগ চালু হয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলের তথ্য নীতিনির্ধারক মহলে পৌঁছে দিয়ে বিপন্ন মানুষকে সহায়তা করাই এ উদ্যোগের অন্যতম লক্ষ্য।

উপকূল অঞ্চলের উন্নয়ন এগিয়ে নিতে সব মহলের বিশেষ নজর বাড়াতে দেশে প্রথমবারের মত উপকূল-ভিত্তিক তথ্য প্রচারের উদ্যোগ নেয় বাংলানিউজ। কাজের ক্ষেত্র হিসাবে বেছে নেয়া হয় উপকূলের ১৫ জেলাকে। এগুলো হচ্ছে- পূর্ব উপকূলের কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, নোয়াখালী, মধ্য উপকূলের বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, ভোলা, ঝালকাঠি, বরগুনা, চাঁদপুর এবং পশ্চিম উপকূলের খুলনা বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা। এই উদ্যোগের মাধ্যমে উপকূলের তথ্য উঠে আসছে নীতিনির্ধারক মহলে। সরকারি-বেসরকারি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহায়ক হচ্ছে।

এক বছরে অবহেলায় ডুবে থাকা পশ্চাদপদ উপকূলের চর, দ্বীপ, বিচ্ছিন্ন গ্রাম আর প্রত্যন্ত জনপদের সব খবর উঠে এসেছে দেশের শীর্ষস্থানীয় এ নিউজপোর্টালে। এরইমধ্যে উপকূলের রিপোর্টগুলো ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। বিচ্ছিন্ন জনপদের সব তরতাজা খবর পাঠককে জানাতে বাংলানিউজের একজন স্পেশাল করেসপনডেন্ট অধিকাংশ সময় উপকূলীয় জনপদে অবস্থান করে প্রতিবেদন তৈরি করছেন।  

এক বছরে পূর্ব, পশ্চিম ও মধ্য উপকূলের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করেছে বাংলানিউজ। পূর্ব উপকূলের কক্সবাজার জেলার চকরিয়া, কুতুবদিয়া, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড, পতেঙ্গা, সন্দ্বীপ, নোয়াখালীর হাতিয়া, কোম্পানিগঞ্জ, সুবর্ণচর, লক্ষ্মীপুরের রামগতি, কমলনগর, রায়পুর, চাঁদপুরের হাইমচর, মধ্য উপকূলের ভোলার মনপুরা, দৌলতখান, চরফ্যাসন, পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী, পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া, পশ্চিম উপকূলের বাগেরহাট জেলার শরণখোলা, মোরেলগঞ্জ, খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা, দাকোপ, পাইকগাছা, কয়রা, সাতক্ষীরা জেলার তালা ও শ্যামনগর উপজেলার প্রান্তিক জনপদের সরেজমিন তথ্য উঠে এসেছে এই নিউজপোর্টালে। এই সময়ে দুর্যোগ, জীবন-জীবিকা, মানবাধিকার, দুর্নীতি, পরিবেশ, সরকারি-বেসরকারি সেবা পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে দুই শতাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।

উপকূলের কক্সবাজারের লবন চাষ, তামাক চাষ, সাতক্ষীরার কপোতাক্ষ নদের কান্না, ভোলার জেলেদের বিপন্ন জীবন, সন্দ্বীপ-হাতিয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে স্থানচ্যুত মানুষের গল্প কোন কিছুই বাদ যায়নি বাংলানিউজের এক বছরের রিপোর্টিংয়ে। সমুদ্র উপকূলের কৃষিকাজে কৃষকদের লড়াইটা কী? নারীরা কতটা সংগ্রাম করে জীবিকা নির্বাহ করছেন? শিশুরাই-বা কীভাবে অবহেলায় বেড়ে উঠছে? কতোটা কষ্টে দিনযাপন করছেন জেলেসহ সেখানকার সব পেশার মানুষ? দিনভর কাঁকড়া ধরে, কাঠ কুড়িয়ে কিংবা মাছ শুকিয়ে জীবিকা নির্বাহকারী মানুষটির জীবন কতোটা দুর্বিষহ, কীভাবে তার এক একটি দিন পার হয়? অন্ধকারে ঢাকা উপকূলীয় জনপদের মানুষের এসব তথ্য শহুরে নাগরিকের কাছে তুলে ধরেছে বাংলানিউজ।

উপকূল ঘুরে বাংলানিউজ জানতে পেরেছে, সেখানকার অনেক গ্রাম এখনও ঢেকে আছে গভীর অন্ধকারে। মহাজন-জোতদার-শোষক শ্রেণীর দাপটে কথা বলার সাহস নেই নিরীহ মানুষগুলোর। উপকূলের বহুগ্রামে এখনও বিদ্যুতের আলো পৌঁছেনি। কাঁচের ভেতর দিয়ে কিভাবে আলোর ঝিলিক ছড়ায়, তা আজও অজানা সেখানকার বহু মানুষের কাছে। পাকা রাস্তা কিংবা শহর দেখার সৌভাগ্য হয়নি অনেকেরই। কাদাপানিতে লেপটে থাকা জীবনের খবর কেউ রাখে না।

সরেজমিনে পাওয়া তথ্য-সূত্র বলছে, গোটা উপকূলীয় অঞ্চল জুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। উপকূলের মানুষ মারাত্মক ঝুঁকির মুখে রয়েছে। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক, মৎস্যজীবী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশাজীবী জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকায় প্রভাব পড়ছে। বেড়েছে নানা ধরনের দুর্যোগ। প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীল মানুষগুলো খাদ্য নিরাপত্তাহীতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বহুমূখী দুর্যোগে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে দেশের উপকূলীয় এলাকা। সাম্প্রতিককালে নদী ভাঙ্গণ বেড়েছে। সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট। এরইমধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার ভয়াবহতার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে উপকূল এলাকার মানুষের জীবন জীবিকার ধরন। প্রভাব পড়েছে সুন্দরবনের ওপর। প্রকৃতির রূদ্ররূপ সুন্দরবনের অস্তিত্ব বিলীন করে দিচ্ছে। জোয়ারের পানির প্রভাব বেড়েছে। পানিতে বাড়ছে লবণাক্ততা। আর এর প্রভাব পড়ছে কৃষি ব্যবস্থার ওপর। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে দেশের উপকূলীয় এলাকার জন্য অপেক্ষা করছে এক ভয়াবহ দুর্যোগের সংকেত। নিচু এলাকা তলিয়ে যাবে। লবণাক্ততা বাড়বে। দেখা দেবে জলাবদ্ধতা। সেই ভয়াবহতার জন্য এখন যেমন আতংক রয়েছে, তেমনি এরই মধ্যে কিছু কিছু প্রভাব দেখা দিয়েছে।

সূত্র বলছে, পিছিয়ে পড়া অনগ্রসর জনপদ উপকূলের মানুষদের প্রতিনিয়ত প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে হচ্ছে। কখনো ঘূর্ণিঝড়ে লন্ডভন্ড হয়, কখনো জলোচ্ছ্বাসে ভাসে। প্রতি বছর দুর্যোগে হাজারো মানুষের প্রাণ যায়। কোটি কোটি টাকার সম্পদহানি ঘটে। চারিদিকে শুধু আতংক আর আতংক। বিচ্ছিন্নতার কারণে উপকূলের বহু এলাকায় পৌঁছেনি উন্নয়ন সুবিধা। সরকারি-বেসরকারি সেবা পৌঁছাচ্ছেনা সাধারণ মানুষের কাছে। গড়ে ওঠেনি প্রয়োজনীয় অবকাঠামো।

উপকূলে রাস্তাঘাট, কালভার্ট, হাসপাতাল কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই। নদী-ভাঙ্গনে বিলীন হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো ভাসমান দিন কাটাচ্ছে। জীবিকা নির্বাহে সংকটের শেষ থাকে না। এরইমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে এ অঞ্চলে। পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে মানুষজন বসতি বদলাচ্ছে বারবার। যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতাই এই অঞ্চলের জীবনযাত্রা পিছিয়ে রাখছে। উপকূলের বহু এলাকা মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার কারণেই সেখানকার মানুষ কেন্দ্র থেকে অনেক দূরে। এরই প্রভাব পড়ছে সমাজের নানা স্তরে। অশিক্ষা-অসচেতনতা জনপদের মানুষদের অনগ্রসরতার গন্ডি পেরোতে দিচ্ছে না।

পিছিয়ে থাকা উপকূল অঞ্চলের মানুষের খবরাখবর কেন্দ্রের নীতিনির্ধারক মহলে পৌঁছাতে বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম-এর এই ভিন্নধর্মী এই রিপোর্টিং উদ্যোগ আগামীতেও অব্যাহত থাকবে।

শুক্রবার পড়ুন ‘উপকূলে মানুষের কাছাকাছি বাংলানিউজ’।

বাংলাদেশ সময়: ০৭৪০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।